শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Monday 1 January 2018

ফিরে দেখাঃ ২০১৭ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞান




ফিরে দেখাঃ ২০১৭ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞান 

।।০১।।
উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার গাইড লাইন ২০১৭

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি কর্তৃক উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার ৩৬৭ টি তথ্যসূত্র সম্বলিত নতুন গাইড লাইন প্রকাশিত হয়েছে প্রকাশিত নতুন গাইডলাইন ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজির যৌথ উদ্যোগে প্রণীত এই গাইডলাইন অন্যান্য নয়টি স্বাস্থ্য সংগঠনের সমর্থন পেলেও আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান্স নতুন গাইডলাইনের বক্তব্য পুরোপুরি সমর্থন করেননি এবং তারা এর বিপক্ষে অনেক জোরালো পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেছেন।


উচ্চ রক্তচাপের গাইড লাইনে নতুন কি আছে?

  • সঠিক উপায়ে রক্তচাপ মাপার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকের চেম্বার কিংবা হাসপাতালের বাইরে এবং বাড়ীতে একাধিক বার রক্তচাপ মেপে তার সঠিক গড় হিসেব গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর আগে উচ্চ রক্তচাপের অন্য কোন গাইডলাইনে রক্তচাপ মাপার বিষয়ে এমন পরামর্শ দেওয়া হয়নি। 
  • রক্তচাপের শ্রেণী বিন্যাস পদ্ধতি পরিবর্তন করা হয়েছে। জয়েন্ট ন্যাশনাল কমিশনের সপ্তম রিপোর্টে (JNC7) রক্তচাপের যে শ্রেণী বিন্যাস ছিল, বর্তমান শ্রেণী বিন্যাসকে তার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করা হচ্ছে। আসলে এবার গাইডলাইনে উচ্চ রক্তচাপের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হয়েছে। সকলেরই জানা আছে যে এতদিন রক্তচাপের মাত্রা ১৪০/৯০ মিমি পারদচাপের বেশী হলে তা উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে গণ্য হতো। কিন্তু নতুন নিয়মে রক্তচাপের মাত্রা ১৩০/৮০ মিমি পারদচাপের বেশী হলেই তা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হিসেবে গণ্য করা হবে।এরফলে অনেকে রাতারাতি নতুন করে উচ্চ রক্তচাপের রোগী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। শুধু আমেরিকাতেই উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা নতুন সংজ্ঞানুসারে ৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৬ শতাংশে  দাঁড়াবে। অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের ৩১ মিলিয়ন বাড়তি রোগীর চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।  
  • উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকির মাত্রা হিসেব করার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে রক্তচাপের টার্গেট কম রাখা হয়েছে।
  • উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনাচরণ পরিবর্তন এবং তা মেনে চলার ওপর বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান্স নতুন গাইডলাইনের বিষয়ে কেন আপত্তি করছে? কারণ তারা মনে করছেন এবারের গাইডলাইনে অধিকাংশ পরিবর্তন যথেষ্ট যুক্তি-নির্ভর হয়নি।গাইডলাইন প্রণয়নের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা স্প্রিন্ট ট্রায়ালের (SPRINT trial) ফলাফলের উপর বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন বাস্তব জগতে এই গাইডলাইনের সুপারিসসমূহ কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে। 

তথ্যসূত্রঃ

·      Whelton PK, Carey RM, Aronow WS, et al. 2017 ACC/AHA/AAPA/ABC/ACPM/ AGS/APhA/ASH/ASPC/NMA/PCNA Guideline for the Prevention, Detection, Evaluation, and Management of High Blood Pressure in Adults: Executive Summary. A Report of the American College of Cardiology/American Heart Association Task Force on Clinical Practice Guidelines. 2017. J Am Coll Cardiol 2017
·      Muntner P, Carey RM, Gidding S, et al. Potential US population impact of the 2017 American College of Cardiology/American Heart Association high blood pressure guideline. Circulation 2017
·      SPRINT Research Group, Wright JT Jr, Williamson JD, Whelton PK, et al. A randomized trial of intensive versus standard blood-pressure control. N Engl J Med 2015;373:2103-2116
·      Ioannidis JA. Diagnosis and treatment of hypertension in the 2017 ACC/AHA guidelines and in the real world. JAMA 2017;Editorial.


।।০২।।
কার্ডিয়াক ডিভাইসসহ নিরাপদ এম আর আই (MRI) স্ক্যান সম্ভব  


অনেকেই হয়তো জানেন কারও হার্টে পেস-মেকার কিংবা অন্য কোন মেটালিক ডিভাইস বসানো থাকলে তার এম আর আই করানো নিরাপদ নয় অনেক সময় প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও এধরণের রোগীদের এম আর আই করানো যায় না কিন্তু ২০১৭ সালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে মেটালিক কার্ডিয়াক ডিভাইস থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে নিরাপদে এম আর আই করা সম্ভব। একটি পর্যবেক্ষণে কার্ডিয়াক ডিভাইসযুক্ত ১২০০ রোগীর ১৫০০ এম আর আই করানোর পরেও কোন ক্ষতিকর প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  অন্য আরেকটি ঘোষণাপত্রে যথাযথ সতর্কতার সঙ্গে কার্ডিয়াক ডিভাইসসহ এমআরআই করানো সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে সুপারিশ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে অচিরেই কার্ডিয়াক ডিভাইস থাকলেও রোগীদের এম আর আই পরীক্ষা করানো সম্ভব হবে। 

তথ্যসূত্রঃ

·      Russo RJ, Costa HS, Silva PD, et al. Assessing the risks associated with MRI in patients with a pacemaker or defibrillator. N Engl J Med 2017; 376:755-764. 

·      Indik JH, Gimbel JR, Abe H, et al. 2017 HRS expert consensus statement on magnetic resonance imaging and radiation exposure in patients with cardiovascular implantable electronic devices. Heart Rhythm 2017; 14:e97- e153.


।।০৩।।
প্রদাহ এবং হৃদরোগ


সকলেই জানেন যে রক্তনালীর ভিতরের আবরণীতে চর্বির আস্তর বা অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হওয়ার ক্ষেত্রে প্রদাহের একটি ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে প্রমাণিত হয়েছে যে  প্রদাহ নিবারক ওষুধ ব্যবহার করলে আসলে হৃদরোগ লাঘব করা সম্ভব। ক্যানাকিনুম্যাব (canakinumab) এক ধরণের মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। এটা মার্কিন খাদ্য প্রশাসন কর্তৃক অনুমোদিত এবং বিরল ইমিউন ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়। একটি নতুন পর্যবেক্ষণে (CANTOS trial) হৃদরোগীদের উপর ক্যানাকিনুম্যাব প্রয়োগ করে প্রদাহ প্রশমনে সুফল পাওয়া গিয়েছে। এই ফলাফলকে অনেকেই খুব আশাব্যাঞ্জক মনে করছেন। স্ট্যাটিন কিংবা অ্যাঞ্জিওপ্লাসটির পরিবর্তে যদি প্রদাহ প্রশমনকারী ওষুধ দিয়ে হৃদরোগ নিরাময় করা সম্ভব হয়, তবে তা হবে আসলেই এক যুগান্তরকারী ঘটনা। ক্যানাকিনুম্যাবের সফলতায় অনেকেই মনে করছেন তেমন শুভক্ষণ হয়তো খুব দূরে নয়।

তথ্যসূত্রঃ
·      Ridker PM, Everett BM, Thuren T, et al. Anti-inflammatory therapy with canakinumab for atherosclerotic disease. N Engl J Med 2017; 377:1119-1131. 

·      Ridker PM, MacFadyen JG, Thuren T, et al. Effect of interleukin-1β inhibition with canakinumab on incident lung cancer in patients with atherosclerosis: Exploratory results from a randomised, double-blind, placebo-controlled trial. Lancet 2017; 390:1833-1842. 


।।০৪।।
চর্বি নিয়ে মহাবিতর্ক  ২০১৭


বরাবরের মত ২০১৭ সাল জুড়েও চিকিৎসা জগতে সঠিক ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস কি হওয়া উচিত এবং খাদ্যে কোন ধরণের চর্বি কোনটা কতটুকু থাকা উচিত তা নিয়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ সম্পর্কে মতভেদ এবং বিভ্রান্তি বেড়েছে যথেষ্ট। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ২০১৭ সালে তাদের সুপারিশমালায় খাদ্যে অতিরিক্ত সম্পৃক্ত চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে পুনরায় উল্লেখ করেছে।কম চর্বি খাওয়ার পক্ষে জোরালো প্রবক্তাদের মধ্যে রয়েছেন অনেকেই  অন্যদিকে PURE study (Prospective Urban and Rural Epidemiological Study) থেকে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে ডঃ সেলিম ইউসুফ (Dr Salim Yusuf) এবং তার দল বলছেন সম্পৃক্ত চর্বি আসলে হৃদরোগ এবং মৃত্যুর সম্ভাবনা কমায়। এই বিতর্কের মধ্যে ২০১৭ সালে Minnesota Coronary Experiment (MCE)-এর অপ্রকাশিত কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছিল যে সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবারের চেয়ে অসম্পৃক্ত চর্বি সমৃদ্ধ ভেজিটেবল অয়েল রক্তে কোলেস্টেরল কমায়। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে জানা যাচ্ছে যে ওই একই পর্যবেক্ষণের অংশগ্রহণকারীদের আসলে মৃত্যুহার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী ছিল যা এতদিন প্রকাশিত হয়নি। 
এখন চর্বির পক্ষ এবং বিপক্ষ দুদলই তাদের যুক্তি অকাট্য বলে দাবী করছেন। মাঝখানে অনেক চিকিৎসকই হতবুদ্ধি। তারা রোগীদের কি পরামর্শ দিবেন? দেখা যাক আগামীতে আমাদের জন্য নতুন কি উপদেশ আসছে? 

তথ্যসূত্রঃ
·      Sacks FM, Lichtenstein AH, Wu JHY, et al. Dietary fats and cardiovascular disease: A presidential advisory from the American Heart Association. Circulation 2017.
·      Dehghan M, Mente A, Zhang X, et al. Associations of fats and carbohydrate intake with cardiovascular disease and mortality in 18 countries from five continents (PURE): A prospective cohort study. Lancet 2017; 390:2050- 2062. 


।।০৫।।
স্ট্যাবল ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের চিকিৎসায় পিসিআই কতটুকু কার্যকরী?

২০১৭ সালের শেষে Lancet পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল স্ট্যাবল ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের (Stable Ischaemic Heart Disease- SIHD)  চিকিৎসায় পিসিআই (Percutaneous Coronary Intervention-PCI) বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে সম্প্রতি ORBITA ট্রায়ালের ফলাফলে স্ট্যাবল অ্যানজিনার কারণে বুকে ব্যথা হলে পিসিআই বা percutaneous coronary intervention করার পর বাড়তি কোন উপকার পাওয়ার প্রমাণ মেলেনি। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে একটি করোনারি আর্টারি ব্লক থাকার ফলে সৃষ্ট স্ট্যাবল ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের জন্য যথাযথ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে যেমন ফল পাওয়া যায়, পিসিআই দিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সেই একই রকম ফলাফল পাওয়া যায়। এজন্য অনেকে মনে করছেন স্ট্যাবল ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের রোগীদের ক্ষেত্রে করোনারি ইন্টারভেনসন এড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এই ফলাফল ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিস্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত গবেষণার ফলাফল অস্বীকার করার মতো নির্ভরযোগ্য তথ্য কেউ উপস্থাপন করেন নি। উল্লেখ্য ২০০৭ সালে আরেকটি পর্যবেক্ষণেও (COURAGE trial) একই রকম ফলাফল এসেছিল। উল্লেখ্য আমেরিকায় প্রতি দশজন হৃদরোগীর মধ্যে একজন স্ট্যাবল ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের রোগী।     


তথ্যসূত্রঃ

·      Al-Lamee R, Thompson D, Dehbi HM, et al. Percutaneous coronary intervention in stable angina (ORBITA): A double-blind, randomized controlled trial. Lancet 2017; DOI:10.1016/S0140-6736(17)32714-9.
·      Brown DL, Redberg RF. Last nail in the coffin for PCI in stable angina? Lancet 2017; DOI:10.1016/S0140-6736(17)32757-5.



।। ০৬।।
ইকোপিক্সেলঃ নতুন 3D মেডিক্যাল ইমেজিং

3D মেডিক্যাল ইমেজিং নতুন না হলেও, ২০১৭ সালে ইকোপিক্সেল নিয়ে এসেছে উন্নততর প্রযুক্তি। ইকোপিক্সেল সিটি স্ক্যান এবং এম আর আই স্ক্যান থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে 3D হলোগ্রাফিক ইমেজ তৈরি করে যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সৃষ্টি করে। আশা করা হচ্ছে ইকোপিক্সেল চিকিৎসা শিক্ষা, শল্য কর্ম এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। যেমনঃ মানবদেহের অ্যানাটমি শেখার জন্য ইকোপিক্সেল অনন্য ভূমিকা পালন করবে। ইকোপিক্সেলের সাহায্যে হলোগ্রাফিক ইমেজের মাধ্যমে মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের দেখান সম্ভব হবে। এর আগে অন্য কোন উপায়ে এত উন্নতমানের সিমুলেসন ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।  

তথ্যসূত্রঃ

·      Beth W. Orenstein. Virtual Radiology: New Viewing Platform Creates Interactive Medical Imaging Holograms. Radiology Today. 17(12): 14.


।।০৭।।
ক্যানসার গবেষণা 

প্রতি বছর ক্যানসার গবেষণার শত শত ফলাফল প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালও কোন ব্যতিক্রম নয়। ক্যানসারের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ সংক্রান্ত অনেক নতুন কৌশল ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, শল্যচিকিৎসা এবং ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে সব ধরণের চিকিৎসা একই রকম কাজ করে না।

এজন্য ক্যানসার কোষ ধ্বংস করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টার শেষ নেই।২০১৭ সালেও এমন কয়েকটি কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে।এদের মধ্যে দুটি কৌশল ক্যানসার কোষ ধ্বংস করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে। প্রথম পদ্ধতিতে আমাদের পরিচিত পোলিও ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বিশেষভাবে প্রস্তুত পোলিও ভাইরাস ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং পুনরায় টিউমার তৈরি হতে দেয় না।ক্যানসার কোষ ধ্বংস করার দ্বিতীয় যে পদ্ধতিটি গত বছর গুরুত্ব পেয়েছে তার নাম caspase-independent cell death (CICD)। এভাবে ক্যানসার কোষ বিনষ্ট হলে ইমিউন সিস্টেম খুব সহজে বাকী ক্যানসার কোষসমূহকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তবে ২০১৭ সালে সবচেয়ে অবাক করার খবর ছিল ভিটামিন সি। দেখা গিয়েছে ভিটামিন সি অনেক ক্যানসাররোধী ওষুধের চেয়ে ক্যানসার স্টেম সেল সৃষ্টি বন্ধ করার ক্ষেত্রে ১০ গুণ বেশী কার্যকরী।
অবশ্য বাস্তব ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতির প্রয়োগ এখনও অনেক দূরে। 
 
তথ্যসূত্রঃ
·      Brown MC, Holl EK, Boczkowski D et al. Cancer immunotherapy with recombinant poliovirus induces IFN-dominant activation of dendritic cells and tumor antigen-specific CTLs. (2017) Science Translational Medicine, 9  (408), eaan4220.
·      Mitochondrial permeabilization engages NF-κB-dependent anti-tumour activity under caspase deficiency. Giampazolias E, Zunino B, Dhayade S et al. Nature Cell Biology (2017);19:1116–1129.
·      De Francesco E, Bonuccelli G, Maggiolini M et al. Vitamin C and Doxycycline: A synthetic lethal combination therapy targeting metabolic flexibility in cancer stem cells (CSCs). Oncotarget. 2017; 8:67269-67286.   


।।০৮।।
নাক ডাকা বন্ধ করার পেস-মেকার

ঘুমের ঘোরে অনেকরই নাক ডাকে। অনেক সময় ঘুমের মধ্যে এদের শ্বাসক্রিয়া সাময়িক বন্ধও হয়ে যায় কিংবা স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে থাকে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার জটিলতা হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি গুরুতর সমস্যা হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার চিকিৎসার জন্য অবিরাম পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার ডিভাইস (continuous positive airway pressure device - CPAP) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায় প্রতি ৫ জন রোগীর মধ্যে ২ জন রোগীই CPAP ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না।
সম্প্রতি একটি ইমপ্ল্যান্ট ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে যা শ্বাসনালীর পেশীসমূহকে এমনভাবে উদ্দীপিত করে যেন ঘুমের ঘোরে শ্বাস বন্ধ না হয়ে নির্বিঘ্নে চলতে পারে। ডিভাইসটি পরিধানযোগ্য রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চলে। বলা যায় এটা হচ্ছে স্লিপ অ্যাপনিয়ার পেস-মেকার। এটি আসলে ২০১৪ সালে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এটার বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু  হয়েছে। নিউরো-মডুলেশনের এমন কৌশলী প্রয়োগের ফলে আশা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে অপ্রিয় CPAP চিকিৎসা ছাড়াই নাক ডাকা এবং স্লিপ অ্যাপনিয়ার অনেক রোগীর সুচিকিৎসা করা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্রঃ
·      Cleveland Clinic News Releases; October 25, 2017.
·      Strollo PJ Jr et al. Upper-airway stimulation for obstructive sleep apnea. 2014 Jan 9;370(2):139-49.


।।০৯।।
হাইব্রিড ক্লোজড লুপ ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেম

এটাকে বোলা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত কৃত্রিম অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াস। হাইব্রিড ক্লোজড লুপ ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেম(Hybrid Closed-Loop Insulin Delivery System) টাইপ ১ ডায়াবেটিস মেলিটাসের চিকিৎসাকে আগের চেয়ে অনেক সহজ এবং নিখুঁত করে তুলেছে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে মার্কিন খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন এটার বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলো। এই যন্ত্রটির সুবিধা হচ্ছে একই সময়ে এটা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয় করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুসারে ইনসুলিন নিঃসরণ করতে পারে। আগের যন্ত্রটি ছিল ওপেন লুপ ধরণের। অর্থাৎ প্রথমে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নির্ধারণ করতে হতো এবং রোগীকে হিসেব অনুসারে ইনসুলিন ইনজেকশন করে নিতে হতো। কিন্তু হাইব্রিড ক্লোজড লুপ ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেম আগের যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশী উপযোগী এবং দক্ষ। এই বছর এর কার্যক্ষমতা আরও বেড়েছে। ২০১৮ সালে এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ার আশা করা হচ্ছে । অনেকে আশা করছেন একই ভাবে টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যও শিগগীরই হয়তো হাইব্রিড ক্লোজড লুপ ইনসুলিন ডেলিভারি সিস্টেম বাজারে আসবে।

তথ্যসূত্রঃ
·      Cleveland Clinic News Releases; October 25, 2017.
·      FDA Approves First 'Artificial Pancreas' for Type 1 Diabetes - Medscape - Sep 28, 2016.

।।১০।।
প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ওষুধের জটিলতা

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ওষুধের তালিকায় রয়েছে ওমেপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, র‍্যাবে প্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, ডেক্সল্যান্সোপ্রাজল, এসেমোপ্রাজল ইত্যাদি। কয়েক বছর যাবৎ প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ ব্যবহার কতটুকু নিরাপদ - এ নিয়ে নানারকম বিতর্ক চলছে। একের পর এক গবেষণার ফলাফলে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহারের বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং তা অনেকের মনেই ভীতির সঞ্চার করেছে। চিকিৎসকদের প্রতিনিয়ত এ সম্পর্কে রোগীদের নিকট থেকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেক রোগী প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছেঃ কিডনির ইন্টারস্টিসিয়াল প্রদাহ ও ক্রনিক কিডনির রোগ, ডিমেনসিয়া বা বুদ্ধিভ্রংশতা, অস্থি ক্ষয় এবং হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা, হৃদরোগ হওয়ার বাড়তি সম্ভাবনা, অন্ত্রে ক্লস্ট্রিডিয়াল সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি, ফুসফুসে নিউমোনিয়া হওয়ার বাড়তি সম্ভাবনা, র‍্যাবডোমায়োলাইসিস বা মাংসপেশী গলে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতা হওয়ার প্রবণতা, হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি হওয়ার ঝুঁকি, পাকস্থলীর ভিতরের আবরণী কলা ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এত রকম জটিলতার ঝুঁকি নিয়ে কোন ওষুধ সেবন করা আসলেই চিন্তার বিষয়। এজন্য প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর সেবন করা আসলে কতটুকু নিরাপদ কিংবা বিপজ্জনক তা সঠিক নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে পড়েছিল।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে। প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে আসলেই এত রকম জটিলতা হয় কিনা এবং হলে তার সম্ভাবনা কতখানি, এ সকল প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে উক্ত গবেষণা পত্রে। এতে বলা হয়েছে যে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ সেবনের ফলে যে সকল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে তা অতিরঞ্জিত। কারণ এসম্পর্কিত অধিকাংশ গবেষণা পর্যবেক্ষণমূলক (observational study)। পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত জটিলতাসমূহ আসলেই প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের জন্য হয়েছে কিনা তা শতভাগ নিশ্চিত করা সবক্ষেত্রে এখনও সম্ভব হয়নি। এজন্য আরও উন্নত ধরণের গবেষণার প্রয়োজন।

বলাবাহুল্য প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর প্রয়োজনীয় উপকারী ওষুধ। যাদের আসলেই এটা দরকার তাদের সঠিক নিম্নতম মাত্রায় সেবন করা উচিত এবং নির্ধারিত সময়ের পরে আর না সেবন করা উত্তম। প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর সেবনে যাদের উপকার হয়না, তাদের এটা সেবন না করা ভালো। এ পর্যায়ে সকলেই মণে করছেন বিনা প্রয়োজনে মুড়ি-মুড়কির মতো প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।  

তথ্যসূত্রঃ
·      Michael F Vaezi, Yu-Xiao Yang, Colin W Howden. Complications of Proton Pump Inhibitor Therapy. Gastroenterology. July 2017; 153(1): 35-48.