সব রোগ রোগ নয়; অনেক সময় তা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জীবনের অংশ। কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম(computer vision syndrome) আসলে তেমন একটি সমস্যা। চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ কোন কারণে সৃষ্ট একাধিক লক্ষণ-উপসর্গের সমষ্টিকে সিনড্রোম বলা হয়। কোন কোন সিনড্রোমের নাম এসেছে যে অঙ্গে রোগটি হয় তার নাম থেকে। যেমন- কার্পাল টানেল সিনড্রোম। কব্জির সামনে কার্পাল টানেলে মিডিয়ান নার্ভ অতিরিক্ত চাপের কারণে এটা হয়। ডাউনস সিনড্রোমের নাম এসেছে ব্রিটিশ চিকিৎসক ডাঃ জন ল্যাঙ ডন ডাউন-এর নাম থেকে। ১৮৬২ সালে তিনি এই বংশগত রোগটির প্রথম বর্ণনা দিয়েছিলেন। আবার অনেক সিনড্রোমের নাম এসেছে সমস্যার বর্ণনা থেকে। যেমন- রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম। তবে অনেক সময় নামের সঙ্গে সিনড্রোমের বর্ণনার মিল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিধানে ছয়শ’য়ের বেশী সিনড্রোমের নাম রয়েছে। তার সঙ্গে অধুনা নতুন যুক্ত হয়েছে “কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম”। প্রশ্ন হচ্ছে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম আসলে কি? আজকাল যারা দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করেন তারা চোখের বিভিন্নরকম সমস্যার কথা বলেন; যেমন- চোখের পানি শুকিয়ে যায়, দৃষ্টি ঝাপসা মনে হয়, চোখে জ্বালাপোড়া করে ইত্যাদি।অনেকের সমস্যার তীব্রতা এতই বেশী হয় যে তারা আর কম্পিউটারে কাজ করতে পারেন না।
অনুমান করা হচ্ছে পৃথিবীতে এখন ৭ কোটি মানুষের কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি আছে। লেখাপড়া, কর্মক্ষেত্র এবং বিনোদনের জন্য যেভাবে কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। গবেষকদের মতে যারা প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কম্পিউটার নিয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন এ ধরণের এক বা একাধিক লক্ষণ-উপসর্গের অভিযোগ করেন। এসব ছাড়া ঘাড়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি ধরণের সমস্যা তো রয়েছেই। এসব কিছু মিলে কম্পিউটার নিয়ে বেশী কাজ করা অনেকের জন্য আসলেই এক সমস্যা।
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম কেন হচ্ছে তা নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে মোদ্দা কথা হচ্ছেঃ
• কম্পিউটারের অক্ষর এবং ছবি পিক্সেল দিয়ে তৈরি। এর কিনারা ঝাপসা থাকে। এজন্য কাগজে ছাপা অক্ষর কিংবা ছবি পড়ার চেয়ে কম্পিউটারের অক্ষর এবং ছবি পড়তে চোখের ওপর বেশী চাপ পড়ে। ক্রমাগত এরকম অতিরিক্ত চাপের কারণে চোখের উপসর্গসমূহ সৃষ্টি হয়।
• চোখের পলক পড়ার হার কমে যাওয়া আরেকটি সমস্যা। কেউ যখন একটানা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে থাকে তখন তার চোখের পলক পড়া কমে যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রতি মিনিটে একজন মানুষের অন্তত ১৭ বার চোখের পলক পড়ে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করার সময় এটা কমে মিনিটে ১২ থেকে ১৫ বারে নেমে আসে। চোখের পলক পড়া কমে গেলে চোখের পানির প্রবাহ কমে যায় এবং চোখে শুষ্কতা অনুভূত হয়।
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম প্রতিরোধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে; যেমন-
• কাজের সময় কম্পিউটারের খুব নিকটে বসা ঠিক নয়। সাধারণত চোখ থেকে কম্পিউটার স্ক্রিনের দূরত্ব অন্তত দুই ফুট হওয়া উচিত।
• কম্পিউটার মনিটরের অবস্থানঃ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে কম্পিউটারের মনিটর চোখ থেকে ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি নীচে থাকা উচিত। নীচের দিকে তাকিয়ে কাজ করলে চোখের দুই পাতার মধ্যে ব্যবধান কম থাকে। ফলে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে।
• কম্পিউটার স্ক্রিনের কনট্রাস্টঃ এটা এমনভাবে সেট করা উচিত যেন চোখের ওপর কম চাপ পড়ে।উজ্জ্বল সাদা স্ক্রিনে কালো অক্ষরই এজন্য উপযুক্ত।
• কম্পিউটারের মনিটরে আলোর ঝলমলে ভাব কমানোঃ ঘরে উজ্জ্বল আলো ব্যবহার না করলে এবং জানালা দিয়ে কম আলো আসতে দিলে, মনিটরের আলো স্তিমিত রাখলে এবং বিশেষ ধরণের চশমা পরলে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
• মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়াঃ এজন্য ২০-২০-২০ সূত্র অনুসরণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রতি ২০ মিনিট কাজ করার পরে ২০ সেকেন্ড বিরতি নিতে হবে এবং এই সময়ে ২০ ফুট দূরে তাকাতে হবে। এরসঙ্গে ঘাড় এবং কাঁধের হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে।
• অক্ষরের ফন্ট বড় রাখাঃ অক্ষরের বড় ফন্ট ব্যবহার করলে চোখের ওপর চাপ কম পড়ে।
• চোখের পানি যেন শুকিয়ে না যায় সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মতো চোখের পলক ফেলতে হবে। তারপরেও যদি চোখ শুকিয়ে যায়, তাহলে চোখের জন্য কৃত্রিম চোখের পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এজন্য একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
• নিয়মিত চোখের চোখের চেক-আপ করানো জরুরী। যাদের চোখে রি-ফ্র্যাকসনের সমস্যা আছে তাদের অবশ্যই সঠিক চশমা পরে কম্পিউটারে কাজ করতে হবে। এজন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করাতে হবে এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সৃষ্ট নতুন ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমাদের এধরণের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া নতুন নয়। একে অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
No comments:
Post a Comment