।। ১।।
নার্সিসাসকে বলা হয় আত্মপ্রেমের প্রতীক। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি-র একটি চিত্রকর্মের নাম “মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস”। ফ্রয়েড ১৯১৪ সালে “On Narcissism: An Introduction” নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন।
নার্সিসাস (Narcissus) একটি ড্যাফোডিল জাতীয় ফুলেরও নাম। গ্রীক মিথ অনুসারে এই ফুলের জন্ম নার্সিসাস নামের এক অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে। এই যুবকের আচরণের নাম নার্সিজম (Narcissism) বা আত্ম-প্রেম।
নার্সিসাসের পিতা ছিলেন নদীর দেবতা সিফিসাস (Cephissus) এবং মাতা লিরিউপি (Liriope)। নার্সিসাসের জন্মের পর তার মা ছেলের আয়ুষ্কালের ব্যাপারে জানার জন্য এক অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তার নিকট নিয়ে গেলেন। ভবিষ্যৎ-বক্তার নাম ছিল টাইরেসিয়াস (Tirasias)।
।।২।।
এখানে টাইরেসিয়াসের অন্ধ হওয়ার কাহিনী জানা দরকার। আগে তিনি অন্ধও ছিলেন না; এমন কি ভবিষ্যৎ-বক্তাও ছিলেন না। পুরুষ হয়েও এক পর্যায়ে তিনি সাত বছর নিজেকে নারী হিসেবে রূপান্তর করে রেখেছিলেন। এই সময় তিনি নারীদের সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পারেন। এর একটি হলো মিলনে নারীরা পুরুষদের থেকে বেশি পুলকিত হয়। যখন তিনি এই আবিষ্কারের কথা দেবরাজ জিউস ও তাঁর স্ত্রী হেরাকে বললেন, হেরা খুবই ক্ষেপে গেলেন এবং টাইরেসিয়াসকে অন্ধ করে দিলেন। এরপর তিনি তাঁর দ্বিতীয় আবিষ্কারটি করলেন যে, সব নারী তার এ কথা শুনতে চাইবে না। টাইরেসিয়াসের অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জিউস তাঁকে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা দিয়ে দিলেন!
।।৩।।
নার্সিসাসের মা লিরিউপি তাঁকে নিয়ে এই অন্ধ টাইরেসিয়াসের কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কতদিন বাঁচবে?’
টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে এক দীর্ঘ জীবন পাবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে সে নিজেকে যেন কখনও না দেখে’।
নার্সিসাস ছিল অসামান্য সুন্দর। জলপরী, বনদেবী, ঝর্নাপরী, সুন্দরী মেয়েরা, এমন কি ছেলেরাও তাঁর প্রেমে পড়তো। কিন্তু সে কাউকেই পাত্তা দিত না। একবার এমিনিয়াস নামক এক যুবক নার্সিসাসের প্রেমে মজলো। কিন্তু নার্সিসাস তাকে ফিরিয়ে দিল এবং একটা ছুরি উপহার দিল। এমিনিয়াস সেই ছুরি দিয়ে নার্সিসাসেরই দরজার সামনে আত্মহত্যা করলো।
নার্সিসাসের প্রতি চরম অনুরক্ত এক বনদেবী হলো ইকো (Echo)। ইকো মানে প্রতিধ্বনি। ইকো কথা বলতে পারতো না। শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারতো।
।।৪।।
ইকোর এই অবস্থাও করেছিলেন জিউসের স্ত্রী হেরা।উল্লেখ্য জিউস মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে মিলিত হওয়ার জন্য অলিম্পাস পর্বত থেকে চলে আসতেন। হেরা তাঁর স্বামীকে হাতেনাতে ধরার জন্য অলিম্পাস থেকে একবার চলে এলেন। কিন্তু ইকো দীর্ঘসময় সুমিষ্ট কণ্ঠে চমৎকার সব গল্প বলে হেরাকে ভুলিয়ে রাখলো। এই ফাঁকে জিউস চম্পট দিতে পারলেন। হেরার সন্দেহ হলো যে, ইকো তাঁর সাথে ফাঁকিবাজি করেছে। তাই তিনি বাচাল ইকোর কন্ঠস্বর কেড়ে নিলেন। তাঁকে অভিশাপ দিলেন যেন সে কখনো নিজে থেকে কথা বলতে না পারে। বোকার মতো মানুষের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারবে শুধু।
।।৫।।
এদিকে নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য। ইকোও তাঁর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকত। ভাবতো হয়তো একবার হলেও নার্সিসাস তার দিকে তাকাবে। একদিন নার্সিসাস যখন বনের মধ্যে ঘুরছিলো তখন কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। সে জিজ্ঞেস করলো “কে এখানে?” ইকো প্রতিউত্তর করলো, “এখানে...”। নার্সিসাস আবার বললো, “এদিকে এসো”। ইকো প্রতিউত্তর করলো, “এসো...”। নার্সিসাস বললো, “তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?...আমার কাছে এস”। ইকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো; কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে ডেকেছে! কিন্তু হায়! সে নিজে তো কথা বলতে পারেনা। সে ছুটে গেলো নার্সিসাসের দিকে এবংঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে।
এতে নার্সিসাস খুব রেগে গেলো। বললো, “সরে যাও! আমি মরে যেতে রাজি আছি, তবুও তোমার হবো না!” এই বলে সে ইকোকে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ইকোর শরীরের চাপে বনের কচি কচি লতা-গুল্ম পিষ্ট হয়ে গেলো। তার হৃদয় ভেঙে গেলো। লজ্জায় অপমানে সে দৌড়ে পর্বতের দিকে চলে গেলো। আক্ষেপ করতে করতে একসময় সে মরেই গেলো। পর্বতের পাথরের সঙ্গে তার শরীরও লীন হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে অনুকরণ করে।
।।৬।।
একইভাবে আরো অনেক দেবী এবং পরী আকৃষ্ট হল নার্সিসারের প্রতি। কিন্তু নার্সিসাস তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দূরে সরিয়ে দিতো। এভাবে অপমানিত হয়ে তারা মন থেকে চাইত যে, ভালোবেসেও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কেমন তা নার্সিসাস একবার যেন বুঝতে পারে। এমন প্রত্যাখ্যাতদের মধ্যে একজন একবার প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করলো, “হে দেবী নেমেসিস, নার্সিসাস যদি কখনো প্রেমে পড়েও, সে যেন ভালোবাসা না পায়”।
নেমেসিস প্রার্থনা শুনলেন এবং নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।
।।৭।।
একদিন প্রখর রৌদ্রের মধ্যে নার্সিসাস একটি ঝর্ণার পাশে এলো। সে যখনি ঝর্ণার পানির দিকে তাকালো, দেখলো এক অপূর্ব দেবতা পানি থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারল না যে ওই প্রতিবিম্ব তারই। নার্সিসাস সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে গেলো। নার্সিসাস তাঁর প্রতিবিম্বকে পানি থেকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালো। পানিতে ঢেউ উঠতেই সেই তা হারিয়ে গেলো। নার্সিসাস অস্থির হয়ে উঠলো। কোথায় চলে গেলো তাঁর ভালোবাসার মানুষ? যখন পানি আবার স্থির হয়ে এলো,প্রতিবিম্বও আবার ফিরে এলো। নার্সিসাস তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “কেনো? হে সুন্দর, কেনো তুমি আমার কাছে থেকে দূরে থাকো, কেনো আমাকে এড়িয়ে যাও? পরীরা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল। তোমাকেও আমার প্রতি বিরক্ত দেখা যাচ্ছে না। যখন আমি আমার হাত বাড়িয়ে দেই, তুমিও তাই করো। তুমি আমাকে দেখে হাসো এবং আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও”। আবার হাত বাড়ালো নার্সিসাস। প্রতিবিম্ব আবার চলে গেলো। পানি স্পর্শ করলেই প্রতিবিম্ব অদৃশ্য হয়ে যায়, এতে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে গেলো। সে আর পানির দিকে হাত বাড়ালো না। কিন্তু একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো তাঁর প্রতিবিম্বের প্রতি।
হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। যেহেতু সে কাঁদত, ইকোও তার সাথে কাঁদত। সে নড়াচড়া করতো না, খেতো না, কোন কিছু পান করতো না। শুধু গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকলো। অলীক প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকলো, তার সৌন্দর্য ম্লান হতে লাগলো। যে পরীরা তাকে ভালোবাসতো তারা বারবার তাকে অনুরোধ করলো সেই ঝর্ণার সামনে থেকে সরে আসতে। ইকোও অনুরোধ করলো। কিন্তু নার্সিসাস যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেখানেই পড়ে রইলো। এভাবে একসময় ইকোর মতো নার্সিসাসও মরে গেলো। ধীরে ধীরে তাঁর শরীরও অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরীরা শোকে বিলাপ করতে থাকলো। ইকোও তাঁদের সাথে বিলাপ করতে থাকলো। আর মিশে যাওয়া নার্সিসাসের শরীর থেকে জন্ম নিল একটি ফুলের গাছ। ফুলের নাম নার্সিসাস। অনেকে বাংলায় এটাকে নার্গিস ফুল বলে থাকে।
(গ্রীক মিথ অবলম্বনে)