শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday, 28 February 2017

মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগ বা অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ



মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগ বা অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ
 (Alcoholic Liver Disease)   

তিরিক্ত মদপান করলে লিভারে চর্বি জমেপ্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে লিভারের ক্ষত শুকিয়ে গুটি গুটি ফাইব্রোসিস  এবং শেষ পর্যন্ত লিভার সিরোসিস হয়। পশ্চিমা জগতে  লিভারের রোগসমূহের   মধ্যে    মদ্যপানজনিত লিভারের রোগই প্রধান। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে লিভারের রোগের প্রধান কারণ ভাইরাসজনিত যকৃত প্রদাহ।  
মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হিসেব অনুসারে ২০১৩ সালে মদ্যপানজনিত লিভারের রোগে  ১৮,১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ক্রনিক লিভারের রোগ এবং সিরোসিসের কারণে প্রতি লাখে ১১ জনের মৃত্যু হয়। 

লিভারের কাজ এবং গুরুত্ব 
মানুষের শরীরে মস্তিষ্কের পরে গঠন এবং কাজকর্মের দিক দিয়ে লিভার অতি জটিল। লিভার ৫০০-এর বেশী কাজ করে থাকে। এদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছেঃ 
·       লিভারে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধকারী প্রোটিন তৈরি করে   
·       রক্তের বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান বা টক্সিন পরিশোধন করে  
·       হরমোন, প্রোটিন, এবং অনেক রকম রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে   
·       রক্তের কোলেস্টেরল এবং গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে    
·       রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ তৈরি করে  
·       গ্লাইকোজেন এবং আরও প্রয়োজনীয় উপাদান সঞ্চিত রাখে।  
লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হলে আমাদের সারা দেহের কাজকর্মের উপর প্রভাব পড়ে। কোন কারণে লিভারের ক্ষত শুরু হলেও তার প্রভাব প্রকাশিত হতে অনেক সময় লাগে। কারণ লিভারের যেকোনো ক্ষত দ্রুত নিরাময় হয় এবং বিনষ্ট লিভার টিস্যু পুনর্জননের ক্ষমতা রয়েছে। এজন্য লিভারের ক্ষতের লক্ষণ-উপসর্গ ধরা পড়া কিংবা প্রকাশিত হওয়ার অর্থ তা বহুদূর অগ্রসর হয়েছে।   

মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের কারণ
অনেকেই মদপান করে থাকে কিন্তু সকলের লিভারে সমস্যা হয় না মদ খেলে কারও লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয় আর কারও লিভারে কোন সমস্যা হয় না কেন এমন হয় তার সঠিক কারণ জানা নেই
অ্যালকোহল বা ইথানল লিভারে বিপাকের পরে অ্যাসিটালডিহাইডে পরিণত হয়। এটা লিভারের কোষ বিনষ্ট করে এবং এক পর্যায়ে লিভারের গাঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। বিনষ্ট লিভারের অংশ শুকিয়ে গেলে সেখানে যে স্কার টিস্যু তৈরি হয় তা আর লিভারের কাজ করতে পারে না। এবং এভাবেই একসময় পুরো লিভার একসময় অকেজো হয়ে যায়।  লিভারের এই নষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়াটি কারও ক্ষেত্রে খুব দ্রুত ঘটে; কারও ক্ষেত্রে তেমন নয়। আগেই বলা হয়েছে কেন এমন হয় তা এখনও জানা যায়নি

মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের ঝুঁকিসমূহ 
বিভিন্ন কারণে অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।  
সব ধরণের মদে লিভারের একই রকমের ক্ষতি হয় না। ওয়াইন পান করার চেয়ে যারা বিয়ারলিকার অথবা স্পিরিট পান করে তাদের লিভার বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়
পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের শরীরে ধীরে ধীরে মদের বিপাক ক্রিয়া ঘটে। এজন্য মদ খেলে মহিলাদের লিভার সহজেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মহিলাদের লিভার মদের প্রতি পুরুষদের চেয়ে দ্বিগুণ সংবেদনশীল।  এক হিসেবে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ১৩ জন মহিলা সপ্তাহে সাত গ্লাসের বেশী মোদ পান করে থাকে। যারা বেশী পরিমাণে মদ পান করে এবং যাদের ওজন বেশী তাদের ক্রনিক লিভারের রোগ  হওয়ার সম্ভাবনা যেমন বেশী তেমন এর কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনাও বেশী। যারা নিয়মিত  মদপান করে তাদের হেপাটাইটিস সি ভাইরাস সংক্রমণ থাকলে লিভারের ক্রনিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। 
বংশগতি বা জিনের গঠনের কারণেও ক্রনিক লিভারের রোগ বেশী হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে সাধারণত লিভারে বিপাক ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনজাইমের জিন গঠনে কোন পরিবর্তন ঘটলে এমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে

মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগের পর্যায়সমূহ
অ্যালকোহলিক লিভারের রোগ সাধারণত কয়েকটি পর্যায়ে অতিক্রম করেঃ

অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার 
অতিরক্ত মদ পান করলে লিভারে ফ্যাটি অ্যাসিড জমতে শুরু করে অনেক সময় অতিরিক্ত মদ পান করলে এমন কি সপ্তাহখানেকের মধ্যেও এমন হতে পারে  পর্যায়ে লিভারের সমস্যার কোন লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পায় না।  এই পর্যায়ে মদ পান করা থেকে বিরত থাকলে লিভারের চর্বি জমা থেমে যায় এবং সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে লিভার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে
কিন্তু লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমলে ক্রমশ বিভিন্ন লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশিত হতে থাকে যেমনঃ শরীর অতিরক্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, বমি বমি ভাব হয়, পেটে ব্যথা হতে পারে, ক্ষুধা কমে যায় এবং সার্বিকভাবে অসুস্থ বোধ হতে পারে। 

অ্যালকোহলিক  হেপাটাইটিস বা  মদ্যপানজনিত যকৃত প্রদাহ 
“হেপাটাইটিস” শব্দের অর্থ লিভার বা যকৃতের প্রদাহ। অ্যালকোহল লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে   পারে। অনেকদিন নিয়মিত অতিরিক্ত মদ খেলে এমন হয়।  তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মদ পানের কারণেও প্রদাহ হতে পারে কয়েক মাস মদ পান করা থেকে বিরত থাকলে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস নিরাময় হতে পারে। অনেকের প্রদাহ প্রশমিত হতে হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিসের লক্ষণ-উপসর্গের মধ্যে রয়েছে পেটে ব্যথা, জন্ডিস, অতিরিক্ত দুর্বলতা, জ্বর, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি। 

ফাইব্রোসিস  
ফাইব্রোসিস  এমন একটি প্রক্রিয়া যার ফলে লিভারে কোলাজেন নামে পরিচিত এক ধরণের প্রোটিন অতিরিক্ত জমে যায়। অধিকাংশ ক্রনিক লিভারের সমস্যার ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে। ফাইব্রোসিস প্রক্রিয়া বেশীদূর অগ্রসর হলে তা সিরোসিসের রূপ ধারণ করে। 

সিরোসিস 
লিভারে অনেকদিন ধরে প্রদাহ চলতে থাকলে কোষসমূহ বিনষ্ট হয়ে লিভারের গাঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে লিভারের নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশে অতিরিক্ত কোলাজেন জমে অসংখ্য গুটি গুটি তৈরি হয়। এভাবে নষ্ট হয়ে শুকিয়ে যাওয়া লিভার আর প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে না। ফলে একটি মারাত্মক প্রাণঘাতী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা সিরোসিস নামে পরিচিত। সিরোসিসের ক্ষতি অপূরণীয়। অর্থাৎ একবার সিরোসিস হলে লিভারে যে পরিবর্তনগুলি ঘটে তা আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তবে মদ পান করা থেকে বিরত থাকলে লিভারের আরও ক্ষতি হওয়া প্রতিরোধ করা যায়। লিভারের ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশী হলে লিভার ট্রান্সপ্লানটেসন বা যকৃত প্রতিস্থাপন করতে হয়। 
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী অবসন্নতা এবং দুর্বলতা অনুভব করে। খাওয়ার রুচি কমে যায়, ওজন হ্রাস পায়, হাতের তালু রক্ত বরণ হতে পারে, শরীর চুলকায়, পেটে ব্যথা হয় এবং ঘুমের অনিয়ম হয়। সিরোসিস আরও অগ্রসর হলে শরীরের বিভিন্ন স্থানের চুল পড়ে যায়, ওজন আরও কমতে থাকে, জন্ডিস হতে পারে, প্রসাবের রঙ খুব হলুদ হয়, শরীরের বিভিন্নস্থান থেকে রক্তক্ষরণের প্রবণতা দেখা দেয়, যৌন ক্ষমতা কমে যায়, হাত-পায়ে পানি জমে যায়, রক্ত বমি হয়, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়, পেটে পানি জমে ফুলে যায়, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়, চেতনা লোপ পায়, শরীরে বিভিন্নরকম জীবাণুসংক্রমণসহ আরও নানারকম সমস্যা হতে থাকে।  
লিভার মদওষুধ এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান বিপাক এবং নিষ্কাশন করে। সিরোসিস হলে লিভার আর তা করতে পারে না। ফলে খুব সহজেই বিভিন্নরকম ওষুধ এবং বিষাক্ত উপাদানের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ঘটতে থাকে।  

মদ্যপানজনিত যকৃতের রোগ প্রতিরোধের উপায় 
অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ প্রতিরোধ করার সহজ উপায় মদপান করা থেকে বিরত থাকা। 
যারা মদপান ছাড়তে পারে না, তাদের অবশ্যই পানের পরিমাণ মেনে চলতে হবে।
মদপানের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসারে ২১ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশী বয়সী একজন মহিলা দিনে এক সার্ভ  এবং একজন পুরুষ দুই সার্ভ মদ পান করতে পারে। ওয়ান ড্রিঙ্ক বা এক সার্ভ মদ ৫% অ্যালকোহলযুক্ত ১২ আউন্স (৩৬০ মিলিলিটার) বিয়ার, ১২% অ্যালকোহলযুক্ত ৫ আউন্স(১৫০ মিলিলিটার) ওয়াইন বা ৪০% অ্যালকোহলযুক্ত দেড় আউন্স (৪৫ মিলিলিটার) স্পিরিটের সমতুল্য। 
মহিলাদের জন্য দিনে চার সার্ভ কিংবা সপ্তাহে আট সার্ভের বেশী এবং পুরুষদের জন্য দিনে পাঁচ সার্ভ কিংবা সপ্তাহে পনের সার্ভের বেশী মদ পান করা অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।  
দুই ঘণ্টার মধ্যে কোন মহিলা চার সার্ভ কিংবা তারচেয়ে বেশী এবং কোন পুরুষ পাঁচ সার্ভ কিংবা তারচেয়ে বেশী মদ খেলে সেটাকে “বিনজ ড্রিংকিং” (Binge drinking) বলা হয়। সকলের শরীরের গঠন একরকম নয় এবং মদ বিপাক করার ক্ষমতাও একরকম নয়। এজন্য একই পরিমাণ মদপান করে একজন সহ্য করতে পারলে, অন্য আরেকজন অসুস্থ বোধ করতে পারে।