শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Sunday, 12 May 2013

শ্বাসনালীর দীর্ঘমেয়াদী আবদ্ধতাজনিত রোগ





ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)- এর প্রকোপ ব্যাপক এ রোগের কারণে রোগী এবং রোগীর পরিবারের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে  এবং এর কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর কলে ঢোলে পড়ে তারপরেও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতি দুই থেকে চার জন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ আক্রান্তদের মধ্যে এক জন এখনও জানেই না যে তার এ রোগ হয়েছে ২০০৪ সালের এক হিসেবে সারা পৃথিবীতে আনুমানিক ৬৪ মিলিয়ন মানুষ ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ আক্রান্ত ২০০৫ সালে এ রোগের কারণে ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে সারা পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যায় তার প্রতি ২০ জনে ১ জন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মারা যায় আর এ মৃত্যুর ৯০% ঘটে কম এবং মাঝারি আয়ের দেশগুলিতে

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর প্রধান কারণ ধূমপান আগে এ রোগের প্রকোপ মূলত পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু আজকাল মহিলাদের ধূমপান করার প্রবণতা বাড়ার ফলে তাদের মধ্যেও ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর প্রকোপ বাড়ছে এই রোগ নিরাময়যোগ্য নয়, কিন্তু আগে শনাক্ত করা গেলে এবং চিকিৎসা দিলে এর গতি শ্লথ করা যায় আশঙ্কা করা হচ্ছে এর ঝুঁকি উপাদান বিশেষত ধূমপানের হার কমাতে না পারলে, আগামী ১০ বছরে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মৃত্যু হার ৩০% বৃদ্ধি পাবে

শ্বাস নালীর নানা রকম রোগ হয়ে থাকে এদের মধ্যে হাঁপানি(asthma) এবং ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এর নাম আমরা সবাই কম বেশী শুনে থাকি লক্ষন- উপসর্গ শুনে অনেক সময় এ রোগ দুটিকে আলাদা করা মুশকিল কিন্তু এদের গতি প্রকৃতি এবং পরিণতি এক রকম নয়  ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ (COPD) রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস বা শ্বাস নালীর দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ  এবং এম্ফাইসেমা বা ফুসফুসের অতি প্রসারণ এদের মূল বৈশিষ্ট্য হল ফুসফুসের বায়ু পথ সরু হয়ে যাওয়া এ কারণে ফুসফুসে বাতাস পুরোপুরি ঢুকতে পারে না এবং দম ছাড়ার সময় ফুসফুসের বায়ু পুরো খালি হয় না এ কারণে দম ভারি হয়ে আসে এবং শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় সমস্যা হচ্ছে একবার ফুসফুসে বায়ু সরবরাহকারী নালী সমূহ সঙ্কীর্ণ হয়ে গেলে, তা সহজে আগের অবস্থায় পুরোপুরি ফিরে আসে না এর কারণ সংশ্লিষ্ট কোষসমূহে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত একটি অতি সংবেদনশীল অবস্থা বিরাজ করতে থাকে

সবার মনেই একটি প্রশ্ন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ কেন হয়? সাধারণত এ রোগের পেছনে সব চেয়ে বড় ভুমিকা পালন করে ধূমপান, ধোঁয়া- ধুলাবালি এবং ঘন ঘন শ্বাস নালীর সংক্রমণ  তবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা- নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে ধূমপানের ভুমিকাই আসল দীর্ঘদিন অতিরিক্ত ধূম পান করলে শ্বাস নালী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ধীরে ধীরে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের লক্ষন উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে প্রাথমিক পর্যায়ে ধূমপান ছাড়লে অনেকে এ রোগের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে কিন্তু বেশী দেরী করলে ধূমপান ছাড়লেও আর উপকার পাওয়া যায় না
অনেকে শহরের ধুলাবালিপূর্ণ ও ধোঁয়াযুক্ত পরিবেশে বসবাস করাকেও এ রোগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন এ ছাড়া রান্না ঘরের ধোঁয়াও এর প্রকোপ বাড়াতে সাহায্য করে বার বার শ্বাসনালীতে জীবাণু সংক্রমণ হলে এ রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়          

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ হলে অতিরিক্ত কাশি এবং শ্লেষ্মা তৈরি হয় এর সঙ্গে শ্বাস কষ্ট হয় সাধারণত ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে কাশি প্রতি বছর কম পক্ষে তিন মাসের বেশী স্থায়ী হয়, শীত কালে এর প্রকোপ বাড়ে কাশির সঙ্গে প্রচুর শ্লেষ্মা নির্গত হয় এ অবস্থা পর পর দুই বছর বা তার চেয়ে বেশী স্থায়ী হলে মনে করা হয় ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ হয়েছে এর সঙ্গে দিনে দিনে শ্বাস কষ্ট হয় এবং শ্বাস কস্টের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে যাদের ফুস ফুসের বায়ু থলি অতিরিক্ত প্রসারিত হয়ে যায় তাদের শ্বাস কষ্ট বেশী হয় ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের ভোগান্তি রোগী এবং তার পরিবারের নিকট জনই কেবল উপলব্ধি করতে পারে

ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ শনাক্ত করার পরীক্ষা খুবই সহজ স্পাইরমেট্রি নামে পরিচিত একটি করলে এ রোগটি শনাক্ত করা যায় এ পরীক্ষা করতে কোনও ব্যথা লাগে না কিংব অন্য কোনও জটিলতার  আশঙ্কা নাই কিন্তু ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল এর ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং রোগ প্রতিরোধের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় 

সময় মতো পরীক্ষোর-নিরীক্ষা করে উপযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ না করলে ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের ফলে নানা রকম জটিলতা হয় এ রোগের কারণে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় এর ফলে শরীরে সব সময় দুর্বলতা অনুভূত হয় এ ছাড়া রক্তে লাল রক্ত কণিকার পরিমাণ বেড়ে যায় দীর্ঘদিন ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে ভুগলে হৃদপিণ্ডের ডান নিলয় প্রসারিত হয়ে যায় এক পর্যায়ে বিকলতা দেখা দেয় রক্তে অক্সিজেন কমে যাওয়া এবং কার্বনডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে এক পর্যায়ে শ্বাসতন্ত্রও বিকল হয়ে যেতে পারে   
এ জন্য বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD) দিবসের মূল উদ্দেশ্য এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সারা পৃথিবীতে সচেতনতা গড়ে তোলা বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদের কতগুলি বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে-

  • ধূমপান পরিহার করতে হবে
  • বিভিন্ন কারণে আমরা যে ধোঁয়া-ধুলা-বালি  শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করি , তার পরিমাণ কমাতে হবে এ জন্য ঘরের ভিতরে এবং বাইরে সব রকম উত্তেজক ও অ্যালার্জি সৃষ্টি কারী উপাদান সযত্নে পরিহার করতে হবে
  •  ঘরে চুলা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে
  • ঘন ঘন যেন শ্বাস নালীর জীবাণু সংক্রমণ জনিত প্রদাহ না হতে পারে , সে জন্য  সজাগ থাকতে হবে


যারা বিশ্ব ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে ভুগছেন তাদের অবশ্যই হাসপাতালে কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে সাধারনত শ্বাস নালীকে প্রসারিত করার জন্য উপশমকারী ওষুধ ব্যবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায় এ ছাড়া জীবাণু সংক্রমণের লক্ষন প্রকাশ পেলে উপযুক্ত অ্যান্টি বায়োটিক ব্যবহার করতে হবে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার প্রকোপ কমানোর জন্য আজ কাল টীকা পাওয়া যায় টীকা দিলে ঘন ঘন ফ্লু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এ ছাড়া ফুসফুস এবং শ্বাস নালীর ব্যায়াম  ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগের জন্য বিশেষ উপকারী উপযুক্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ , মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ প্রশমন করার মাধ্যমেও ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীরা যথেষ্ট উপকার পেতে পারেন    

সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ আগে শনাক্ত করা হলে,  ঝুঁকি উপাদান বিশেষত ধূমপান কমাতে পারলে এবং যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে এবং ক্রনিক শ্বাসনালীর আবদ্ধতাজনিত রোগ(COPD)-এ মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে



  

No comments:

Post a Comment