শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Sunday, 12 May 2013

নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনও চলছে



১৯৩৬ সাল পর্যন্তও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর এক নম্বর কারণ ছিল নিউমোনিয়া অ্যান্টিবায়োটিক  আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হার কমতে শুরু করেছে কিন্তু এখনও সারা পৃথিবীতে শিশুদের মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৩ জন শিশু নিউমনিয়াতে মৃত্যু বরণ করে নিউমোনিয়াতে যত মৃত্যু হয়, তার ৯৯% উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঘটে এদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে- বাংলাদেশসহ দক্ষিন এশিয়া এবং সাব-সাহারার দেশসমুহ  ২০১১ সালেও বিশ্বে প্রায় ১৪ লাখ ৫ বছরের কম বয়সী শিশু নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেছে   এইডস, ম্যালেরিয়া  এবং হামের  কারণে যত মৃত্যু হয়, এ সংখ্যা তার চেয়ে বেশী
২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ১২ নভেম্বর “বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসহিসেবে পালন করে আসছে নিউমোনিয়া সম্পর্কে বিশেষত শিশুদের নিউমোনিয়া সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই উদ্যোগ শিশুদের নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্ব জোটের উদ্যোগে (Global Coalition Against Child Pneumonia)প্রতি বছর এই দিবস পালন করা হয়
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসে নিউমোনিয়া কি? নিউমোনিয়া ফুসফুসের এক ধরনের জীবাণুজনিত সংক্রমণ আমাদের ফুসফুস অসংখ্য ছোট ছোট বায়ুথলি দিয়ে তৈরি নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসের বায়ুথলি প্রদাহজনিত রস এবং পুঁজ দিয়ে ভরে যায় এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথা হয় শিশুদের নিউমোনিয়া হলে সহজেই তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণে মৃত্যু ঘটে
নানারকম জীবাণুর কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে; যেমন-ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা ছত্রাক সাধারণত যে সকল জীবাণু দ্বারা নিউমোনিয়া হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি, হিমফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি, রেস্পিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস ইত্যাদি এইডস আক্রান্তদের মধ্যে নিউমোসিস্টিস জিরভেচি নামে পরিচিত অস্বাভাবিক জীবাণু দ্বারা নিউমোনিয়া হয়
কিভাবে নিউমোনিয়ার জীবাণু ছড়ায়? নিউমোনিয়ার জীবাণু আমাদের নাক এবং গলায় বাস করেবিশেষ পরিস্থিতিতে শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকলে নিউমোনিয়া হয় সাধারণত আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে জীবাণু ছড়ায়
যে জীবাণু দিয়ে নিউমোনিয়া হোক না কেন, লক্ষন-উপসর্গ প্রায় একই রকম তবে ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়ার উপসর্গ ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার উপসর্গের চেয়ে তীব্র হয় নিউমোনিয়ার প্রধান উপসর্গ- শ্বাসকষ্ট, শ্বাসের গতি বৃদ্ধি, কাশি, জ্বর, কাঁপুনি, ক্ষুধামন্দা, বুকে সাঁইসুঁই শব্দ হওয়া  ইত্যাদি
শিশুদের মারাত্মক নিউমোনিয়া হলে শ্বাসের গতি অনেক বেড়ে যায় এবং দম নেওয়ার সময় পাঁজর দেবে যায় খুব তীব্র নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু পানাহার করতে পারে না, অনেক সময় শরীরের তাপমাত্রা খুব কমে যেতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে; এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে  
নিউমোনিয়া হওয়ার পেছনে অনেকগুলি ঝুঁকি উপাদান কাজ করতে পারে যে সকল শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশী অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে যে সকল শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে না তাদেরও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয় অন্য কোনও গুরুতর রোগ থাকলে, হাম কিংবা এইচ আই ভি/ এইডস আক্রান্ত শিশুদেরও নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশী
কতগুলি পরিবেশগত কারণেও নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে যেমন- ঘরের ভিতরে বায়ু দূষণ, ধূমপান, বদ্ধ ঘরে অতিবসতি ইত্যাদি 
উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসা করলে সহজেই নিউমোনিয়া নিরাময় করা যায় এজন্য আক্রান্ত রোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল কিংবা একজন চিকিৎসকের নিকট নিয়ে যেতে হয় তবে অধিকাংশ নিউমোনিয়ার রোগীকে বাড়িতেই উপযুক্ত সেবা দিয়ে চিকিৎসা  করা সম্ভব যে সকল শিশুর বয়স ২ মাসের কম কিংবা যারা মারাত্মক নিউমোনিয়ায় ভুগছে তাদেরকে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করা উচিত ১৪ টি উন্নয়নশীল দেশের এক জরীপে দেখা যায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের প্রতি ৪ জনের মাত্র ১ জন উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক পায় যত শিশুর নিউমোনিয়া হয়, তাদের মধ্যে প্রতি দুই জনের মধ্যে এক জন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়
শিশু মৃত্যু হার কমানোর জন্য নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু কমানো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যথাযথ পুষ্টি, সুস্থ পরিবেশ এবং টীকার সাহায্যে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায় হাম, হুপিং কাশি এবং হিমফিলাস নিউমনির বিরুদ্ধে  টীকা প্রদানের মাধ্যমে অর্ধেকের বেশী নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব
জন্মের পর শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়ালে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায় মায়ের বুকের দুধ শুধু নিউমোনিয়া প্রতিরোধই করে না, এটা নিউমোনিয়ার স্থায়িত্বকালও কমায়  ঘরের বায়ুদূষণ কমানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নশীল থাকলে নিউমোনিয়ার প্রকোপ সহজেই কমানো সম্ভব
বিভিন্ন জরীপে দেখা যায় নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারলে এবং  সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে প্রতিবছর ১০ লাখ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব শুধুমাত্র সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলেও ৬ লাখ শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায় পৃথিবীর ৪২ টি গরীব দেশের শিশুদের নিউমোনিয়া উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসা করার জন্য প্রতিবছর ৬০ কোটি ডলার দরকার দক্ষিন এশিয়া এবং সাব-সাহারার দেশগুলির শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসার জন্য এর তিন ভাগের এক ভাগ মানে ২০ কোটি ডলার প্রয়োজন কিন্তু এর মাধ্যমে দুনিয়ার ৮৫% নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব এই অর্থ দিয়ে শুধু অ্যান্টিবায়োটিক নয়, স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাও সম্ভব  
এজন্য ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ বিশ্বব্যাপী নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের এক কর্মসূচী [Global action plan for the prevention and control of pneumonia (GAPP)] শুরু করেছে এর উদ্দেশ্য সারা পৃথিবীতে শিশুদের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমানো এবং আক্রান্ত শিশুদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এর জন্য যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হল- 
·    মায়ের বুকের দুধ পান, হাত ধোয়া এবং ঘরের ভিতরে বায়ুদূষণ প্রতিরোধের মাধ্যমে শিশুদের নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমানো
·         নিউমোনিয়ার টীকা দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ
·   প্রতিটি নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুকে প্রয়োজন মতো অ্যান্টিবায়োটিক এবং অক্সিজেন দিয়ে  চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এর স্বাস্থ্য কাঠামোকে সে ভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা


বাংলাদেশ শিশু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু হার ৬৬% কমেছে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১৬% নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু বরণ করেছে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর ফলে আগামীতে এটা অনেক কমবে বলে আশা করা হচ্ছে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে শিশুদের নিউমোনিয়ার টীকা দেওয়া শুরু হবে অতএব নিউমোনিয়ার বিষয়ে আমরা সকলে সচেতন হলে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব
  



No comments:

Post a Comment