সবাই
চায় আধুনিক জীবনের ইঁদুরদৌড়ে এগিয়ে থাকতে । আর এই তাড়না থেকে জীবনের প্রতিকুল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের শরীর ও মনে নানারকম পরিবর্তন ঘটে।
কোন হুমকি বা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় আমাদের মন ও শরীরের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয় । এর ফলে সৃষ্টি হয় মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগ। পরিমিত উদ্বেগ আমাদের প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা করতে
সাহায্য করে । অতিরিক্ত মানসিক
চাপ আমাদের দেহ ও মনে খারাপ প্রভাব ফেলে । উদ্বেগ এবং
মানসিক চাপ সৃষ্টি হলে আমাদের দেহের
বিভিন্ন স্ট্রেসর হরমোনের (এড্রিনালিন, নরএড্রিনালিন ইত্যাদি) পরিমানগত তারতম্য দেখা দেয়, নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে – যার প্রভাব পড়ে দেহ ও মনে। এ
সময় আমাদের হৃৎপিন্ডের গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যায় (প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা
করার জন্য মাংসপেশী , মস্তিষ্ক
ও হৃৎপিন্ডে বেশি রক্ত সরবরাহ করার ফলে),
শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি
পায় (শরীরে বেশী অক্সিজেন নেওয়ার জন্য), মাংসপেশী দৃঢ হয়ে উঠে (প্রতি আক্রমণ ঠেকানো বা আক্রমণ
করার জন্য), মানসিক সতর্কাবস্থা বেড়ে যায়, এমনকি
আসন্ন বিপদে রক্তক্ষরণ হতে পারে এ আশংকায় রক্ত জমাট বাধার উপাদানগুলো বৃদ্ধি
পায়। এরকম স্ট্রেসপূর্ণ অবস্থাকে এক কথায় বলা হয়- “লড়ো অথবা পালাও প্রতিক্রিয়া বা fight or flight
reaction”।
সব বয়সেই উদ্বেগ বা মানসিক চাপ
হতে পারে ।
তবে মধ্যবয়সে যে সমস্ত কারণে স্ট্রেস সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – অতিরিক্ত
কাজের চাপ ও কর্মক্ষেত্রের প্রতিকুল পরিবেশ। এছাড়া –
শব্দদূষণ, ভীড়, একাকীত্ব, ক্ষুধা, প্রিয়জনের
মৃত্যু, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক সমস্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, ঘুমের
সমস্যা, ক্যফেইন যুক্ত পানীয় গ্রহণ কিংবা নানা ধরণের শারীরিক
অসুস্থতার জন্য মানসিক চাপ বেড়ে যেতে
পারে। যাদের ব্যক্তিত্ব
টাইপ-এ অর্থাৎ যারা উচ্চাকাংক্ষী, পেশাগত অর্জনের জন্য
উদগ্রীব , কাজ-পাগল (workaholic),
সহজেই যারা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন , যারা সবসময় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করেন, তাদের মানসিক চাপ বেশী
থাকে।
দীর্ঘদিন মানসিক চাপ এবং উদ্বেগে
ভুগলে শারীরিক ও মানসিক দুধরণের
সমস্যাই হতে পারে । বিশেষত মধ্য বয়সে এ ধরণের সমস্যা বেশী হয়। মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা,
বমিভাব, অতিরিক্ত
ঘাম, নির্জীবতা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনীরোগ, উচ্চরক্তচাপ
ও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মানসিক সমস্যার মধ্যে দেখা যায় – কাজে
অমনোযোগিতা, সহকর্মী-অধস্তন বা উর্ধতন সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কের
অবনতি, সিদ্ধান্তহীনতা,
হঠাৎ রেগে যাওয়া, বিষন্নতা, উৎকন্ঠা, অসহনশীলতা, হতাশা, দাঁত
দিয়ে নখ কাটা, পা নাচানো ইত্যাদি। অতিরিক্ত মানসিক চাপের
কারণে কর্মদক্ষতা কমে যায় – সৃষ্টিশীলতা ব্যাহত হয় এবং এর প্রভাব
পড়ে ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে
এবং সমাজে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যায় – শতকরা
৪০ ভাগ কর্মী জানিয়েছেন তাদের কাজ ও কর্মক্ষেত্র উদ্বেগপূর্ণ। আমাদের মত
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এ হার আরো বেশী হতে
পারে। কর্মক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর
কারণে বেশী উদ্বেগ সৃষ্টি হয় তাহলো -
- চাকরী ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা
- কর্তৃপক্ষের
উচ্চাভিলাষী কার্যক্রম
- কাজে অসন্তুষ্টি
- চাহিদার তুলনায় কম বেতন পাওয়া
- কর্তৃপক্ষ এবং সহকর্মীদের সঙ্গে
খারাপ সম্পর্ক
- রাত
জেগে কাজ করা
- অতিরিক্ত
কাজ করতে বাধ্য হওয়া
- পরিবার
থেকে বিচ্ছিন্নতা
- অতিরিক্ত
উচ্চাকাংক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব
- কর্মক্ষেত্রে
দুর্নীতি
- মাদকাসক্তি
- মানসিক
বা শারীরিক রোগে আক্রান্ত হওয়া
- কর্মক্ষেত্রে
আবেগজনিত সম্পর্ক তৈরী হওয়া।
কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্টাইল পরিবর্তন করার পাশাপাশি উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার
কারণ চিহ্নিত করতে হবে এবং পরিবর্তন করতে হবে দৃষ্টিভংগির। এজন্য নীচের বিষয়গুলির প্রতি খেয়াল রাখলে উপকার পাওয়া
যাবে-
- কাজের লক্ষ্যগুলি আগে
ঠিক করতে হবে। গুরুত্বপুর্ণ
বিষয়গুলোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। তখন দেখা
যাবে পুনর্বিন্যাসের আগে যা এক
নম্বর গুরুত্বপুর্ণ বোধ হচ্ছিল তার চাইতে গুরুত্বপুর্ণ কিছু বিষয় বের হয়ে এসেছে, এবং
যা উদ্বেগ সৃষ্টি করছিল তা অনেকাংশে কমে গিয়েছে।
- সহজপাচ্য
কম চর্বিযুক্ত খাবার, ফল ও আঁশযুক্ত খাবার খাদ্যতালিকায় রাখা ভালো। খাবার তালিকায় অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া তেল বর্জন করতে
হবে।
- নির্দিষ্ট
সময়ে খেতে হবে। কাজের তাড়ায় সকালের নাস্তা যেন বেলা এগারোটায় আর
লাঞ্চ যেন বিকাল পাঁচটায় না খেতে হয় সেদিকে নজর দিতে হবে । অফিসে দেরী হবে এই ভয়ে পানি দিয়ে গিলে খাবার খাওয়া যাবে না- সময় নিয়ে
উপভোগ করে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
- ক্যাফেইনযুক্ত
(চা, কফি, কোলা) পানীয়,
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
- প্রতিদিন
নিয়মিত কিছু হালকা ব্যায়াম বা শরীর চর্চা করতে হবে। অন্যথায় প্রতিদিন অন্তত ৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে।
- প্রতিদিন কিছু সময় যোগব্যায়াম,
শিথিলায়ণ কিংবা ধ্যান চর্চা করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
- নিয়মিত প্রয়োজনমতো ঘুমাতে হবে । ভালো ঘুম উদ্বেগ দূর করার জন্য খুবই কার্যকরী ।
- নিজের
ও পরিবারের জন্য কিছু সময় রাখতে হবে। প্রিয়জনদের নিয়ে বছরে অন্তত দুয়েক বার কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসা
ভালো।
- আয়ের
সুষম বন্টন ও ব্যয়ের বাহুল্য খাতকে সংকুচিত করে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে।
- সিদ্ধান্তহীনতায়
ভোগা ক্ষতিকর। হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে , প্রয়োজনে
নির্ভরশীল কারো সংগে পরামর্শ করা
উচিৎ।
- জীবনে
চলতে গেলে যে সমস্যা আসবে তার প্রতি ক্ষোভ
কিংবা আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখানো ঠিক নয় । হতাশ
না হয়ে সমস্যাটি বিশ্লেষণ করতে হবে এবং বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
- কোন
চাকরী গ্রহণ বা ছাড়ার আগে, নতুন কোন সম্পর্ক তৈরী বা ভাঙ্গার আগে বাস্তব ও
যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবসময় আবেগ দ্বারা চালিত হলে সমস্যার সমাধান হবে না; বরং জটিলতা বাড়বে।
- জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভংগি গড়ে তুলতে হবে। সবকিছুর মধ্যে যেটা ভাল তার দিকে
মনোযোগ দেয়ার অভ্যাস করতে হবে।
- একটি
কাজে সফল হতে না পারলেই
হতাশায় ভেংগে পড়া চলবে না। ভাবতে
হবে সামনে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ
রয়েছে, সেখানে সফল হওয়ার
আশা পোষণ করতে হবে।
- হাসতে হবে। প্রতিটা
বিষয়ে হালকা দিক নিয়ে নিজের ভেতর রসবোধ তৈরী
করার চেষ্টা করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে গম্ভীর না থেকে - নিজে হাসুন, অন্যকে
হাসানোর চেষ্টা করতে হবে।
- শারীরিক
রোগ যেমন - ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির জন্য নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহন করতে হবে এবং রোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- কর্মক্ষেত্রে
অযথা মুরুব্বিয়ানা দেখানো কিংবা সব কাজে
খুঁত ধরা ভালো নয় । সহনশীল হতে হবে এবং ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে।
- অফিসে
ভালো বন্ধু গড়ে তুলতে হবে; তার সাথে অফিসের বিষয়াদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করলে উপকার পাওয়া যায়। ‘কর্পোরেট পলিটিক্স’ এড়িয়ে চলা বুদ্ধিমানের কাজ।
- অপ্রয়োজনীয়
কাজে অফিসে সময় নষ্ট করা মোটেও উচিৎ নয়।
কখনই অন্যের সমালোচনা কিংবা নিন্দা করা উচিৎ নয়।
- কাজের
ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিণতির দিকে নজর দিতে
হবে এবং অন্যদেরকেও সেদিকে নজর দিতে উৎসাহিত করতে হবে।
- কর্মক্ষেত্রে
কোন কোন বিষয়গুলো উদ্বেগ সৃষ্টি করছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে
পরিবার কিংবা সহকর্মীর
সাহায্য নিতে হবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে কর্পোরেট বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে। দেশীয় কর্পোরেট এক্সিকিউটিগণ আন্তর্জাতিক
মানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানীতে শক্ত অবস্থান করে
নিচ্ছেন, পাশাপাশি দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলির সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগ নিয়ন্ত্রনের বিষয়টি এখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি । উন্নত বিশ্বে কর্মক্ষেত্রের উদ্বেগ বা স্ট্রেস
নিয়ন্ত্রনের জন্য বেশীরভাগ কোম্পানীতে রয়েছে বিশেষ পরামর্শের আয়োজন । গড়ে উঠেছে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এখনো
সেরকমভাবে গড়ে উঠেনি। কিন্তু কর্মস্থলে কর্মীদের মানসিক চাপ মুক্ত রেখে স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র তৈরী করা
উৎপাদনশীলতা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।