শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Sunday, 12 May 2013

হাসতে নেই মানা


 

বাংলা সাহিত্যে মজার জগতের কারিগর সুকুমার রায় লিখেছিলেন-
রাম গড়ুরের ছানা হাসতে তাদের মানা
হাসির কথা শুনলে বলে
হাসব না-না, না-না
সদাই মরে ত্রাসে-
ঐ বুঝি কেউ হাসে।
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে,
আপনি বকে বকে
আপনারে কয়,
হাসিস্ যদি মারব কিন্তু তোকে।
যায় না বনের কাছে,
কিংবা গাছে গাছে
দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে। (সংক্ষেপিত)

হাসি সম্পর্কে এত সুন্দর প্রকাশ কমই দেখা যায়। বিশ্বসাহিত্য কিংবা চিত্রশিল্প কর্মেও হাসি নিয়ে আমরা নানারকম অমর সৃষ্টি দেখি। মোনালিসার হাসি নিয়ে যেমন গবেষণা এখনো শেষ হয়নি, তেমন অনেক জানার বাকি ক্রীতদাসের হাসিসম্পর্কে। কিন্তু হাসির ঔষধি মূল্য নিয়ে সচরাচর তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা হয় না। আজকাল মালিশ চিকিৎসা, জল চিকিৎসা, সুগন্ধি চিকিৎসা, স্পর্শ চিকিৎসা, কম্পন চিকিৎসা ইত্যাদি নানাবিধ চিকিৎসার প্রসার দেখতে পাই। এর পাশাপাশি হাস্যরসেরও চিকিৎসা গুণ রয়েছে। হাসলে কিংবা হাসালে চিন্তা প্রফুল্ল হয়, মন উদ্দীপিত হয়, বিষন্ন বিপর্যস্ত ব্যক্তি বাঁচার আনন্দ খুঁজে পায়। হাসিখুশি ব্যক্তি, সুস্থ ব্যক্তি। অবশ্য হাস্য-গবেষকগণ এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না আসলে হাসিই মানুষকে সুস্থবোধ করতে সাহায্য করে, নাকি এর পেছনে আরো অন্য কোনো কারণ রয়েছে। যারা হাসেন, তাদের রসবোধ প্রখর হয়; তারা জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। হাসিখুশি ব্যক্তিকে বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার-পরিজনেরাও পছন্দ করেন। হাসিখুশি ব্যক্তির সাহচর্যে এসে কেউ গোমরা হয়ে বসে থাকতে পারেন না। হাসির এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও দুঃখের বিষয় এ নিয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি।

হাসলে শরীরে কি ঘটে?

হাসলে শরীরে নানারকম শারীরবৃত্তিক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে মুখম-ল ও শরীরের পেশি প্রসারিত-সংকুচিত হয়, হৃদঘাত এবং রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়, শ্বাসের গতি বেড়ে যায় এবং আমাদের শরীরের সর্বত্র অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রবাহিত হয়। অনেকে বলেন হাসি এবং ব্যায়ামের উপকারিতা একই রকম। হাসির পাশাপাশি যদি কেউ হাল্কা শরীরচর্চা করেন, তাহলে তারা আরো উপকৃত হবেন। যারা ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র দিয়ে শরীরচর্চা করেন তাদের হৃদস্পন্দন ১০ মিনিটে যতটুকু বাড়ে, ১ মিনিটের প্রাণখোলা হাসিতেও সমপরিমান হৃস্পন্দন বাড়ে। হাসলে প্রচুর ক্যালরিও খরচ হয়। হিসাব করে দেখা গেছে ১০-১৫ মিনিটের হাসির ফলে ৫০ ক্যালরি খরচ হয়। এই হিসেব দেখে, তাই বলে কেউ যেন শরীরচর্চা ছেড়ে না দেন। একটি চকোলেট খেলেও আমরা ৫০ ক্যালরি পাই। প্রতি ঘণ্টায় ৫০ ক্যালরি খরচ করে আমরা যদি ১ পাউন্ড ওজন কমানোর জন্য চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের পুরো ১ দিন হাসতে হবে। বিগত কয়েক দশকের গবেষণায় শরীরের ওপরে হাসির প্রভাব সম্পর্কে আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে।

রক্তপ্রবাহ

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ একটা মজার গবেষণা করেছেন। কাউকে কমেডি নাটক বা দুঃখের নাটক দেখতে দিলে তাদের রক্ত প্রবাহের ওপর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, তারা গবেষণার মাধ্যমে সেটাই পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফলাফল যা ভাবার তাই হয়েছে। যারা হাসির নাটক দেখেছেন তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তপ্রবাহ বেড়েছে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

অতিরিক্ত মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগ, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। কিন্তু কিছু পরীক্ষা পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, হাস্যরস শরীরে রোগ প্রতিরোধের জন্য দরকারি কোষ এবং অ্যান্টিবডির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর হাসি-তামাশার প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর ফলাফলও বেশ মজার। বলা হচ্ছে হাসি-তামাশা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর জন্য সহায়ক।

শিথিলায়ন এবং ঘুম

নরমান কাজিন নামে এক ভদ্রলোক একটি বই লিখেছেন। মূলত তার বইটি হাসির উপকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসা গবেষকদের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাজিনের এক ধরনের বাত হয়েছিল যার ফলে শিরদাঁড় এবং কোমরে প্রচ- ব্যথা হয়। উনি অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন ওষুধ সেবনে তার যত না উপকার হতো, তার চেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যেত কোনো হাসির সিনেমা দেখলে। উনি বলেছেন দশ মিনিট হাসতে পারলে দুঘণ্টা আরামে ঘুমোনো যেত।

হাসি এক অমূল্য ওষুধ

হাসির উপকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও গবেষকগণ এর প্রকৃত রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে পড়েছেন এক গোলকধাঁধায়। কারণ হাসি সংক্রান্ত গবেষণাগুলোর পরিসর ছোট এবং তেমন নির্ভরযোগ্য ও গোছানো নয়। অনেক গবেষক আগে থেকেই হাসির ইতিবাচক দিক প্রমাণের জন্য পক্ষপাতমূলক কাজ-কর্ম করেছেন। ফলে হাসির উপকারিতা সম্পর্কে নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া যায় ব্যথানাশক হিসেবে হাসির ভূমিকা নিয়ে। অনেক গবেষণায় প্রমাণ করা হয়েছে হাসলে আঘাতজনিত ব্যথার অনুভূতি অনেক কমে যায়। অবশ্য এটা কি শুধু হাসির প্রভাব, না আর কোনো উপাদান এখানে কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে হাসলে মানুষের অসুস্থতার হার কমে যায়। নাকি যারা সুস্থ তারা বেশি হাসতে পারেন? এ জন্য হাসিই সুস্থতার নিয়ামক নাকি, সুস্থতার ফল হাসি তামাশাÑ এ প্রশ্নের জবাব দেয়া সহজ নয়।

উন্নত জীবনের জন্য হাসি

এ কথা অনস্বীকার্য হাসি সামাজিকায়নের চাবিকাঠি। হাসি স্বর্গীয়। হাস্যরসিক ব্যক্তি বন্ধুবৎসল, পরিবার-পরিজনবেষ্টিত সুখী মানুষ। এটা হাসির কারণে নাকি সুখী পরিবারের ফসল হাসি, তা নিয়ে অযথা বিতর্ক না করে, আমরা সকলের মুখে হাসি চাই। নিঃসঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে বন্ধু-বান্ধব পরিবৃত্ত ব্যক্তি ৩০ গুণ বেশি হাসেন। যারা হাসেন তাদের সঙ্গে আশপাশের মানুষের সংযোগ অধিকতর ঘনিষ্ঠ। স্বাস্থ্যের ওপর এসবের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
হাসি স্বাস্থ্যকর। কিন্তু আমরা শুধু বাঁচার জন্য হাসি না। পরিবার প্রিয়জনদের সঙ্গে হাস্যময় আন্তরিকতা আমাদের আত্মিক বন্ধনকে দৃঢ় করে; কেন করে তা অনুসন্ধান হাসি গবেষকগণ করতে পারেন। হাসি যদি আমরা উপভোগ করি তো সেটাই কি হাসির জন্য যথেষ্ট কারণ নয়? এর জন্য কি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের দরকার আছে?

No comments:

Post a Comment