অস্ট্রেলিয়ার একটি ছোট রাজ্য ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়ার মাঝে প্রায় সমতল বরেন্দ্রভূমির মতো লাল জমিনের বিশাল এক জনপদের নাম জিপসল্যান্ড। বিস্তীর্ণ মাঠের পর মাঠ জুড়ে সবুজ কোমল ঘাস আর ঘাস। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিনমান চড়ে বেড়ায় বিশাল বপুর গরু এবং ভেড়া। ওদের ঠিকঠাক মতো দেখে রাখার জন্য চোখে পড়বে দুয়েকটা কিম্ভুত চেহারার কুকুর। আর কোথাও কোথাও রঙিন কার্পেটের মতো বিছানো নানারকম ফসলের মাঠ। মাইলের পর মাইল গেলেও অনেক সময় একজন মানুষ চোখে পড়ে না।
এমন এক বিরল জনপদে অনেক দিন আগে গ্রীস থেকে বাইশ বছরের এক টগবগে তরুণ অ্যাডাম হিক কেন এসেছিল তা আসলে অনুসন্ধানের বিষয়। তবে জিপসল্যান্ড তখনি একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। বিশেষ করে দুধ-পনীর এবং দুগ্ধজাত আরও নানারকম পণ্যের পসরা এদিকের হাটে হাটে । অচিরেই অ্যাডাম অনেক গরু-ভেড়াসহ বিশাল জমিনের মালিক হয়ে গেল। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে সপ্তাহান্তে মফঃস্বলের ছোট শহর ট্রাফালগারের বাজারের একটি রেস্টুরেন্ট কাম বারে বসে
কয়েক গ্লাস মদ পান করা ছিল অ্যাডামের বিনোদন। বারের পাশেই ছোট একটু মঞ্চ ছিল।
ওখানে শুক্রবার-শনিবার মাঝরাত পর্যন্ত নাচগান হতো। গান বলতে গিটারে কান্ট্রি
মিউজিক। তার সঙ্গে মিল রেখে নাচ। তখন নাচ-গান করার মতো মহিলা জিপসল্যান্ডে
আসলে তেমন ছিল না। এক সময় অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ব্রিটেনের
অনেক চাকরানি-ধোপীদের ছোট-খাটো চুরি চামারির অপরাধে গুরুতর শাস্তি হিসেবে
দ্বীপান্তর দিয়ে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হতো। তারা এসে প্রথমে ভিড়ত তাসমানিয়ার
গারদে। সেখান থেকে ভাল আচরণের পুরস্কার হিসেবে তাদেরকে বিভিন্ন স্থানে চাকরী কিংবা
জমি দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এভাবে জিপসল্যান্ডের এই ছোট রেস্টুরেন্টটিতেও কয়েকটি
মেয়ে এসেছিল। এদের ভেতরে ব্লন্ড চুলের এক নীল নয়না সুন্দরী স্পেনের মেয়ে রোজা যেন কিভাবে এসে জুটেছিল।
রোজা সুন্দরী, আবার ভাল গান গায় এবং নাচে। তাই অনেকের নজর ছিল তার দিকে।
কিন্তু রোজা কাউকে তখনও তেমন কেয়ার করতো না। গ্রীসের পুরুষেরা দেখতে
সুন্দর।অ্যাডাম হিকের চেহারাও দেখতে দেবতার মতো। কিন্তু সে কথা বলত কম, নাচের আসরেও তাকে তেমন দেখা যেত না। তবে অ্যাডাম যখন
বারে আসতো স্প্যানিস মেয়ে রোজাকেই মদের গ্লাস হাতে তার দিকে যেতে দেখা যেত। এছাড়া আর কেউ কিছু তাদের সম্পর্কে বলতে পারে না। এমনভাবে কোন এক বৃষ্টি ভেজা
রাতে ওদের দুজনকে নাচের আসরে দেখা গেল। বৃষ্টির কারণে কিংবা অন্য কোন
কারণে সেদিন নাচের তেমন কেউ ছিল না। অন্যদিনের চেয়ে সেদিন তারা দুজনেই মনে হয় একটু
বেশীই পান করে ফেলেছিল। কারণ নাচের শেষে দেখা গেল কঠিন মেয়ে রোজা হিকের স্কন্ধে
মাথা রেখে আসলে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং নিরুপায় অ্যাডাম তাকে কোলে করে নিয়ে নিজের গাড়ীতে
তুলছে।
পরদিন দুপুরে রোজার যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে নিজেকে অ্যাডামের বাসার শয্যায়
আবিস্কার করলেও সে খুব যে বিব্রত হয়েছে তা মনে হলোনা। এরপর আসলে দীর্ঘ ঊনষাট বছর সেটাই হয়ে গেল তার নিজের শয্যা। আর পাশের দুটি
কক্ষে একে একে পাতা হয়েছে তাদের দুই কন্যা এবং এক পুত্রের শয্যা। কন্যা দুটি বড়
হয়ে বিবাহসূত্রে অন্যত্র চলে গিয়েছে। সঙ্গে আছে একমাত্র পুত্র গ্রাহাম।
ঊনষাট বছরের দাম্পত্য জীবনের শেষে প্যানক্রিয়াসের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে
ক্ষান্ত দিয়ে রোজা যেদিন ওপারে চলে যায় তার পরের সপ্তাহ থেকে আবার অ্যাডামকে সেই
পুরনো রেস্টুরেন্ট কাম বারটিতে দেখা যেত। অবশ্য তার এখন বয়স হয়েছে। কিন্তু সে মোটামুটি
সুস্থ জীবনই যাপন করতো। একমাত্র ছেলে গ্রাহাম স্থানীয় একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরী
করে। সে বিয়ে শাদী না করায় বাড়ীতে শুধু বাপ বেটা দুজনে থাকতো। গ্রাহাম সকাল বেলা
অফিসে চলে গেলে অ্যাডাম ট্রাক্টর নিয়ে মাঠের দিকে বের হয়ে পড়তো। গ্রাহাম তাকে
প্রতিদিনই মানা করতো। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই অ্যাডাম ছিল কাজের মানুষ। আর এজন্যই
তার আজ এত বিশাল সহায়সম্পত্তি। অবশ্য পয়মন্ত রোজার কারণে এত দীর্ঘ সময় এটা তার
পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাই রোজার মৃত্যুর পরে অ্যাডামকে একা একা বাড়ীতে খুব
কমই দেখা যেত। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা সময়ে অসময়ে বিরান বিশাল ফসলের মাঠে কি হয় না হয়
এর জন্য গ্রাহামের চিন্তার অন্ত ছিল না।
তাই ট্রাক্টর নিয়ে বের হলেও গ্রাহাম অন্তত দুই তিনবার ফোন করে হিকের খবর নিত।
সেদিন সকালেও গ্রাহাম যথারীতি অফিসে বের হয়ে গিয়েছে। আর অ্যাডাম ধীরেসুস্থে
তার ট্রাক্টর নিয়ে মাঠের দিকে। আসলে তার সমস্ত জমি একটি সমবায়ের লোকজনই আজকাল
চাষবাস করে। কিন্তু সময় কাটানোর জন্য অ্যাডাম ট্রাক্টর নিয়ে এটা সেটা করতো। সেদিনও
তাই করছিল। মাঠের শেষপ্রান্তে একটি উঁচু টিলার মতো আছে। অনেকদিন ট্রাক্টর চালানোর
অভ্যাস অ্যাডামের। ওই টিলার ওপর দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে
যেতে সে বিশেষ আনন্দ পেত। আজও তাই যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ কেন যেন ট্রাক্টরের চাকা একটি
পাথরের ওপর উঠে গেল এবং তাল সামলাতে না পেরে ওটা একদিকে কাত হয়ে গেল। অ্যাডাম ব্রেক করার আগেই তা উলটে টিলার ঢালে পড়ে গেল। আগে হলে অ্যাডাম হয়তো সামলে নিত। কিন্তু আজ সে সোজা ট্রাক্টরের নীচে
পড়ে গেল। বৃদ্ধ বয়সে অ্যাডাম আর ট্র্যাক্টরের
ভার সইতে পারলো না। উলটে যাওয়ার ফলে ট্রাক্টরের বিশাল দু
চাকা ঊর্ধ্ব পানে চরকির মতো ঘুরতে থাকলো। আর নীচে চাপা পড়ে অ্যাডাম ক্ষীণস্বরে “হেল্প হেল্প” বলে চিৎকার করলেও বিস্তীর্ণ শূন্য মাঠে
সে ডাক কারও কানে গেল না।
অফিসে গ্রাহাম সেদিন একটু বেশী কাজের ভিড়ে ছিল। অন্যদিন মাঝেমধ্যেই সে ফোন করতো। আজ লাঞ্চ ব্রেকে খেতে বসে যখন ফোন করলো
তখন অপর দিকে অ্যাডামের কোন গলা শোনা গেল না। গ্রাহাম আবার ফোন করলো। রিং বাজছে কিন্তু কেউ ধরছে না। কয়েকবার ফোন করার পরেও যখন অ্যাডাম ধরল না, তখন সে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। দেরী না করে বাসার দিকে গাড়ী নিয়ে রওয়ানা হল। কিন্তু বাসায় তখনও কেউ নেই। এদিক খুঁজে দেখতে পেলো বাসার সামনে
ট্রাক্টরটি নেই। তার মানে অ্যাডাম নিশ্চয় ট্রাক্টর নিয়ে
বের হয়েছে। সে এবার মাঠের দিকে রওয়ানা হল। কিন্তু মাঠ পুরোই ফাঁকা। হঠাৎ দেখতে পেলো দূরে টিলার পিছনে ট্রাক্টরের
চাকা ওপর দিকে উলটে আছে। সে দৌড় দিয়ে কাছে যেতেই চোখে পড়লো ট্রাক্টরের
নীচে স্থির অ্যাডামের দেহ। ট্রাক্টরের তেলের ট্যাংক থেকে তেল গড়িয়ে
পড়ছে। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে মনে হয় অনেক
আগেই। চাকাগুলোও স্থির।
(স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রীর নাম পরিবর্তিত)
Sunday, 24 April 2016
No comments:
Post a Comment