শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday 27 May 2014

সঙ্গীত চিকিৎসা


সঙ্গীত শুধু বিনোদনের বিষয় নয়। সঙ্গীতের রোগ নিরাময় করার ক্ষমতাও আছে।

২০১১ সালে ৩২ টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় ৩১৮১ জনের উপরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এখানে দেখা যায় সঙ্গীত দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগ লাঘব করে, বিষণ্ণতা প্রশমন করে। এদের মধ্যে সাতটি পর্যবেক্ষণে দেখা যায় সঙ্গীত ব্যথা উপশম করে এবং ৪ টি পর্যবেক্ষণে হৃদঘাত কমানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় সঙ্গীত জীবনের মান উন্নত করে।

ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া যে কারও জন্য শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক  উৎকণ্ঠার বিষয়। সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসায়  সঙ্গীতের ভূমিকা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ২০১০ সালে ৩০ টি  পর্যবেক্ষণে ১৮৯১ জন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর ওপর সঙ্গীতের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। এখানেও দেখা যায় সঙ্গীত রোগীদের উদ্বেগ প্রশমন করে, মুড ভালো করে এবং সার্বিকভাবে রোগীদের অবস্থা উন্নত করে। আমরা সকলেই জানি ক্যানসারের রোগীদের অনেক সময় অসম্ভব ব্যথা হয়। দুটি গুরুত্বপূর্ণ রিভিউয়ে দেখা যাচ্ছে গান ক্যানসারের ব্যথা উপশমে সক্ষম।

স্ট্রোকের পরে অনেক রোগী বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে। সাধারণত প্রতি তিন জন স্ট্রোকের রোগীর মধ্যে অন্তত একজন উল্লেখযোগ্য বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে। এটা স্ট্রোক নিরাময়ের পথে অন্তরায়। স্ট্রোকের পরে বিষণ্ণতা হলে রোগের জটিলতা বাড়ে, মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিকিৎসকগণ সব সময় আশা করেন যেন স্ট্রোকের পরে কারও বিষণ্ণতা না হয়। এজন্য নানারকম ওষুধ ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করা হয়। যেমন- সাইকো থেরাপি, আকুপাংচার, বৈদ্যুতিক শক, সঙ্গীত ইত্যাদি। সঙ্গীতের সাহায্যে স্ট্রোকের পরে বিষণ্ণতা লাঘবে ভালো উপকার পাওয়া গিয়েছে।

গর্ভবতী মহিলাদের ওপরেও সঙ্গীতের প্রভাব দেখা হয়েছে। দেখা গিয়েছে সুমধুর সঙ্গীত গর্ভবতী মহিলাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। সঙ্গীত আনন্দ দেয়, সেজন্যই এমন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে না। গবেষকগণ মনে করছেন সঙ্গীত কোন কারণে আসলেই রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।   

কিন্তু সঙ্গীত কিভাবে আমাদের সুস্থ করে তোলে? সঙ্গীতের মূল বিষয় শব্দ। আর শব্দের মূলে রয়েছে কম্পন। গবেষকগণ এখন বিভিন্ন ধরণের শব্দ কম্পন নিয়ে পরীক্ষা করছেন। কি ধরণের শব্দ কম্পন কতক্ষণ ব্যবহার করলে কেমন উপকার হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। মনে করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের সঙ্গীতের শব্দ কম্পন শরীরে বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এরই কোন কোনটি আমাদের জন্য উপকারী। তারা মনে করছেন অচিরেই কোন রোগের জন্য কি ধরণের সঙ্গীত কতক্ষণ, কত বার এবং কতদিন শোনা দরকার তা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। তখন চিকিৎসকেরা বিভিন্ন রোগের জন্য প্রেসক্রিপশন আকারে সঙ্গীতের পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন।

তথ্যসূত্রঃ
1. Overview of Systematic Reviews. Evidence-based complementary and alternative medicine: eCAM. 2014;2014:170396. PubMed PMID: 24817897. Pubmed Central PMCID: PMC4003746. 
2. Nabavi SF, Turner A, Dean OM, Sureda A, Nabavi SM. Post-Stroke Depression Therapy: Where are we now? Current neurovascular research. 2014 May 22. PubMed PMID: 24852795. 
3. Zhang JM, Wang P, Yao JX, Zhao L, Davis MP, Walsh D, et al. Music interventions for psychological and physical outcomes in cancer: a systematic review and meta-analysis. Supportive care in cancer: official journal of the Multinational Association of Supportive Care in Cancer. 2012 Dec; 20(12):3043-53. PubMed PMID: 23052912. 
4. Fritz TH, Ciupek M, Kirkland A, Ihme K, Guha A, Hoyer J, et al. Enhanced response to music in pregnancy. Psychophysiology. 2014 May 18. PubMed PMID: 24835575. 
5. Bradt J, Dileo C, Grocke D, Magill L. Music interventions for improving psychological and physical outcomes in cancer patients. The Cochrane database of systematic reviews. 2011 (8):CD006911. PubMed PMID: 21833957.

Sunday 18 May 2014

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য জনসম্পদ

২০০৭ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে জনসম্পদের ওপর অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি জরীপ করা হয়েছিল। এই  জরীপের ফলাফলে দেখা যায় আমাদের প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য- 
  • ৫ জন চিকিৎসক
  • ২ জন নার্স 
  •  ১২ জন হাতুড়ে গ্রাম্য চিকিৎসক
  •  ১১ জন ফার্মেসীর ওষুধ বিক্রেতা
  • ৩৩ জন কবিরাজ বা বৈদ্য
  • ৩২ জন ঝাড়ফুঁক দেওয়ার লোক এবং
  • ৬ জন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আছে

এরা সবাই কম-বেশী বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা দেয় এবং ওষুধের পরামর্শ দেয়।

কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য জনশক্তির সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। যেমনঃ আমাদের দেশে প্রতি ১০০০০ মানুষের জন্য চিকিৎসক, দাঁতের ডাক্তার এবং নার্স আছে সাকুল্যে ৭.৭ জন। শ্রীলংকায় এই সংখ্যা ২১.৯ জন, ভারতে ১৪.৬ জন, পাকিস্তানে ১২.৫ জন। সহস্রাব্দের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে এই সংখ্যা প্রতি ১০০০০ জনগণের জন্য ২৩.০ জন হওয়া উচিত। 
  
আমাদের সেবিকা এবং চিকিৎসকের অনুপাত ২:৫ । অর্থাৎ প্রতি ৫ জন চিকিৎসকের জন্য ২ জন নার্স আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে প্রতি ৩ জন নার্সের জন্য ১ জন চিকিৎসক থাকা উচিত। যে কোন কমিউনিটির জন্য পর্যাপ্ত নার্স থাকা বিশেষ জরুরী। কারণ হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবার প্রাণশক্তি নার্স। আমাদের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টেরও স্বল্পতা রয়েছে। প্রতি ১ জন চিকিৎসকের জন্য ৫ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থাকা উচিত। সার্বিকভাবে এই জরীপে দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশের মানদণ্ডে বিবেচনা করলে আমাদের আরও ৬০,০০০ চিকিৎসক, ২৮০,০০০ নার্স এবং ৪৮৩,০০০ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট দরকার। 


তথ্যসূত্রঃ Ahmed SM, Hossain MA, Rajachowdhury AM, Bhuiya AU. The health workforce crisis in Bangladesh: shortage, inappropriate skill-mix and inequitable distribution. Human resources for health. 2011;9:3.

Wednesday 7 May 2014

যৌনক্ষমতা বাড়ানোর “সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হার্বাল ওষুধ” আসলে কতটুকু নিরাপদ?

পথে-ঘাটে কিংবা বাসে-লঞ্চে চলতে ফিরতে আমরা পুরুষের যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ নিয়ে নানারকম বিজ্ঞাপন দেখি কিংবা হকারদের বক্তৃতা শুনতে পাই। অনলাইনেও পুরুষের “বিশেষ অঙ্গ” দীর্ঘ করার জন্য কিংবা যৌন শক্তি বাড়ানোর জন্য নানারকম প্রচারণা দেখা যায়। এ সব ওষুধে আসলে কি থাকে এবং তা কতটুকু নিরাপদ? 

সম্প্রতি ইতালির কয়েকজন গবেষক এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর অনেক রকম ওষুধ আছে সত্য; কিন্তু এদের অধিকাংশই মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, এমন কি ম্যানিয়া পর্যন্ত হতে পারে।এজন্য তারা পথে ঘাটে কিংবা অন লাইনে বিক্রি হওয়া এসব ওষুধ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে চান। এসকল ওষুধের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। যারা এধরনের ওষুধ সেবন করেন তাদের এমনিতেই মানসিক সমস্যা থাকে; আবার ওষুধ সেবনের ফলে তা আরও বেড়ে যায়। বিগত বছরগুলিতে যৌনক্ষমতাবর্ধক ওষুধ বিক্রির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এদের প্রতিটির গায়েই লেখা থাকে “সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক” কিংবা “হার্বাল”। অতএব কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। অধিকাংশ পুরুষ আরও লম্বা “বিশেষ অঙ্গ” এবং আরও বেশী সময় রমণের আশায় সহজেই এ সকল বাণিজ্যিক প্রচারণার ফাঁদে পড়ছে। এই ধরণের ভিত্তিহীন  প্রচারণা  জনস্বাস্থ্য এবং সুস্থ চিন্তাভাবনার পথে বিশাল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। 

গবেষকদল বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং অনলাইন থেকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১০৮ রকমের যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেছেন। পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে এসবের মধ্যে মূলত ৪ ধরণের ওষুধ থাকেঃ ইওহিম্বিন (yohimbine), ম্যাকা (maca), জিঙ্কো বিলোবা (ginkgo biloba)  এবং হর্নি গোট উইড (horny goat weed )। এই ৪ রকমের ওষুধই আসক্তিসহ উদ্বেগ, প্যানিক, মুডের পরিবর্তন, মানসিক বিভ্রমজাতীয়  মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 

ইওহিম্বিন বিভিন্ন গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে দাবী করা হয়েছে এটা ধ্বজ-ভঙ্গের জন্য কার্যকরী। আবার এ ওষুধ সেবন করলে ওজন কমে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইওহিম্বিনের অনেক রকম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটা সেবন করলে মানসিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগ সৃষ্টি হয়; পরিপাক তন্ত্রের সমস্যা হতে পারে, হৃদঘাত বেড়ে যায় এবং উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।   
ম্যাকা (Lepidium meyenii) এক বিশেষ ধরণের গাছ থেকে সংগৃহীত ওষুধ। এর মূল উপাদান টেট্রাহাইড্রো-বিটা-কারবোলিন। দাবী করা হয় এটা যৌন শক্তি বাড়ায় এবং বন্ধাত্য রোধ করে। কিন্তু টেট্রাহাইড্রো-বিটা-কারবোলিন এমন একটি রাসায়নিক উপাদান যা ক্ষুধা বাড়ায় এবং আসক্তি সৃষ্টি করে। 

হর্নি গোট উইড সেবন করলে মানসিক উন্মত্ততা সৃষ্টি হয়; হৃদপিণ্ডের ছন্দ বিঘ্নিত হয় এবং ত্বকে নানারকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। 

জিঙ্কো বিলোবা স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এটা সুস্থ মানুষের শরীরেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। এ ছাড়া এটা অন্যান্য ওষুধ যেমন অ্যালপ্রাজোলাম, সিটালোপ্রাম ইত্যাদি ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এমন কি মানসিক উন্মত্ততা সৃষ্টি করতে পারে। 

এ চার রকম ওষুধ ছাড়া আরও পাওয়া গিয়েছে হরিণের শিংয়ের চামড়া। কিন্তু এটা সেবন করলে প্রকৃতপক্ষে শরীর ভেঙে যায় এবং নানারকম স্নায়বিক সমস্যা হতে পারে।

মজার বিষয় হচ্ছে এসকল ওষুধ বিক্রির ওপর প্রায় কোনরকম নিয়ন্ত্রণই নাই। যে কেউ যে কোন সময় ইচ্ছে করলেই প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এসব ওষুধ কিনতে পারে এবং  সেবন করতে পারে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে এসকল ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোন হিসেব নিকেশ নাই এবং সেটা নিয়ে কোন জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও নাই। অনেকেই জানেন না যে যৌনক্ষমতা বাড়ানোর “সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হার্বাল” ওষুধের নামে তারা যা সেবন করছেন, সেগুলির মধ্যে অনেক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান রয়েছে এবং এসকল ওষুধও অন্যান্য অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এসকল ওষুধের কোন প্রকার মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকার ফলে অনেক সময় এর মধ্যে আসলে কি উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা আদৌ কোন ওষুধ আছে কিনা সে সম্পর্কেও কোন কিছু জানা যায় না। 

তথ্যসূত্রঃ American Psychiatric Association's 2014 Annual Meeting. Abstract NR4-44. Presented  May 4, 2014.