একসময়ে বহুদিন মস্তিষ্ক সম্বন্ধে মানুষের কোনই ধারণা ছিল না। প্রাচীন গ্রন্থসমূহে মস্তিষ্ক বা এ জাতীয় কোন শব্দ ছিলনা। অ্যারিষ্টটল ( Aristotle) মস্তিষ্কের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর কাজ সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অদ্ভুত ছিল। তিনি মনে করতেন মস্তিষ্কের কাজ শরীরের গরম রক্তকে ঠাণ্ডা করে হৃৎপিণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া। গ্যালেন ( Galen ) বিশ্বাস করতেন মস্তিষ্ক সচেতন মনের ( Conscious mind ) বা চিন্ময় আত্মার আধারমাত্র। এরপর মস্তিষ্ক সম্বন্ধে বহুদিন আর কোন তথ্য পাওয়া যায়না। মধ্যযুগে মানুষের ধারণা ছিল মস্তিষ্ক মনের ইন্দ্রিয় মাত্র। ফুসফুসে যেসব বায়ুকোষ আছে, তাদের সকলের যেমন একই কাজ—মস্তিষ্কের প্রত্যেক অংশের তেমন একই কাজ। দেখা, শোনা, অনুভব, চিন্তা ইত্যাদি নানাকাজের জন্য মস্তিষ্কে যে ভিন্ন ভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট আছে এই সত্যটিও তখন অজ্ঞাত ছিল।
এখন মস্তিষ্ক সম্পর্কে সকলেরই কমবেশি ধারণা রয়েছে। মস্তিষ্ক আমাদের সব কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা এবং দেহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। দিনে দিনে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার হচ্ছে যে মাথার খুলির ভিতরের মস্তিষ্ক ছাড়া আমাদের আরেকটি "মস্তিষ্ক" রয়েছে যেটাকে "দ্বিতীয় মস্তিষ্ক” বলা হচ্ছে। এই "দ্বিতীয় মস্তিষ্ক" রয়েছে আমাদের পেটের মধ্যে। অন্ত্রের ভিতরে যে বিশেষ ধরণের স্নায়ুসমূহ রয়েছে তাদের বলা হয় “আন্ত্রিক স্নায়ু ব্যবস্থা”। এতদিন মনে করা হত এটা শুধু অন্ত্রের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যা ভাবা হত এরা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ করে।
“আন্ত্রিক স্নায়ু ব্যবস্থা”-র বিশেষত্ব হচ্ছে এটা পরিপাকতন্ত্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। আসল মস্তিষ্ক থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলেও এটা আপন গতিতে কাজ করে যেতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে পরিপাকতন্ত্র ছাড়া এটা আমাদের মনের ভাব, মেজাজ মর্জি এবং আচরণের ওপরেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমাদের মন ভাল রাখা এবং মনে আনন্দ আনার জন্য ডোপামিন এবং সেরোটোনিন নামের দুটি রাসায়নিক উপাদানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শরীরের অর্ধেক ডোপামিন এবং অধিকাংশ সেরোটোনিন আসলে তৈরি করে অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া। এসব ব্যাকটেরিয়া বিশেষ ধরণের খাবার গ্রহণ করার ইচ্ছা জাগানোর জন্য বার্তাও প্রেরণ করতে পারে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় আমাদের কোন বিশেষ সবজি কিংবা ফল খেতে ইচ্ছে করছে। এর পেছনে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা রয়েছে। সন্দেহ নেই এই পুরো প্রক্রিয়াটি খুব জটিল এবং সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আসল মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের স্নায়ুব্যবস্থার মধ্যে একটি দীর্ঘ বিবর্তনগত যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগটি কেমন কাজ করছে, তার ওপর আমাদের সুস্থতা অনেকটাই নির্ভরশীল। আমাদের খাওয়াদাওয়া যেমন আমাদের মন-মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে, তেমন আমাদের মন-মানসিকতাও খাওয়াদাওয়ার প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে।
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া শুধু ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে না, আমাদের মানসিক অবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলে। যেমন দই একটি উপাদেয় খাদ্য। এতে আমাদের শরীরের জন্য দরকারি অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। দেখা যাচ্ছে দই খেলে মানসিক বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ লাঘব হয়। অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও সহায়তা করে।
এখন মনে করা হচ্ছে ভবিষ্যতে আমাদের অনেক মানসিক সমস্যা এবং আচরণগত জটিলতার চিকিৎসার জন্য “দ্বিতীয় মস্তিষ্কের” দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর সেটা করতে গেলে লক্ষ্য রাখতে হবে অন্ত্রে আমাদের উপকারী বন্ধু ব্যাকটেরিয়াদের অবস্থা কি। অন্ত্রের “ক্ষুদে বন্ধু”রা ভাল থাকলে আমরা সুস্থ থাকি।
তথ্যসূত্রঃ Wang H-X, Wang Y-P. Gut Microbiota-brain Axis. Chinese Medical Journal. 2016;129(19):2373-2380.
No comments:
Post a Comment