শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Monday 31 October 2016

“হ্যালোইন"ঃ ট্রিক অর ট্রিট


প্রায় দুই হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল হ্যালোইন। "হ্যালোইন" শব্দের উৎপত্তি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। এর অর্থ "পবিত্র সন্ধ্যা"। এটি স্কটিশ শব্দ "অল হ্যালোজ ইভেনিং" থেকে এসেছ। পরে সংক্ষিপ্ত হয়ে "হ্যালোইন" রূপ নিয়েছে। এর শুরু প্রাচীন মধ্য এবং পশ্চিম ইউরোপে । তখন এই অঞ্চল কেল্ট নামে পরিচিত ছিল। এটা বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং ফ্রান্সের উওর অংশ। 

প্রতি বছর ৩১ অক্টোবর কেল্টিকবাসীরা শস্য কেটে ঘরে তোলার উৎসব উদযাপন করে। প্রথমে অবশ্য ভূতপ্রেত হ্যালোইনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। উৎসবটি পালিত হতো মূলত নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে।  সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো ছিল মূল উদ্দেশ্য । এই এলাকায় প্যাগান লোকজন বিশ্বাস করত ফসল কাটার মৌসুমের শেষ দিন এবং শীতকালের প্রথম রাতে মৃতদের আত্মা পৃথিবীতে নেমে আসে।

আজকাল হ্যালোইনে দিনের আলো ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গেই ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে। সবার গায়ে থাকে অদ্ভুত সব পোশাক। হাতে থাকে লণ্ঠন বা টর্চ। বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে আর বলে ‘ট্রিক অর ট্রিট’। কেউই অবশ্য ট্রিক করতে দেয় না। সবাই ট্রিট দিয়ে দেয় চকোলেট। আর সেই চকোলেট নেয়ার জন্য ছোট ছেলেমেয়েরা বালতি কিংবা ব্যাগ নিয়ে বের হয়। অনেকে আবার বাড়ির উঠোন কিংবা বারান্দাকে  ভৌতিক বানিয়ে ফেলে। কেউ মাকড়সার জাল বানিয়ে তাতে টাঙিয়ে দেয় কঙ্কাল। হ্যালোইন ডে এর প্রধান প্রতীক হলো কুমড়ার মধ্যে একটি মোমবাতি দেয়া। বড় বড় মিষ্টিকুমড়োর ভেতরটা ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। তারপর কুমড়োর খোলের গায়ে বানানো হয় চোখমুখ। আর ভেতরে জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাতি। হ্যালোইনের রাত সবাই শুধু ট্রিক অর ট্রিটেই কাটিয়ে দেয় না, অনেকে আবার চলে যায় কোনো ভৌতিক স্থানে ঘুরতে। অনেকে বনে আগুন জ্বালিয়ে পার্টি করে। কেউ কেউ আবার ভূতের সিনেমা দেখেও হ্যালোইন উদযাপন করে।

উনিশ শতকে আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা এই উৎসব নিয়ে আসে উত্তর আমেরিকায়। অনেক আমেরিকান এখনও বিশ্বাস করে যে ভূত বা অশরীরী কোনো শক্তি এ পৃথিবীতে আছে। তারা মনে করেন এই দিন মৃত আত্মারা  নিকটজনের সান্নিধ্য লাভের আশায় পৃথিবীর বুকে নেমে আসে। এরা আসে সবার মাঝে থাকার বাসনা নিয়ে; কিন্তু পৃথিবীর মানুষ সেটা কোনোভাবেই হতে দিতে চায় না। সবাই নিজ নিজ বাড়িঘরের সামনে লন্ঠন ও রঙ্গিন বাতি জ্বালিয়ে রাখে যেন সেই আলোয় মৃত আত্মারা পথ দেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আমেরিকানরা আইরিশ ও ইংলিশদের ঐতিহ্য থেকে আলাদা কস্টিউম ও ধারায় হ্যালোইন পালন করতে শুরু করে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার, উপহার ও টাকা চাওয়ার রেওয়াজ চালু করে। সেটাই বর্তমানে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। ধীরে ধীরে হ্যালোইন সব বয়সীদের উৎসবে পরিণত হয়। তখন তারা নেচে-গেয়ে, পার্টি করে ছুটির দিনটি পালন করত। পরিবর্তন হতে হতে হ্যালোইন উৎসব এখন নতুন এক রূপ ধারণ করেছে। হ্যালেইনের পেছনে শুধু আমেরিকানরাই খরচ করে ৬ বিলিয়ন ডলার। এটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ছুটির দিন। 

পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন হ্যালোইন উৎসব পালিত হয়। 

Sunday 30 October 2016

আমাদের “ দ্বিতীয় মস্তিষ্ক ”



একসময়ে বহুদিন মস্তিষ্ক সম্বন্ধে মানুষের কোনই ধারণা ছিল না। প্রাচীন গ্রন্থসমূহে মস্তিষ্ক বা এ জাতীয় কোন শব্দ ছিলনা। অ্যারিষ্টটল ( Aristotle) মস্তিষ্কের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর কাজ সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অদ্ভুত ছিল। তিনি মনে করতেন মস্তিষ্কের কাজ শরীরের গরম রক্তকে ঠাণ্ডা করে হৃৎপিণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া। গ্যালেন ( Galen ) বিশ্বাস করতেন মস্তিষ্ক সচেতন মনের ( Conscious mind ) বা  চিন্ময় আত্মার আধারমাত্র। এরপর মস্তিষ্ক সম্বন্ধে বহুদিন আর কোন তথ্য পাওয়া যায়না। মধ্যযুগে মানুষের ধারণা ছিল মস্তিষ্ক মনের ইন্দ্রিয় মাত্র। ফুসফুসে যেসব বায়ুকোষ আছে, তাদের সকলের যেমন একই কাজ—মস্তিষ্কের প্রত্যেক অংশের তেমন একই কাজ। দেখা, শোনা, অনুভব, চিন্তা ইত্যাদি নানাকাজের জন্য মস্তিষ্কে যে ভিন্ন ভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট আছে এই সত্যটিও তখন অজ্ঞাত ছিল।

এখন মস্তিষ্ক সম্পর্কে সকলেরই কমবেশি ধারণা রয়েছে। মস্তিষ্ক আমাদের সব কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা এবং দেহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে দিনে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার হচ্ছে যে মাথার খুলির ভিতরের মস্তিষ্ক ছাড়া আমাদের আরেকটি "মস্তিষ্ক" রয়েছে যেটাকে "দ্বিতীয় মস্তিষ্ক” বলা হচ্ছে। এই "দ্বিতীয় মস্তিষ্ক" রয়েছে আমাদের পেটের মধ্যে। অন্ত্রের ভিতরে যে বিশেষ ধরণের স্নায়ুসমূহ রয়েছে তাদের বলা হয় “আন্ত্রিক স্নায়ু ব্যবস্থা”। এতদিন মনে করা হত এটা শুধু অন্ত্রের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যা ভাবা হত এরা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ করে। 

“আন্ত্রিক স্নায়ু ব্যবস্থা”-র বিশেষত্ব হচ্ছে এটা পরিপাকতন্ত্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। আসল মস্তিষ্ক থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলেও এটা আপন গতিতে কাজ করে যেতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে পরিপাকতন্ত্র ছাড়া এটা আমাদের মনের ভাব, মেজাজ মর্জি এবং আচরণের ওপরেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমাদের মন ভাল রাখা এবং মনে আনন্দ আনার জন্য ডোপামিন এবং সেরোটোনিন নামের দুটি রাসায়নিক উপাদানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শরীরের অর্ধেক ডোপামিন এবং অধিকাংশ সেরোটোনিন আসলে তৈরি করে অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়া বিশেষ ধরণের খাবার গ্রহণ করার ইচ্ছা জাগানোর জন্য বার্তাও প্রেরণ করতে পারে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় আমাদের কোন বিশেষ সবজি কিংবা ফল খেতে ইচ্ছে করছে। এর পেছনে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা রয়েছে। সন্দেহ নেই এই পুরো প্রক্রিয়াটি খুব জটিল এবং সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আসল মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের স্নায়ুব্যবস্থার মধ্যে একটি দীর্ঘ বিবর্তনগত যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগটি কেমন কাজ করছে, তার ওপর আমাদের সুস্থতা অনেকটাই  নির্ভরশীল। আমাদের খাওয়াদাওয়া যেমন আমাদের মন-মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে, তেমন আমাদের মন-মানসিকতাও খাওয়াদাওয়ার প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। 

অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া শুধু ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে না, আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলে। যেমন দই একটি উপাদেয় খাদ্য। এতে আমাদের শরীরের জন্য দরকারি অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। দেখা যাচ্ছে দই খেলে মানসিক বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ লাঘব হয়। অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও সহায়তা করে। 

এখন মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক মানসিক সমস্যা এবং আচরণগত জটিলতার চিকিৎসার জন্য “দ্বিতীয় মস্তিষ্কের” দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর সেটা করতে গেলে লক্ষ্য রাখতে হবে অন্ত্রে আমাদের উপকারী বন্ধু ব্যাকটেরিয়াদের অবস্থা কি। অন্ত্রের “ক্ষুদে বন্ধু”রা ভাল থাকলে আমরা সুস্থ থাকি।  



তথ্যসূত্রঃ Wang H-X, Wang Y-P. Gut Microbiota-brain Axis. Chinese Medical Journal. 2016;129(19):2373-2380.

Thursday 27 October 2016

নার্সিসাস ও ইকো



।। ১।। 
নার্সিসাসকে বলা হয় আত্মপ্রেমের প্রতীক। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি-র একটি চিত্রকর্মের নাম “মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস”। ফ্রয়েড ১৯১৪ সালে “On Narcissism: An Introduction” নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। 
নার্সিসাস (Narcissus) একটি ড্যাফোডিল জাতীয় ফুলেরও  নাম। গ্রীক মিথ  অনুসারে এই ফুলের জন্ম নার্সিসাস নামের এক অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে। এই যুবকের আচরণের নাম নার্সিজম (Narcissism) বা আত্ম-প্রেম।
নার্সিসাসের পিতা ছিলেন নদীর দেবতা সিফিসাস (Cephissus) এবং মাতা লিরিউপি (Liriope)। নার্সিসাসের জন্মের পর তার মা ছেলের আয়ুষ্কালের ব্যাপারে জানার জন্য এক অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তার নিকট নিয়ে গেলেন। ভবিষ্যৎ-বক্তার নাম ছিল টাইরেসিয়াস (Tirasias)।  
।।২।। 
এখানে টাইরেসিয়াসের অন্ধ হওয়ার কাহিনী জানা দরকার। আগে তিনি অন্ধও ছিলেন না; এমন কি ভবিষ্যৎ-বক্তাও ছিলেন না। পুরুষ হয়েও এক পর্যায়ে তিনি সাত বছর নিজেকে নারী হিসেবে রূপান্তর করে রেখেছিলেন। এই সময় তিনি নারীদের সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে পারেন। এর একটি হলো মিলনে নারীরা পুরুষদের থেকে বেশি পুলকিত হয়। যখন তিনি এই আবিষ্কারের কথা দেবরাজ জিউস ও তাঁর স্ত্রী হেরাকে বললেন, হেরা খুবই ক্ষেপে গেলেন এবং টাইরেসিয়াসকে অন্ধ করে দিলেন। এরপর তিনি তাঁর দ্বিতীয় আবিষ্কারটি করলেন যে, সব নারী তার এ কথা শুনতে চাইবে না। টাইরেসিয়াসের অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জিউস তাঁকে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা দিয়ে দিলেন! 
।।৩।। 
নার্সিসাসের মা লিরিউপি তাঁকে নিয়ে এই অন্ধ টাইরেসিয়াসের কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কতদিন বাঁচবে?’
টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে এক দীর্ঘ  জীবন পাবে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে সে নিজেকে যেন কখনও না দেখে’। 
নার্সিসাস ছিল অসামান্য সুন্দর। জলপরী, বনদেবী, ঝর্নাপরী, সুন্দরী মেয়েরা, এমন কি ছেলেরাও তাঁর প্রেমে পড়তো। কিন্তু সে কাউকেই পাত্তা দিত না। একবার এমিনিয়াস নামক এক যুবক নার্সিসাসের প্রেমে মজলো। কিন্তু নার্সিসাস তাকে ফিরিয়ে দিল এবং একটা ছুরি উপহার দিল। এমিনিয়াস সেই ছুরি দিয়ে নার্সিসাসেরই দরজার সামনে আত্মহত্যা করলো।  
নার্সিসাসের প্রতি চরম অনুরক্ত এক বনদেবী হলো ইকো (Echo)। ইকো মানে প্রতিধ্বনি। ইকো কথা বলতে পারতো না। শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারতো। 
।।৪।। 
ইকোর এই অবস্থাও করেছিলেন জিউসের স্ত্রী হেরা।উল্লেখ্য জিউস মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে মিলিত হওয়ার জন্য অলিম্পাস পর্বত থেকে চলে আসতেন। হেরা তাঁর স্বামীকে হাতেনাতে ধরার জন্য অলিম্পাস থেকে একবার চলে এলেন। কিন্তু ইকো দীর্ঘসময় সুমিষ্ট কণ্ঠে চমৎকার সব গল্প বলে হেরাকে ভুলিয়ে রাখলো। এই ফাঁকে জিউস চম্পট দিতে পারলেন। হেরার সন্দেহ হলো যে, ইকো তাঁর সাথে ফাঁকিবাজি করেছে। তাই তিনি বাচাল ইকোর কন্ঠস্বর কেড়ে নিলেন। তাঁকে অভিশাপ দিলেন যেন সে কখনো নিজে থেকে কথা বলতে না পারে। বোকার মতো মানুষের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারবে শুধু।   
।।৫।। 
এদিকে নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য। ইকোও তাঁর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকত। ভাবতো হয়তো একবার হলেও নার্সিসাস তার দিকে তাকাবে। একদিন নার্সিসাস যখন বনের মধ্যে ঘুরছিলো তখন কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। সে জিজ্ঞেস করলো “কে এখানে?” ইকো প্রতিউত্তর করলো, “এখানে...”। নার্সিসাস আবার বললো, “এদিকে এসো”। ইকো প্রতিউত্তর করলো, “এসো...”। নার্সিসাস বললো, “তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো?...আমার  কাছে এস”। ইকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো; কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে ডেকেছে! কিন্তু হায়! সে নিজে তো কথা বলতে পারেনা। সে ছুটে গেলো নার্সিসাসের দিকে এবংঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে।
এতে নার্সিসাস খুব রেগে গেলো। বললো, “সরে যাও! আমি মরে যেতে রাজি আছি, তবুও তোমার হবো না!” এই বলে সে ইকোকে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। ইকোর শরীরের চাপে বনের কচি কচি লতা-গুল্ম পিষ্ট হয়ে গেলো। তার হৃদয় ভেঙে গেলো। লজ্জায় অপমানে সে দৌড়ে পর্বতের দিকে চলে গেলো। আক্ষেপ করতে করতে একসময় সে মরেই গেলো। পর্বতের পাথরের সঙ্গে তার শরীরও লীন হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে অনুকরণ করে।
।।৬।। 
একইভাবে আরো অনেক দেবী এবং পরী আকৃষ্ট হল নার্সিসারের প্রতি। কিন্তু নার্সিসাস তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দূরে সরিয়ে দিতো। এভাবে অপমানিত হয়ে তারা মন থেকে চাইত যে, ভালোবেসেও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কেমন তা নার্সিসাস একবার যেন বুঝতে পারে। এমন প্রত্যাখ্যাতদের মধ্যে একজন একবার প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করলো, “হে দেবী নেমেসিস, নার্সিসাস যদি কখনো প্রেমে পড়েও, সে যেন ভালোবাসা না পায়”।
 নেমেসিস প্রার্থনা শুনলেন এবং নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।
।।৭।। 
একদিন প্রখর রৌদ্রের মধ্যে নার্সিসাস একটি ঝর্ণার পাশে এলো। সে যখনি ঝর্ণার পানির  দিকে তাকালো, দেখলো এক অপূর্ব দেবতা  পানি  থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারল না যে ওই প্রতিবিম্ব তারই। নার্সিসাস সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে  গেলো। নার্সিসাস তাঁর প্রতিবিম্বকে পানি থেকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়ালো। পানিতে ঢেউ উঠতেই সেই তা হারিয়ে গেলো। নার্সিসাস অস্থির হয়ে উঠলো। কোথায় চলে গেলো তাঁর ভালোবাসার মানুষ? যখন পানি আবার স্থির হয়ে এলো,প্রতিবিম্বও আবার ফিরে এলো। নার্সিসাস তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “কেনো? হে সুন্দর, কেনো তুমি আমার কাছে থেকে দূরে থাকো, কেনো আমাকে এড়িয়ে যাও? পরীরা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল। তোমাকেও আমার প্রতি বিরক্ত দেখা যাচ্ছে না। যখন আমি আমার হাত বাড়িয়ে দেই, তুমিও তাই করো। তুমি আমাকে দেখে হাসো এবং আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও”। আবার হাত বাড়ালো নার্সিসাস। প্রতিবিম্ব  আবার চলে গেলো। পানি স্পর্শ করলেই প্রতিবিম্ব অদৃশ্য হয়ে যায়, এতে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে গেলো। সে আর পানির দিকে হাত বাড়ালো না। কিন্তু একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো তাঁর প্রতিবিম্বের প্রতি।
হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। যেহেতু সে কাঁদত, ইকোও তার সাথে কাঁদত। সে নড়াচড়া করতো না, খেতো না, কোন কিছু পান করতো না। শুধু গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকলো। অলীক প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকলো, তার সৌন্দর্য ম্লান হতে লাগলো। যে পরীরা তাকে ভালোবাসতো তারা বারবার তাকে অনুরোধ করলো সেই ঝর্ণার সামনে থেকে সরে আসতে। ইকোও অনুরোধ করলো। কিন্তু নার্সিসাস যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেখানেই পড়ে রইলো। এভাবে একসময় ইকোর মতো নার্সিসাসও মরে গেলো। ধীরে ধীরে তাঁর শরীরও অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরীরা শোকে বিলাপ করতে থাকলো। ইকোও তাঁদের সাথে বিলাপ করতে থাকলো। আর মিশে যাওয়া নার্সিসাসের শরীর থেকে জন্ম নিল একটি ফুলের গাছ। ফুলের নাম নার্সিসাস। অনেকে বাংলায় এটাকে নার্গিস ফুল বলে থাকে। 


(গ্রীক মিথ অবলম্বনে)