শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Sunday, 12 May 2013

নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনও চলছে



১৯৩৬ সাল পর্যন্তও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর এক নম্বর কারণ ছিল নিউমোনিয়া অ্যান্টিবায়োটিক  আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হার কমতে শুরু করেছে কিন্তু এখনও সারা পৃথিবীতে শিশুদের মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৩ জন শিশু নিউমনিয়াতে মৃত্যু বরণ করে নিউমোনিয়াতে যত মৃত্যু হয়, তার ৯৯% উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঘটে এদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে- বাংলাদেশসহ দক্ষিন এশিয়া এবং সাব-সাহারার দেশসমুহ  ২০১১ সালেও বিশ্বে প্রায় ১৪ লাখ ৫ বছরের কম বয়সী শিশু নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেছে   এইডস, ম্যালেরিয়া  এবং হামের  কারণে যত মৃত্যু হয়, এ সংখ্যা তার চেয়ে বেশী
২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ১২ নভেম্বর “বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসহিসেবে পালন করে আসছে নিউমোনিয়া সম্পর্কে বিশেষত শিশুদের নিউমোনিয়া সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই উদ্যোগ শিশুদের নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্ব জোটের উদ্যোগে (Global Coalition Against Child Pneumonia)প্রতি বছর এই দিবস পালন করা হয়
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসে নিউমোনিয়া কি? নিউমোনিয়া ফুসফুসের এক ধরনের জীবাণুজনিত সংক্রমণ আমাদের ফুসফুস অসংখ্য ছোট ছোট বায়ুথলি দিয়ে তৈরি নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসের বায়ুথলি প্রদাহজনিত রস এবং পুঁজ দিয়ে ভরে যায় এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথা হয় শিশুদের নিউমোনিয়া হলে সহজেই তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণে মৃত্যু ঘটে
নানারকম জীবাণুর কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে; যেমন-ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা ছত্রাক সাধারণত যে সকল জীবাণু দ্বারা নিউমোনিয়া হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি, হিমফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি, রেস্পিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস ইত্যাদি এইডস আক্রান্তদের মধ্যে নিউমোসিস্টিস জিরভেচি নামে পরিচিত অস্বাভাবিক জীবাণু দ্বারা নিউমোনিয়া হয়
কিভাবে নিউমোনিয়ার জীবাণু ছড়ায়? নিউমোনিয়ার জীবাণু আমাদের নাক এবং গলায় বাস করেবিশেষ পরিস্থিতিতে শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকলে নিউমোনিয়া হয় সাধারণত আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে জীবাণু ছড়ায়
যে জীবাণু দিয়ে নিউমোনিয়া হোক না কেন, লক্ষন-উপসর্গ প্রায় একই রকম তবে ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়ার উপসর্গ ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার উপসর্গের চেয়ে তীব্র হয় নিউমোনিয়ার প্রধান উপসর্গ- শ্বাসকষ্ট, শ্বাসের গতি বৃদ্ধি, কাশি, জ্বর, কাঁপুনি, ক্ষুধামন্দা, বুকে সাঁইসুঁই শব্দ হওয়া  ইত্যাদি
শিশুদের মারাত্মক নিউমোনিয়া হলে শ্বাসের গতি অনেক বেড়ে যায় এবং দম নেওয়ার সময় পাঁজর দেবে যায় খুব তীব্র নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু পানাহার করতে পারে না, অনেক সময় শরীরের তাপমাত্রা খুব কমে যেতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে; এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে  
নিউমোনিয়া হওয়ার পেছনে অনেকগুলি ঝুঁকি উপাদান কাজ করতে পারে যে সকল শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশী অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে যে সকল শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে না তাদেরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয় অন্য কোনও গুরুতর রোগ থাকলে, হাম কিংবা এইচ আই ভি/ এইডস আক্রান্ত শিশুদেরও নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশী
কতগুলি পরিবেশগত কারণেও নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে যেমন- ঘরের ভিতরে বায়ু দূষণ, ধূমপান, বদ্ধ ঘরে অতিবসতি ইত্যাদি 
উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসা করলে সহজেই নিউমোনিয়া নিরাময় করা যায় এজন্য আক্রান্ত রোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল কিংবা একজন চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যেতে হয় তবে অধিকাংশ নিউমোনিয়ার রোগীকে বাড়িতেই উপযুক্ত সেবা দিয়ে চিকিৎসা  করা সম্ভব যে সকল শিশুর বয়স ২ মাসের কম কিংবা যারা মারাত্মক নিউমোনিয়ায় ভুগছে তাদেরকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করা উচিত ১৪ টি উন্নয়নশীল দেশের এক জরীপে দেখা যায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের প্রতি ৪ জনের মাত্র ১ জন উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক পায় যত শিশুর নিউমোনিয়া হয়, তাদের মধ্যে প্রতি দুই জনের মধ্যে এক জন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়
শিশু মৃত্যু হার কমানোর জন্য নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু কমানো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যথাযথ পুষ্টি, সুস্থ পরিবেশ এবং টীকার সাহায্যে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায় হাম, হুপিং কাশি এবং হিমফিলাস নিউমনির বিরুদ্ধে  টীকা প্রদানের মাধ্যমে অর্ধেকের বেশী নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব
জন্মের পর শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায় মায়ের বুকের দুধ শুধু নিউমোনিয়া প্রতিরোধই করে না, এটা নিউমোনিয়ার স্থায়িত্বকালও কমায়  ঘরের বায়ুদূষণ কমানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নশীল থাকলে নিউমোনিয়ার প্রকোপ সহজেই কমানো সম্ভব
বিভিন্ন জরীপে দেখা যায় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারলে এবং  সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে প্রতিবছর ১০ লাখ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব শুধুমাত্র সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলেও ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায় পৃথিবীর ৪২ টি গরীব দেশের শিশুদের নিউমোনিয়া উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসা করার জন্য প্রতিবছর ৬০ কোটি ডলার দরকার দক্ষিন এশিয়া এবং সাব-সাহারার দেশগুলির শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসার জন্য এর তিন ভাগের এক ভাগ মানে ২০ কোটি ডলার প্রয়োজন কিন্তু এর মাধ্যমে দুনিয়ার ৮৫% নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব এই অর্থ দিয়ে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক নয়, স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাও সম্ভব  
এজন্য ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ বিশ্বব্যাপী নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের এক কর্মসূচী [Global action plan for the prevention and control of pneumonia (GAPP)] শুরু করেছে এর উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীতে শিশুদের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমানো এবং আক্রান্ত শিশুদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এর জন্য যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হল- 
·    মায়ের বুকের দুধ পান, হাত ধোয়া এবং ঘরের ভিতরে বায়ুদূষণ প্রতিরোধের মাধ্যমে শিশুদের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমানো
·         নিউমোনিয়ার টীকা দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ
·   প্রতিটি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে প্রয়োজন মতো অ্যান্টিবায়োটিক এবং অক্সিজেন দিয়ে  চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এর স্বাস্থ্য কাঠামোকে সে ভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা


বাংলাদেশ শিশু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু হার ৬৬% কমেছে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১৬% নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেছে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর ফলে আগামীতে এটা অনেক কমবে বলে আশা করা হচ্ছে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে শিশুদের নিউমোনিয়ার টীকা দেওয়া শুরু হবে অতএব নিউমোনিয়ার বিষয়ে আমরা সকলে সচেতন হলে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব
  



বড়দের হাম



হাম সাধারণ রোগ নয়। হামের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অপুষ্টিসহ নানা রকম জটিলতা হতে পারে। এ রকম প্রচারণা আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। ইদানীং হাম শুধু শিশুদের নয়, বড়দেরও আক্রমণ করছে। এ জন্য হাম প্রতিরোধে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
হাম ভাইরাসজনিত একটি রোগ। এটা অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধি। পৃথিবীব্যাপী এর প্রকোপ দেখা যায়। সাধারণত আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এর ভাইরাস আশপাশের সুস্থ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির কৰে প্রবেশ করলেও সুস্থ কেউ হামের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
হামের ভাইরাসের সুপ্তিকাল ১০ থেকে ১৪ দিন। অর্থাৎ সুস্থ কারোর শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লৰণ ও উপসর্গ প্রকাশ পায়। হাম হলে প্রচন্ড জ্বর হয়। জ্বরের সঙ্গে সারা শরীরে ব্যথা, চোখ-নাক দিয়ে পানি ঝরা, কাশি, মাথাব্যথা, কানে ব্যথাসহ নানাবিধ উপসর্গ থাকে। জ্বর শুরু হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিনের মাথায় শরীরে লাল দানা ওঠে। হামের লাল দানা ওঠার ৪ দিন আগে থেকে শুরম্ন করে পরবতর্ী ৪ দিন পর্যনত্ম রোগীর শরীর থেকে হামের জীবাণু অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে। সারা বছর পৃথিবীতে প্রায় ১ কোটি মানুষ হাম দ্বারা আক্রানত্ম হয়। এদের মধ্যে নানা রকম জটিলতার কারণে ২ লাখের মৃতু্য ঘটে থাকে। হামের কারণে ৫ বছর কম বয়সী শিশুরাই বেশি মৃতু্যবরণ করে। নবজাতক এবং বড়রাই হামের জটিলতার বেশি শিকার হয়।
ইদানীং কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রছাত্রী এবং বড়দের হাম হতে দেখা যাচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে বড়দের হাম হলে জটিলতা বেশি হয়। হামের জটিলতার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে মারাত্মক নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কানের সংক্রমণ ইত্যাদি। এ ছাড়া অনেক সময় মসত্মিষ্কের প্রদাহ হতে পারে। হাম শিশুদের অপুষ্টির একটি কারণ। গর্ভাবস্থায় মায়েদের হাম হলে গর্ভপাত ও অকাল প্রসব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া গর্ভস্থ শিশুর ওজন কমে যায়।
কারও হাম হলে অবশ্যই অবহেলা করা যাবে না। হাম আক্রানত্ম ব্যক্তির পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টি এবং পানীয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘাম প্রতিরোধযোগ্য একটি ব্যাধি। এর বিরম্নদ্ধে অত্যনত্ম কার্যকর টিকা রয়েছে। সম্প্রসারিত টিকা দান প্রকল্পের অধীনে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি হামের বিরম্নদ্ধেও টিকা দেয়া হয়।
এছাড়া হাম, মাম্পস এবং রম্নবেলা রোগের বিরম্নদ্ধে ব্যবহারের জন্য আরেক ধরনের অত্যনত্ম কার্যকর টিকা বাজারে পাওয়া যায়। যাদের জন্ম ১৯৫৭ সালের পরে এবং যাদের শৈশবে হাম হয়নি কিংবা শৈশবে হামের টিকা নেয়ার নিশ্চিত প্রমাণ নেই তাদের এমএম আর টিকা গ্রহণ করা উচিত। বিশেষত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী,শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, বিদেশ ভ্রমণকারী কিংবা ঝুঁকিগ্রস্থ মনে করছেন এমন প্রত্যেকের অন্তত দুই ডোজ এমএম আর টিকা গ্রহণ করা উচিত। হামের টিকা নিরাপদ। এমএমআর টিকারও তেমন কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তবে গর্ভাবস্থায় মায়েদের এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের এ টিকা গ্রহণ করা উচিত নয়। টিকা নেয়ার পরে সামান্য জ্বর কিংবা টিকা প্রদানের স্থানে লাল চাকা কিংবা ফুলে যেতে পারে যা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।


হাসতে নেই মানা


 

বাংলা সাহিত্যে মজার জগতের কারিগর সুকুমার রায় লিখেছিলেন-
রাম গড়ুরের ছানা হাসতে তাদের মানা
হাসির কথা শুনলে বলে
হাসব না-না, না-না
সদাই মরে ত্রাসে-
ঐ বুঝি কেউ হাসে।
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে,
আপনি বকে বকে
আপনারে কয়,
হাসিস্ যদি মারব কিন্তু তোকে।
যায় না বনের কাছে,
কিংবা গাছে গাছে
দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে। (সংক্ষেপিত)

হাসি সম্পর্কে এত সুন্দর প্রকাশ কমই দেখা যায়। বিশ্বসাহিত্য কিংবা চিত্রশিল্প কর্মেও হাসি নিয়ে আমরা নানারকম অমর সৃষ্টি দেখি। মোনালিসার হাসি নিয়ে যেমন গবেষণা এখনো শেষ হয়নি, তেমন অনেক জানার বাকি ক্রীতদাসের হাসিসম্পর্কে। কিন্তু হাসির ঔষধি মূল্য নিয়ে সচরাচর তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয় না। আজকাল মালিশ চিকিৎসা, জল চিকিৎসা, সুগন্ধি চিকিৎসা, স্পর্শ চিকিৎসা, কম্পন চিকিৎসা ইত্যাদি নানাবিধ চিকিৎসার প্রসার দেখতে পাই। এর পাশাপাশি হাস্যরসেরও চিকিৎসা গুণ রয়েছে। হাসলে কিংবা হাসালে চিন্তা প্রফুল্ল হয়, মন উদ্দীপিত হয়, বিষন্ন বিপর্যস্ত ব্যক্তি বাঁচার আনন্দ খুঁজে পায়। হাসিখুশি ব্যক্তি, সুস্থ ব্যক্তি। অবশ্য হাস্য-গবেষকগণ এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না আসলে হাসিই মানুষকে সুস্থবোধ করতে সাহায্য করে, নাকি এর পেছনে আরো অন্য কোনো কারণ রয়েছে। যারা হাসেন, তাদের রসবোধ প্রখর হয়; তারা জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। হাসিখুশি ব্যক্তিকে বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার-পরিজনেরাও পছন্দ করেন। হাসিখুশি ব্যক্তির সাহচর্যে এসে কেউ গোমরা হয়ে বসে থাকতে পারেন না। হাসির এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও দুঃখের বিষয় এ নিয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি।

হাসলে শরীরে কি ঘটে?

হাসলে শরীরে নানারকম শারীরবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে মুখম-ল ও শরীরের পেশি প্রসারিত-সংকুচিত হয়, হৃদঘাত এবং রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়, শ্বাসের গতি বেড়ে যায় এবং আমাদের শরীরের সর্বত্র অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রবাহিত হয়। অনেকে বলেন হাসি এবং ব্যায়ামের উপকারিতা একই রকম। হাসির পাশাপাশি যদি কেউ হাল্কা শরীরচর্চা করেন, তাহলে তারা আরো উপকৃত হবেন। যারা ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র দিয়ে শরীরচর্চা করেন তাদের হৃদস্পন্দন ১০ মিনিটে যতটুকু বাড়ে, ১ মিনিটের প্রাণখোলা হাসিতেও সমপরিমান হৃস্পন্দন বাড়ে। হাসলে প্রচুর ক্যালরিও খরচ হয়। হিসাব করে দেখা গেছে ১০-১৫ মিনিটের হাসির ফলে ৫০ ক্যালরি খরচ হয়। এই হিসেব দেখে, তাই বলে কেউ যেন শরীরচর্চা ছেড়ে না দেন। একটি চকোলেট খেলেও আমরা ৫০ ক্যালরি পাই। প্রতি ঘণ্টায় ৫০ ক্যালরি খরচ করে আমরা যদি ১ পাউন্ড ওজন কমানোর জন্য চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের পুরো ১ দিন হাসতে হবে। বিগত কয়েক দশকের গবেষণায় শরীরের ওপরে হাসির প্রভাব সম্পর্কে আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে।

রক্তপ্রবাহ

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ একটা মজার গবেষণা করেছেন। কাউকে কমেডি নাটক বা দুঃখের নাটক দেখতে দিলে তাদের রক্ত প্রবাহের ওপর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, তারা গবেষণার মাধ্যমে সেটাই পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফলাফল যা ভাবার তাই হয়েছে। যারা হাসির নাটক দেখেছেন তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তপ্রবাহ বেড়েছে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

অতিরিক্ত মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগ, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। কিন্তু কিছু পরীক্ষা পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, হাস্যরস শরীরে রোগ প্রতিরোধের জন্য দরকারি কোষ এবং অ্যান্টিবডির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর হাসি-তামাশার প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর ফলাফলও বেশ মজার। বলা হচ্ছে হাসি-তামাশা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর জন্য সহায়ক।

শিথিলায়ন এবং ঘুম

নরমান কাজিন নামে এক ভদ্রলোক একটি বই লিখেছেন। মূলত তার বইটি হাসির উপকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসা গবেষকদের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাজিনের এক ধরনের বাত হয়েছিল যার ফলে শিরদাঁড় এবং কোমরে প্রচ- ব্যথা হয়। উনি অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন ওষুধ সেবনে তার যত না উপকার হতো, তার চেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যেত কোনো হাসির সিনেমা দেখলে। উনি বলেছেন দশ মিনিট হাসতে পারলে দুঘণ্টা আরামে ঘুমোনো যেত।

হাসি এক অমূল্য ওষুধ

হাসির উপকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও গবেষকগণ এর প্রকৃত রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে পড়েছেন এক গোলকধাঁধায়। কারণ হাসি সংক্রান্ত গবেষণাগুলোর পরিসর ছোট এবং তেমন নির্ভরযোগ্য ও গোছানো নয়। অনেক গবেষক আগে থেকেই হাসির ইতিবাচক দিক প্রমাণের জন্য পক্ষপাতমূলক কাজ-কর্ম করেছেন। ফলে হাসির উপকারিতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায় ব্যথানাশক হিসেবে হাসির ভূমিকা নিয়ে। অনেক গবেষণায় প্রমাণ করা হয়েছে হাসলে আঘাতজনিত ব্যথার অনুভূতি অনেক কমে যায়। অবশ্য এটা কি শুধু হাসির প্রভাব, না আর কোনো উপাদান এখানে কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে হাসলে মানুষের অসুস্থতার হার কমে যায়। নাকি যারা সুস্থ তারা বেশি হাসতে পারেন? এ জন্য হাসিই সুস্থতার নিয়ামক নাকি, সুস্থতার ফল হাসি তামাশাÑ এ প্রশ্নের জবাব দেয়া সহজ নয়।

উন্নত জীবনের জন্য হাসি

এ কথা অনস্বীকার্য হাসি সামাজিকায়নের চাবিকাঠি। হাসি স্বর্গীয়। হাস্যরসিক ব্যক্তি বন্ধুবৎসল, পরিবার-পরিজনবেষ্টিত সুখী মানুষ। এটা হাসির কারণে নাকি সুখী পরিবারের ফসল হাসি, তা নিয়ে অযথা বিতর্ক না করে, আমরা সকলের মুখে হাসি চাই। নিঃসঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে বন্ধু-বান্ধব পরিবৃত্ত ব্যক্তি ৩০ গুণ বেশি হাসেন। যারা হাসেন তাদের সঙ্গে আশপাশের মানুষের সংযোগ অধিকতর ঘনিষ্ঠ। স্বাস্থ্যের ওপর এসবের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
হাসি স্বাস্থ্যকর। কিন্তু আমরা শুধু বাঁচার জন্য হাসি না। পরিবার প্রিয়জনদের সঙ্গে হাস্যময় আন্তরিকতা আমাদের আত্মিক বন্ধনকে দৃঢ় করে; কেন করে তা অনুসন্ধান হাসি গবেষকগণ করতে পারেন। হাসি যদি আমরা উপভোগ করি তো সেটাই কি হাসির জন্য যথেষ্ট কারণ নয়? এর জন্য কি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের দরকার আছে?

কীটনাশকের স্বাস্থ্যঝুঁকি




দুটিই বাড়ছে। কৃষিক্ষেত্রে ও দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কীটনাশক ও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে থাকি এবং দিন দিন এসব কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে। বাড়ির টবে লাগানো ফুলগাছ থেকে শুরু করে বাগানের শাকসবজি, লাউ-কুমড়া, বেগুন-বরবটির গাছ আর মাঠে ধান, পাট, যবসহ সব ধরনের শস্যের বালাইনাশক হিসেবে এসব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। কলা থেকে শুরু করে আম, আপেল, পেয়ারা, বরই, আঙুর ইত্যাদি ফল সংরক্ষণ এবং পাকানোর জন্যও নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে আজকাল বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের প্রকোপও বেড়েছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহারের সঙ্গে ক্যান্সারের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না? ব্রিটেনের ক্যান্সার গবেষণা-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত তথ্য এবং কিছু গবেষণার ফলাফল থেকে বলা হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহারের সঙ্গে লিউকেমিয়া, লিম্ফোমা, মস্তিষ্কের ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এ সম্পর্ক কতটা জোরালো তা বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে বলেননি।
কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে যাঁরা কীটনাশক দ্রব্যাদি ছিটানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের শরীরে এগুলো অতিরিক্ত প্রবেশ করার আশঙ্কা থাকে। বিশেষত যাঁরা কীটনাশক ব্যবহারের সতর্কতামূলক নির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চলেন না তাঁদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে থাকে এবং এ ধরনের কৃষিক্ষেত্রের কর্মীদের মধ্যে লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমার প্রকোপ তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে।
ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থাও এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করছে এবং তাদের ধারণা, নিয়মিত যেসব কৃষিকর্মী কীটনাশক ছিটানোর কাজে নিয়োজিত, তাঁদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। ডিডিটি ও লিনডেন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি পাওয়া গিয়েছিল। ইদানীং এ ভয়ংকর রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে, কীটনাশক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী আর কীটনাশক ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে আবশ্যক। কিন্তু মানব শরীরের জন্য কীটনাশক ক্ষতিকর কি না তা জানাও আমাদের জরুরি।
কোনো গবেষণায় বলা হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার করলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অন্য কোনো গবেষণায় বলা হচ্ছে, কীটনাশক ব্যবহার নিরাপদ।
সম্প্রতি বলা হয়েছে, ফল ও সবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলে তা প্রাণীদের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু খাবারে এসব কীটনাশকের মাত্রা খুব কম থাকে। মানুষের শরীরে এরা ক্যান্সার সৃষ্টি করেছে কি না তা এখনো সরাসরি প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের সাধারণ জ্ঞান এটাই বলে যে সাবধান থাকাই উত্তম। বাজারের ফল-সবজি, মাংস-মাছ এখন কিছুই আর রাসায়নিক কীটনাশক কিংবা রাসায়নিক সংরক্ষকমুক্ত নয়। একজন নিরীহ ভোক্তার পক্ষে এসব যাচাই করা কিংবা পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সতর্কতামূলক প্রতিরোধব্যবস্থা অনুসরণ করাই উত্তম_ যেকোনো ফল এবং কাঁচা সবজি গ্রহণের আগে পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে কিংবা ডুবিয়ে রাখতে হবে।
এত দিন চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষা মোতাবেক জেনেছি, ফল-সবজি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। আজ নিয়তির পরিহাস, সেই ক্যান্সার প্রতিরোধক শাকসবজি, ফলমূল রাসায়নিক কীটনাশক ও সংরক্ষক ওষুধের অতি প্রয়োগ কিংবা অপব্যবহারে ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরোক্ষ ধূমপানের কুফল





পরোক্ষ ধূমপান কী?


সহজ কথায় ধূমপানরত ব্যক্তির বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি গ্রহণ করলে সেটাকে পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়। এটা দুভাবে আসতে পারে, ধূমপানরত ব্যক্তির জ্বলন্ত বিড়ি কিংবা সিগারেটের পাশ থেকে নির্গত ধোঁয়া কিংবা ধূমপায়ী ধোঁয়া গ্রহণের পর নিঃশ্বাসের সঙ্গে পরিত্যক্ত ধোঁয়া। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশের পাশ থেকে নির্গত ধোঁয়া দিয়ে কোনো একটি কক্ষের মোট ধোঁয়ার ৮৫ শতাংশ ভরে থাকে।

তামাকের ধোঁয়ায় কী থাকে?


তামাকের ধোঁয়ায় চার হাজারের বেশি উপাদান থাকে। এগুলোর মধ্যে যেসব কণা রয়েছে তা হলোআলকাতরা, নিকোটিন, বেনজিন ও বেনজোপাইরিন। আর গ্যাসীয় উপাদানগুলো রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড, অ্যামোনিয়া, ডাই-মিথাইল নাইট্রোস অ্যামাইন, ফরমালডিহাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ও অ্যাক্রোলিন। এক হিসাবে দেখা যায়, তামাকের ধোঁয়ায় অন্তত ৬০ রকমের উপাদান রয়েছে, যেগুলো ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। আর শ্বাসনালির জন্য উত্তেজক যে কত উপাদান রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (Environment protection agency) তামাকের ধোঁয়াকে অ্যাসবেস্টস এবং আর্সেনিকের মতোই প্রথম শ্রেণীর ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে গণ্য করে।

পরোক্ষ ধূমপায়ীর কী ক্ষতি হয়?


অন্যের ধোঁয়া পান করলে চোখ জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি হয়। ৩০ মিনিট পরোক্ষ ধূমপান করলে হৃদপিণ্ডের মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ করার জন্য তা যথেষ্ট। হাঁপানির রোগীর হাঁপানির প্রকোপ বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ ধূমপান বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

দীর্ঘমেয়াদে কী হয়?


বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে হৃদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যানসারের প্রকোপ ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। আর কর্মস্থল এবং পথেঘাটে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে হৃদরোগের হার বেড়ে যায় ৫০-৬০ শতাংশ। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনে দেখা যায়, অধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যানসার এবং হৃদরোগের কারণ পরোক্ষ ধূমপান।

পরোক্ষ ধূমপানের ব্যাপকতা?


প্রকৃতপক্ষে এর ব্যাপকতা অনেক বিস্তৃত। এক হিসাবে দেখা যায়, ব্রিটেনের অর্ধেক শিশুই বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। ধূমপায়ী মা-বাবার শিশুদের মধ্যে শ্বাসনালির রোগব্যাধির প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ একটি ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন আমাদের পরোক্ষ ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। ঘরের ভেতর ধূমপান করলে তা ধূমপায়ীর জন্য তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে তা তার পরিবারের অন্যদের, বিশেষত শিশুদের জন্যও ক্ষতিকর।

শ্বাসনালীর দীর্ঘমেয়াদী আবদ্ধতাজনিত রোগ





ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)- এর প্রকোপ ব্যাপক এ রোগের কারণে রোগী এবং রোগীর পরিবারের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে  এবং এর কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর কলে ঢোলে পড়ে তারপরেও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতি দুই থেকে চার জন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ আক্রান্তদের মধ্যে এক জন এখনও জানেই না যে তার এ রোগ হয়েছে ২০০৪ সালের এক হিসেবে সারা পৃথিবীতে আনুমানিক ৬৪ মিলিয়ন মানুষ ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ আক্রান্ত ২০০৫ সালে এ রোগের কারণে ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে সারা পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যায় তার প্রতি ২০ জনে ১ জন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মারা যায় আর এ মৃত্যুর ৯০% ঘটে কম এবং মাঝারি আয়ের দেশগুলিতে

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর প্রধান কারণ ধূমপান আগে এ রোগের প্রকোপ মূলত পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু আজকাল মহিলাদের ধূমপান করার প্রবণতা বাড়ার ফলে তাদের মধ্যেও ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর প্রকোপ বাড়ছে এই রোগ নিরাময়যোগ্য নয়, কিন্তু আগে শনাক্ত করা গেলে এবং চিকিৎসা দিলে এর গতি শ্লথ করা যায় আশঙ্কা করা হচ্ছে এর ঝুঁকি উপাদান বিশেষত ধূমপানের হার কমাতে না পারলে, আগামী ১০ বছরে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মৃত্যু হার ৩০% বৃদ্ধি পাবে

শ্বাস নালীর নানা রকম রোগ হয়ে থাকে এদের মধ্যে হাঁপানি(asthma) এবং ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর নাম আমরা সবাই কম বেশী শুনে থাকি লক্ষন- উপসর্গ শুনে অনেক সময় এ রোগ দুটিকে আলাদা করা মুশকিল কিন্তু এদের গতি প্রকৃতি এবং পরিণতি এক রকম নয়  ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ (COPD) রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস বা শ্বাস নালীর দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ  এবং এম্ফাইসেমা বা ফুসফুসের অতি প্রসারণ এদের মূল বৈশিষ্ট্য হল ফুসফুসের বায়ু পথ সরু হয়ে যাওয়া এ কারণে ফুসফুসে বাতাস পুরোপুরি ঢুকতে পারে না এবং দম ছাড়ার সময় ফুসফুসের বায়ু পুরো খালি হয় না এ কারণে দম ভারি হয়ে আসে এবং শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় সমস্যা হচ্ছে একবার ফুসফুসে বায়ু সরবরাহকারী নালী সমূহ সঙ্কীর্ণ হয়ে গেলে, তা সহজে আগের অবস্থায় পুরোপুরি ফিরে আসে না এর কারণ সংশ্লিষ্ট কোষসমূহে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত একটি অতি সংবেদনশীল অবস্থা বিরাজ করতে থাকে

সবার মনেই একটি প্রশ্ন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ কেন হয়? সাধারণত এ রোগের পেছনে সব চেয়ে বড় ভুমিকা পালন করে ধূমপান, ধোঁয়া- ধুলাবালি এবং ঘন ঘন শ্বাস নালীর সংক্রমণ  তবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা- নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে ধূমপানের ভুমিকাই আসল দীর্ঘদিন অতিরিক্ত ধূম পান করলে শ্বাস নালী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ধীরে ধীরে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের লক্ষন উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে প্রাথমিক পর্যায়ে ধূমপান ছাড়লে অনেকে এ রোগের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে কিন্তু বেশী দেরী করলে ধূমপান ছাড়লেও আর উপকার পাওয়া যায় না
অনেকে শহরের ধুলাবালিপূর্ণ ও ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশে বসবাস করাকেও এ রোগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন এ ছাড়া রান্না ঘরের ধোঁয়াও এর প্রকোপ বাড়াতে সাহায্য করে বার বার শ্বাসনালীতে জীবাণু সংক্রমণ হলে এ রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়          

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ হলে অতিরিক্ত কাশি এবং শ্লেষ্মা তৈরি হয় এর সঙ্গে শ্বাস কষ্ট হয় সাধারণত ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে কাশি প্রতি বছর কম পক্ষে তিন মাসের বেশী স্থায়ী হয়, শীত কালে এর প্রকোপ বাড়ে কাশির সঙ্গে প্রচুর শ্লেষ্মা নির্গত হয় এ অবস্থা পর পর দুই বছর বা তার চেয়ে বেশী স্থায়ী হলে মনে করা হয় ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ হয়েছে এর সঙ্গে দিনে দিনে শ্বাস কষ্ট হয় এবং শ্বাস কস্টের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে যাদের ফুস ফুসের বায়ু থলি অতিরিক্ত প্রসারিত হয়ে যায় তাদের শ্বাস কষ্ট বেশী হয় ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের ভোগান্তি রোগী এবং তার পরিবারের নিকট জনই কেবল উপলব্ধি করতে পারে

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ শনাক্ত করার পরীক্ষা খুবই সহজ স্পাইরমেট্রি নামে পরিচিত একটি করলে এ রোগটি শনাক্ত করা যায় এ পরীক্ষা করতে কোনও ব্যথা লাগে না কিংব অন্য কোনও জটিলতার  আশঙ্কা নাই কিন্তু ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল এর ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং রোগ প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় 

সময় মতো পরীক্ষোর-নিরীক্ষা করে উপযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ না করলে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের ফলে নানা রকম জটিলতা হয় এ রোগের কারণে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় এর ফলে শরীরে সব সময় দুর্বলতা অনুভূত হয় এ ছাড়া রক্তে লাল রক্ত কণিকার পরিমাণ বেড়ে যায় দীর্ঘদিন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে ভুগলে হৃদপিণ্ডের ডান নিলয় প্রসারিত হয়ে যায় এক পর্যায়ে বিকলতা দেখা দেয় রক্তে অক্সিজেন কমে যাওয়া এবং কার্বনডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে এক পর্যায়ে শ্বাসতন্ত্রও বিকল হয়ে যেতে পারে   
এ জন্য বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD) দিবসের মূল উদ্দেশ্য এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সারা পৃথিবীতে সচেতনতা গড়ে তোলা বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদের কতগুলি বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে-

  • ধূমপান পরিহার করতে হবে
  • বিভিন্ন কারণে আমরা যে ধোঁয়া-ধুলা-বালি  শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করি , তার পরিমাণ কমাতে হবে এ জন্য ঘরের ভিতরে এবং বাইরে সব রকম উত্তেজক ও অ্যালার্জি সৃষ্টি কারী উপাদান সযত্নে পরিহার করতে হবে
  •  ঘরে চুলা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে
  • ঘন ঘন যেন শ্বাস নালীর জীবাণু সংক্রমণ জনিত প্রদাহ না হতে পারে , সে জন্য  সজাগ থাকতে হবে


যারা বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে ভুগছেন তাদের অবশ্যই হাসপাতালে কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে সাধারনত শ্বাস নালীকে প্রসারিত করার জন্য উপশমকারী ওষুধ ব্যবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায় এ ছাড়া জীবাণু সংক্রমণের লক্ষন প্রকাশ পেলে উপযুক্ত অ্যান্টি বায়োটিক ব্যবহার করতে হবে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার প্রকোপ কমানোর জন্য আজ কাল টীকা পাওয়া যায় টীকা দিলে ঘন ঘন ফ্লু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এ ছাড়া ফুসফুস এবং শ্বাস নালীর ব্যায়াম  ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের জন্য বিশেষ উপকারী উপযুক্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ , মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ প্রশমন করার মাধ্যমেও ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীরা যথেষ্ট উপকার পেতে পারেন    

সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ আগে শনাক্ত করা হলে,  ঝুঁকি উপাদান বিশেষত ধূমপান কমাতে পারলে এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে এবং ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে