শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday, 30 June 2015

ক্যানসার রোগীদের জীবন মানের ওপর ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা

সম্প্রতি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে ক্যানসার রোগীদের জীবন মানের (Quality of life) ওপরে আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিকতার প্রভাব নিয়ে চমৎকার একটি পর্যবেক্ষণের ফলাফল উপস্থাপিত হয়েছে। 

আমরা সবাই জানি কারও ক্যানসার রোগ ধরা পড়া একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। একমাত্র ভুক্তভোগী ব্যক্তি ছাড়া এর ভয়াবহতা অন্য কারও পক্ষে আসলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। স্বভাবতই ক্যানসার রোগ শনাক্ত হওয়ার পরে অনেকেই ধর্মকর্ম  কিংবা আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। গবেষকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্যানসার রোগীদের এই ক্রান্তিকালে  আধ্যাত্মিকতা এবং ধার্মিকতা কিভাবে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলিকে প্রভাবিত করে সেটা পর্যবেক্ষণ করা। সর্বমোট ৫৫১ জন ক্যানসার রোগীর ওপর ১ বছর যাবত এই পর্যবেক্ষনটি করা হয়। মার্কিন ন্যাশনাল ক্যানসার ইন্সটিটিউটের সংজ্ঞা অনুসারে আধ্যাত্মিকতা (spirituality) বলতে একজন ব্যক্তির মানসিক প্রশান্তির অনুভূতি বা জীবনের উদ্দেশ্য এবং সামগ্রিকভাবে জীবনের অর্থ সম্পর্কে উপলব্ধিকে বোঝানো হয়ে থাকে। আর কোন বিশেষ বিশ্বাস এবং আচার-আচরন পালনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা অর্জনের পথকে ধার্মিকতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সংজ্ঞানুসারে কেউ ধার্মিক না হলেও আধ্যাত্মিক হতে পারেন; আবার কেউ ধার্মিক হলেও আধ্যাত্মিকতা নাও অর্জন পারেন।
  
গবেষকগণ ক্যানসার রোগীদের চারটি গ্রুপে ভাগ করেছেনঃ ১) কম আধ্যাত্মিক এবং কম ধার্মিক ২) অধিক আধ্যাত্মিক এবং অধিক ধার্মিক ৩) অধিক আধ্যাত্মিক এবং কম ধার্মিক ৪) কম আধ্যাত্মিক এবং অধিক ধার্মিক। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যখন এই সকল ক্যানসারের রোগীরা চিকিৎসা গ্রহণ করছিলেন তখন তাদের শারীরিক এবং মানসিক জীবন মান সম্পর্কে  বিভিন্ন তথ্য আহরণ করা হয়। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, যারা অধিক ধার্মিক এবং অধিক আধ্যাত্মিক তাদের শারীরিক এবং মানসিক জীবন মান ভালো ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে যারা অধিক ধার্মিক কিন্তু কম আধ্যাত্মিক তাদের পরিস্থিতি কিন্তু তত ভালো নয়।  গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, এর ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে শুধু ধার্মিকতা নয়; আধ্যাত্মিক হওয়ার মাধ্যমেই আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবন মান তথা সামগ্রিক প্রশান্তি বজায় রাখতে পারি। 

উল্লেখ্য ইদানীং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। ক্যানসার রোগীদের ওপর ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন ভিন্নতর প্রভাব দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, কেন এমন ফলাফল পাওয়া গেল? 

এক কথায় আমরা এর উত্তর জানিনা। 

তবে অনেকে মনে করছেন ধার্মিকতা যদি ব্যক্তির জীবনে বাহ্যিক হয়ে থাকে এবং তার জীবন বোধের সঙ্গে যদি আত্মস্থ না হয়, তা হলে সেটা ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক পরিস্থিতির ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার উৎস অন্তর থেকে; এটা মানুষের শরীর ও মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং অপার্থিব শক্তির ওপর গভীর আস্থা তার মনে অনাবিল প্রশান্তি এবং স্বস্থির মনোভাব সৃষ্টি করে। এজন্য ক্যানসার রোগীদের প্রান্তিক সময়টিকে শান্তিময় করে তোলার উদ্দেশে আধ্যাত্মিকতার উপযুক্ত  প্রয়োগের ওপরেই সকলে জোর দিচ্ছেন।  ধার্মিকতা কিংবা আধ্যাত্মিকতা হয়তো ক্যানসার রোগীর মূল চিকিৎসায় কোন পার্থক্য সৃষ্টি করবে না; কিন্তু ক্যানসার রোগীর ক্রান্তিকালীন সময়কে প্রশান্তিময় এবং সহনশীল করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ধার্মিক ব্যক্তিদের নিকট এই গবেষণার ফলাফল হয়তো তেমন নতুন কিছু মনে হবে না; তবে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগে ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার প্রভাব সম্পর্কে এ পর্যন্ত পরিচালিত এটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য।  

তথ্যসূত্রঃ 
Cannon AJ, Garcia J, Loberiza FR. Interplay between spirituality and religiosity on the physical and mental well-being of cancer survivors post-treatment. Program and abstracts of the 168th American Psychiatric Association Annual Meeting; May 16-20, 2015; Toronto, Ontario, Canada. Abstract 63.
Pew Research Group. America's changing religious landscape. http://www.pewforum.org/2015/05/12/americas-changing-religious-landscape/ Accessed June 30, 2015.


Friday, 12 June 2015

বেদনানাশক ওষুধ নরহত্যার প্রবণতা বাড়ায়

একটু অবাক হওয়ার মতোই তথ্য। এতদিন ধারণা করা হতো মানসিক রোগের জন্য সাইকোট্রপিক ওষুধ খেলে অনেকের বিপজ্জনক আচরণের সম্ভাবনা থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে বিষণ্ণতা রোধক ওষুধ, বেনজোডায়াজেপিন এবং বিভিন্ন ধরণের ব্যাথানাশক ওষুধ খেলে নরহত্যার মতো মারাত্মক প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।

সুইডেনের একদল গবেষকের পর্যবেক্ষণে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিষণ্ণতারোধক ওষুধ ব্যবহার করলে আসলেই নরহত্যার প্রবণতা বাড়ে কিনা তা দেখার জন্য সুইডিশ গবেষকগণ ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৯৫৯ জন নরঘাতক দাগী আসামীর ওপর পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর এদের সঙ্গে তুলনা করার জন্য বেঁচে নেওয়া হয়েছে প্রায় দশ হাজার সাধারণ নাগরিককে। ১৯৯৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এদের সকলের ওষুধ ব্যবহারের ইতিহাস খুব ভালোভাবে পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে।

ফলফলে দেখা যাচ্ছে বিষণ্ণতা রোধক ওষুধ ব্যবহারে নরহত্যার প্রবণতা ৩১% এবং বেনজোডায়াজেপিনে ৪৫% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে নারকোটিক এনং নন-নারকোটিক বেদনানাশক ওষুধ ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই প্রবণতা দুই  থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু যে অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ নিয়ে আমাদের এত আশংকা,সেটার ব্যবহারের সঙ্গে আসলে নরহত্যার প্রবণতার জোরালো কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।

সুতরাং গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের অপরাধ করার ইতিহাস রয়েছে তাদের চিকিৎসার সময় বেদনানাশক ওষুধ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।


তথ্যসূত্রঃ 
Tiihonen J, Lehti M, Aaltonen M, et al.: Psychotropic drugs and homicide: A prospective cohort study from Finland. World Psychiatry 2015; 14:245-47

Thursday, 11 June 2015

দীর্ঘদিন প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বহুল ব্যবহৃত ওষুধ। আজকাল প্রেসক্রিপশন ছাড়াও এটা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি পর্যবেক্ষণের ফলাফলে রক্তনালীর ওপর এর বিরূপ প্রভাবের গুরুতর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। 
ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক ২৯ লাখ রোগীর ১৬ মিলিয়ন ক্লিনিকাল ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করার পরে এই ফলাফল দেখতে পেয়েছেন। তবে এইচ টু ব্লকার জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ার কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
বিশেষত গ্যাস্ট্রো-এসফেজিয়াল রিফ্লাক্সের জন্য যারা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করেছেন তাদের  হার্ট অ্যাটাকের হার ১৬% বেশী। হৃদরোগের কারণে মৃত্যুহারও এদের দ্বিগুণ।
স্বভাবতই প্রশ্ন এসেছে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে কেন এটা ঘটছে?
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যারা ক্লোপিডেগ্রলের সঙ্গে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাবের প্রমাণ আগেও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে শুধু হৃদরোগী নয়, কম বয়সী সাধারণ মানুষও প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে হৃদরোগের শিকার হতে পারেন।  প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর  ডাইমিথাইল আর্জিনেজ (DDAH) নামে পরিচিত একটি এনজাইমের কাজ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই এনজাইমটি রক্তনালীর সুস্থতার জন্য দরকারী। প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের এই ক্ষতিকারক প্রভাব যে কোন মানুষের রক্তনালীর ওপরেই পড়তে পারে। 
ওষুধ হিসেবে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর খুবই কার্যকরী। কিন্তু এটা আজকাল খুবই সুলভ এবং সহজলভ্য হওয়ার কারণে অনেকেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এটা ব্যবহার করে থাকেন। এজন্য অনেকেই প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহারে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের দরকার বলে মনে করছেন। অবশ্য এ বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে গবেষকগণ  প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। 


তথ্যসূত্রঃ 
Shah NH, LePendu P, Bauer-Mehren A, Ghebremariam YT, Iyer SV, et al. (2015) Proton Pump Inhibitor Usage and the Risk of Myocardial Infarction in the General Population. PLoS ONE 10(6): e0124653.

Wednesday, 3 June 2015

কাজের ফাঁকে ফেসবুক দেখতে এত মজা কেন?

যারা সারাদিন কম্পিউটারে কাজ করেন তারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা অন্যমনস্ক হয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে ২০১১ সালে একটি জরীপে ৫৩% মানুষ স্বীকার করেছিলেন যে তারা প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সময় অন্যমনস্ক হয়ে নষ্ট করেছেন। বর্তমান সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে সময় ব্যয় করার একটি প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। অনেকে স্বীকার করতে না চাইলেও কাজের ফাঁকে ফেসবুক দেখার পেছনে কারণ রয়েছে। একটি নতুন পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে আমাদের বিশ্রামরত মস্তিস্ক অথবা মস্তিস্ক যখন একটু বিরতি চায় তখন তা আপনাআপনি এমন একটি অবস্থায় চলে যায় যা মূলত সামাজিক সম্পর্কের জন্য কাজ করে।
মজার বিষয় হচ্ছে আমরা যখন কোন কাজ করি না, তখনও কিন্তু মস্তিস্কের কার্যক্রম বন্ধ থাকে না। নানারকম এলেবেলে চিন্তা-ভাবনা মাথার ভেতরে চলতেই থাকে। ১৯৯০-এর দশকে এর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মিললেও; মস্তিস্কের এমন আচরণের কারণ জানা যায়নি। তবে দেখা যাচ্ছে অলস মস্তিস্ক সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাবতে বা চিন্তা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এজন্য আমরা কাজের ভিড়ে একটু ফুরসৎ পেলেই ফেসবুকের টাইম লাইনে পরিচিত বন্ধু-বান্ধব এবং স্বজনদের ছবি কিংবা কাজকর্ম দেখতে ভালোবাসি । মস্তিস্কের কোন অংশ আমাদের কোন ধরণের মানসিক অবস্থায় কাজ করছে তা দেখার জন্য আজকাল ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) ব্যবহার করা হয়। এর সাহায্যে বিভিন্ন মানসিক পরিস্থিতিতে মস্তিস্কের কোন অংশ উদ্দীপিত হচ্ছে তা শনাক্ত করা যায়। এর ভিত্তিতে পরীক্ষা করেই গবেষকগণ এখন বলছেন, “মস্তিস্ককে নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত রাখা একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া। মস্তিস্ক যখনই ছুটি পায় তখন সে তার ডিফল্ট মোডে চলে যায়। আর সেটি আসলে সামাজিক কার্যকলাপে অংশ নেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এজন্যই ফেসবুকের প্রতি আমাদের এমন আকর্ষণ”। সে অর্থে এটাকে অস্বাভাবিক বলে গণ্য করা যাচ্ছে না। বরং কাজের ফাঁকেও যারা এমন করেন না তাদের মস্তিস্কের স্বাভাবিকতা নিয়েও অনেকে একটু আধটু সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
তথ্যসূত্রঃ  Spunt RP, Meyer ML, Lieberman MD. The default mode of human brain function primes the intentional stance. Journal of Cognitive Neuroscience. 2015 Jun; 27(6):1116-24.