এটা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, অনেক সময় ছড়িয়ে পড়ে সমাজ থেকে সমাজে এবং দেশ থেকে দেশে।
আসলে ঘৃণার মনস্তত্ত্ব নিয়ে খুব বেশী গবেষণা হয়নি। স্মৃতি, চেতনা কিংবা ভালবাসা সম্পর্কে আমরা যত তত্ত্বকথা জানতে পারি, ঘৃণা সম্পর্কে তেমন জানা যায় না। নিঃসন্দেহে ঘৃণা একটি জটিল মানসিক আবেগ। কিন্তু ঘৃণার বশে আজকাল যেভাবে সহিংসতা ঘটছে তাতে অনেকেই মনে করছেন এ সম্পর্কে আরও গভীর পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা মনে তীব্র ঘৃণা পোষণ করেন, তারাও নিজেদের দয়ালু এবং সহমর্মী ব্যক্তি বলে ভেবে থাকেন। তাদের মানসিক বলয়ের এই দুই বিপরীত ধরণের আবেগ সমাজে পরিস্থিতি ভেদে তাদের ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়। এরকম ব্যক্তি একই সময়ে তার পরিচিতজনের জন্য যত্নশীল এবং সহানুভূতিপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; কিন্তু এই একই ব্যক্তি অস্ত্রহাতে কোথাও গিয়ে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে। ব্যক্তির এই দ্বৈত আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া সহজ নয়। এরা মনের ভিতরে যে তীব্র ঘৃণার বিষ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এবং যারা তার ঘৃণার কারণে সংঘটিত অপরাধের শিকার হচ্ছে, তার জন্য অনেক সময় কোন অনুশোচনাও বোধ করে না। বরং যাদের প্রতি সে ঘৃণা পোষণ করছে, তাদের যেকোনোভাবে নির্মূল করাকেই তার “পবিত্র কর্তব্য” বলে মনে করছে।
ধরণ এবং মাত্রাভেদে এটা নানা রূপ ধারণ করতে পারে। জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম ঘৃণার দুটি ধরণের কথা বলেছেন – একটি যুক্তিসঙ্গত ঘৃণা আর অন্যটি চরিত্র-নির্ধারিত ঘৃণা। যুক্তিসঙ্গত ঘৃণার তেমন ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ কিংবা অপরাধকে আমরা যৌক্তিক কারণে ঘৃণা করতে পারি। কিন্তু চরিত্র-নির্ধারিত ঘৃণা একটু জটিল বিষয়। যেমন কেউ জন্মের পরে মন্ত্রণা কিংবা শিক্ষার কারণে যদি কোন গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্ম কিংবা জাতির মানুষকে ঘৃণা করে তাহলে সেটা একটি সমস্যার বিষয়ই বটে। এরকম ঘৃণার অনেক উদাহরণ এখন আমাদের সামনে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও মুসলমান, মেক্সিকান, সমকামী কিংবা এশিয়ার মানুষ তীব্র ঘৃণার মুখে অসহায় বোধ করছে। নাৎসি চেতনার মতো উন্নাসিকতার ফলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অনুভুতি থেকে সৃষ্ট এই ঘৃণা অন্যদের মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করছে। কিন্তু তারা সেটা বোঝার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। চরিত্র-নির্ধারিত ঘৃণার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এটা দুনিয়াকে সরল দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়- আমরা শ্রেষ্ঠ; আর “তারা” আমাদের কেউ নয়, তারা কিছু নয়। এই “তাদের” প্রতি ঘৃণার মাত্রা এতই তীব্র এবং বিধ্বংসী যে “তাদের” নির্মূল করার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়াই বৈধ বলে মনেপ্রাণে তারা বিশ্বাস করে। আর এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে সহিংসতা। এটা ব্যক্তি পর্যায়ে ঘটতে পারে, কিন্তু একসময়ে তা ছোটগণ্ডী ছাড়িয়ে বৃহত্তর গণহত্যায়ও রূপ নিতে পারে। তার উদাহরণ ভারত উপমহাদেশে বার বার দেখা গিয়েছে, দেখা গিয়েছে দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীন ঘৃণা থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পাব?
সমাধান একটিই। যুগে যুগে মহৎ ব্যক্তিরা সেই একটি বিষয়ের কথাই বলে গিয়েছেন। মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, এই সেদিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বলেছেন- ঘৃণা এবং সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের একে অপরকে ভালবাসতে শিখতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় ঘৃণার আগুণ থেকে দুনিয়াকে রক্ষা করার জন্য আমাদের হাতে কোন যাদু-মন্ত্র নেই। তবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কিছু স্বীকৃত আচার-অনুশাসন আমাদের জানা রয়েছে। ঘৃণা একটি অর্জিত আবেগ; কেউ জন্ম থেকেই ঘৃণা নিয়ে এই দুনিয়ায় আসে না। তাই ঘৃণা দূর করা যায়। এরজন্য দরকার সর্বস্তরে একটি সহনশীল, নমনীয় এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ গড়ে তোলা। ক্ষণস্থায়ী জীবনে এই ছোট পৃথিবীতে নানা বর্ণ,ধর্ম এবং মতবিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাস করতে শিখতে হবে। আর সেজন্যই গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের আপাতত কোন বিকল্প নেই।
ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ফলে আজ দুনিয়া ছোট হয়েছে সত্য; কিন্তু নতুন বিপদও হয়েছে। স্বাস্থ্য নয়, ব্যাধিই সংক্রামক-এটা যেমন সত্য; তেমন ভালবাসা নয়, ঘৃণাই সংক্রামক। আগে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘৃণা রপ্তানী করতে মাস কিংবা বছর লেগে যেত; কিন্তু এখন অন্তর্জালে মুহূর্তেই ঘৃণার আগুণ লেলিহান শিখার মতো দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষের সামনে আজ এটা একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে মানুষের প্রতি আস্থা হারানোর কিছু নেই। মানুষ মানুষের জন্যই। অতএব আমাদের আশাবাদী হতে হবে যে আমরা অবশ্যই ঘৃণামুক্ত ভালবাসার সহনশীল শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো।
No comments:
Post a Comment