বলা হয় “একটা মন ভাঙা আর উপাসনালয়
ভাঙা একই কথা”। সিনেমা কিংবা সাহিত্যে “ব্রোকেন হার্ট” রীতিমত একটি স্থায়ী আসন পেয়ে গিয়েছে। “ব্রোকেন হার্ট” বললেই আমাদের চোখের সামনে দেবদাসের মতো অনেক রোমান্টিক মুভির
চিত্র ভেসে ওঠে। কিন্তু
ধীরে ধীরে চিকিৎসা শাস্ত্রেও “ব্রোকেন হার্ট”
একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিচ্ছে।
যেকোনো মানসিক বিপর্যয়ের মুখে আসলেই অনেক সময় অনেকের “হৃদয় ভেঙ্গে
যায়” বা “হার্ট ব্রেক” হয়। কিন্তু
এর ফলে কি আসলে কেউ মারা যেতে পারে?
এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসার আগে একটু কিছু সাম্প্রতিক গবেষণার
ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। গত
দুই দশক যাবত দেখা যাচ্ছে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে।
অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হচ্ছে হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের একধরণের
ছন্দ পতন। এর ফলে
হৃদপিণ্ডের উপরের প্রকোষ্ঠ বা অলিন্দ ছন্দবিহীন অনিয়মিত গতিতে স্পন্দিত হতে থাকে।
পশ্চিমা দেশ গুলোতে একটু বয়স হলেই মানুষের অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন
হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
বলাবাহুল্য হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন মানেই বিপদ।
যাদের অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হয় তাদের স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের
পক্ষাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বেশী; আর মরে যাওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।
ইউরোপে প্রতি বছর সোয়া লাখ থেকে আড়াই লাখ মানুষের অ্যাট্রিয়াল
ফিব্রিলেশন ধরা পড়ে। ধারণা
করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু ইউরোপেই ১৪ থেকে ১৭ মিলিয়ন মানুষের অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন
হবে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১০ সালে পাঁচ মিলিয়নের বেশী মানুষের অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হয়েছে।
২০৩০ সাল নাগাদ তা বেড়ে ১২ মিলিয়নের ওপরে যাবে।
অনুমান করা যায় এর ফলে কি ব্যাপক সংখ্যক মানুষ স্ট্রোক এবং মৃত্যুর ঝুঁকির
মুখে থাকবে। কিন্তু
সমস্যা হচ্ছে এদের অধিকাংশেরই অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
এর পিছনে বংশগতি এবং পরিবেশের ভূমিকা রয়েছে।
কারও অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন আচমকা শুরু হয়; কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তা চলতেই থাকে বা ক্রনিক রূপ ধারন করে।
নানাধরণের অসুখবিসুখ, ক্লান্তি,
মদ-সিগারেট, চা-কফি কিংবা মানসিক উদ্বেগের কারণে কারও হৃদপিন্ডে ক্রনিক অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে শোক
কিংবা বিচ্ছেদের সঙ্গে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন এবং ব্রোকেন হার্টের
সম্পর্ক কি?
দেখা যাচ্ছে এদের
মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ডেনমার্কের সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা
যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন মারা গেলে কিংবা দীর্ঘদিনের সঙ্গীদের একজন মারা
গেলে অপরজনের মধ্যে শোকের কারণে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। এই অবস্থা অন্তত মৃত্যুর
পরবর্তী একবছর পর্যন্ত থাকে।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত
ডেনমার্কের হাসপাতালের প্রায় নব্বই হাজার রোগীর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা হয়েছে। তাতে
দেখা যায় ওই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রতি পাঁচ জনের অন্তত একজন তার সঙ্গী
কিংবা সঙ্গিনীকে হারিয়েছে। তুলনা করার জন্য ওই সময়ে হাসপাতালের বাইরের প্রায় নয়
লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ফলাফলে দেখা
যাচ্ছে দম্পতিদের একজনের মৃত্যুর পরবর্তী একমাসের মধ্যে অন্যজনের অ্যাট্রিয়াল
ফিব্রিলেশন হওয়ার আশংকা আসলেই অনেক
বেড়ে যায়। সাধারনত পার্টনারের মৃত্যুর পরের দুই সপ্তাহে এ সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।
স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে এক বছর লেগে যায়। যাদের বয়স ষাটের ওপরে তাদের
মধ্যে এটার সম্ভাবনা আরও বেশী। এর আগে এত বেশী মানুষের ওপরে অ্যাট্রিয়াল
ফিব্রিলেশন নিয়ে এত নির্ভরযোগ্য
পর্যবেক্ষণ আর কখনও করা হয়নি। তাই এই ফলাফলকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। এবং
ব্রোকেন হার্টের কারণে মৃত্যুর সঙ্গে এটা সম্পর্কিত বিবেচনা করা হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে
ব্রোকেন হার্টের প্রসঙ্গ এসেছে বিগত ২৫ বছর যাবত।ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলা হয় “stressinduced cardiomyopathy” বা “Takotsubo cardiomyopathy”। ১৯৯০ সালে জাপানে প্রথম এটা
শনাক্ত করা হয়েছিল। জাপানী ভাষায় অক্টোপাস ধরার পাত্রকে “টাকোতসুবো” বলা হয়।
অনেকটা আমাদের পরিচিত দইয়ের খুঁটি বা পাত্রের মতো। ইকোকার্ডিওগ্রাম করলে ব্রোকেন হার্টের রোগীর
হৃদপিণ্ড অনেকটা “টাকোতসুবোর” মতই দেখা যায়। এজন্য এটার নাম দেওয়া হয়েছিল
“টাকোতসুবো সিনড্রোম”। প্রথমে জাপানে শনাক্ত হলেও এখন দুনিয়াজুড়ে সব জায়গাতেই
ব্রোকেন হার্ট বা “টাকোতসুবো সিন্ড্রোমের” রোগী পাওয়া যাচ্ছে। সাধারনত প্রিয়জনের
মৃত্যুর পরে সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনী সহসা হার্ট অ্যাটাকের মতোই তীব্র বুকে ব্যাথা, শ্বাস
কষ্ট এবং অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে। অনেকের রক্ত পরীক্ষা করলে
হার্ট অ্যাটাকের প্রমাণও পাওয়া যায়। একমাত্র ইকো এবং করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করলেই
এটাকে সাধারণ হার্ট অ্যাটাক থেকে পৃথক করা সম্ভব হয়। প্রকৃতপক্ষে এখন দেখা যাচ্ছে “টাকোতসুবো
সিন্ড্রোমের” হার একেবারে কম নয়; আর ব্রোকেন হার্টের রোগীদের প্রতি দশ জনের নয়জনই
মহিলা। তীব্র মানসিক উদ্বেগ, বিচ্ছেদ যন্ত্রণা কিংবা গুরুতর বিপর্যয়ের পরে ব্রোকেন
হার্ট হয় সত্য; কিন্তু এর আসল কারণ কি কিংবা কেন এটা হচ্ছে তা এখনও পরিস্কার নয়।
তবে এধরণের মানসিক পরিস্থিতিতে আমাদের শরীরে অতিরিক্ত স্ট্রেস হরমোন নিঃসরিত হয়।
এটা কোনোভাবে হৃদপেশীকে দুর্বল করে দেওয়ার ফলে এমন ঘটনা ঘটছে বলে অনেকে মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি
কথা না বললেই নয়। শুধু তীব্র শোক কিংবা বিচ্ছেদের ফলে যে ব্রোকেন হার্ট হয়, তা ঠিক
নয়। অতিরিক্ত উৎফুল্ল কিংবা আনন্দের ফলেও কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাকে বলা
যায় “হ্যাপি হার্ট সিনড্রোম”। যেমন দেখা যায় নাতি-নাতনির জন্মের আনন্দের পরে কিংবা
তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় নিজের দল বিজয়ী হলে অনেকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়।
দীর্ঘ মেয়াদে
ব্রোকেন হার্টের পরিণতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা এখনও তেমন স্বচ্ছ নয়। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে শনাক্ত হলে “টাকোতসুবো সিন্ড্রোম” চিকিৎসার সাহায্যে নিরাময়
করা সম্ভব।যাহোক শোক-বিচ্ছেদ বেদনায় আমাদের মন এবং হৃদপিণ্ড আক্ষরিক অর্থেই ভাঙতে
পারে এবং অনেক সময় তা আসলেই বিপজ্জনক হতে পারে।