শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Thursday 21 January 2016

যিকা ভাইরাসঃ নতুন আপদ

দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ব্যাপকভাবে একটি নতুন ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এর নাম যিকা ভাইরাস(Zika virus)আর এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়বে এমন আশংকায় সকলেই নড়ে-চড়ে বসেছেন। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, গত দুই দশকে সন্ধিপদ প্রাণীবাহী (arthropod-borne viral diseases)চার ধরণের ভাইরাস অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এইসকল দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমনঃ নব্বইয়ের দশকে ডেঙ্গি (dengue), ১৯৯৯-এ ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস(West Nile virus), ২০১৩ সালে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস(chikungunya); আর বর্তমান আপদ যিকা ভাইরাস।
যিকা ভাইরাস ১৯৪৭ সালে সর্বপ্রথম শনাক্ত হয়েছিল উগান্ডায়। দীর্ঘদিন যাবত এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র আফ্রিকা এবং এশিয়ায় বিষুবরেখার আশেপাশের দেশগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।এই ভাইরাসের বিচরণ মূলত বানরজাতীয় প্রাণী এবং এডিস মশার মধ্যে সীমিত ছিল। একদশক আগে আফ্রিকার গবেষকগণ লক্ষ্য করলেন যিকা ভাইরাস চিকুনগুনিয়ার মতই দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। উল্লেখ্য চিকুনগুনিয়া ভাইরাসও এডিস মশাবাহিত। তবে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস কিউলেক্স মশা দিয়ে ছড়িয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে পীত জ্বর (yellow fever), ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়া ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর সেই মিছিলে সামিল হয়েছে এতদিনের প্রায় অপরিচিত যিকা ভাইরাসও।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যিকা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ-উপসর্গ অনেকাংশে ডেঙ্গি জ্বরের মতই। এরফলেও জ্বর হয়, মাংসপেশীতে ব্যথা হয়, চোখে ব্যথা হয়, অত্যন্ত দুর্বল অনুভব হয় এবং ত্বকে লাল লাল দানা কিংবা ফুসকুড়ি উঠতে পারে। যিকা ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের পরে ডেঙ্গির মতো ইমিউন প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলেও; বিগত ৬০ বছরের পর্যবেক্ষণে কখনও যিকা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে ডেঙ্গির মত রক্তক্ষরণ হওয়ার নমুনা দেখা যায়নি। তবে ফ্রেঞ্চ পলিনেসিয়ায় যিকা সংক্রমণের কারণে ব্যাপকভাবে গিলেন বার সিনড্রোমসহ (Guillain–Barré syndrome)অন্যান্য স্নায়ুরোগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সবাইকে যেটি সবচেয়ে আতঙ্কিত করেছে ব্রাজিলে নবজাত শিশুদের ব্যাপকভাবে ছোট মাথা বা মাইক্রোসেফালি(microcephaly)হওয়ার ঘটনা। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে ব্রাজিলে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে মাইক্রোসেফালির হার ২০ গুণ বেশী হয়েছে।অক্টোবর ২০১৫ থেকে জানুয়ারী ২০১৬-এর মধ্যে ৩৫০০ শিশু মাইক্রোসেফালি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। মাইক্রোসেফালি আক্রান্ত শিশুর মাথা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং তাদের মস্তিস্কের আকারও ছোট হয়। পরবর্তীতে তাদের মৃগী ব্যারাম সহ নানাধরণের প্রতিবন্ধীত্ব দেখা দেয়। আর এরজন্য গর্ভকালে মায়েদের যিকা ভাইরাস সংক্রমণকে দায়ী মনে করা হচ্ছে।এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন রোগ প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ(CDC) গর্ভধারিণী মহিলাদের দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১৪টি দেশে সবধরনের ভ্রমণ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এই ১৪টি দেশ হচ্ছেঃ ব্রাজিল, কলম্বিয়া, হাইতি, হন্ডুরাস, এল সালভেদর, ফেঞ্চ গায়ানা, গুয়েতেমালা, মারটিনিক, মেক্সিকো, পানামা, প্যারাগুয়ে, সুরিনাম, ভেনেজুয়েলা এবং পুর্টেরিকো 
বলাবাহুল্য ডেঙ্গির মতো যিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনও কোন টীকা আবিস্কার হয়নি। ডেঙ্গির চিকিৎসা যেমন শুধু উপসর্গ উপশমের মধ্যে সীমিত, যিকা ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসাও উপসর্গভিত্তিক। যিকা ভাইরাসের ক্ষতিকর জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় এটা প্রতিরোধ করা। আর তা মূলত এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। অতএব ডেঙ্গি প্রতিরোধের জন্য এডিস মশার বিরুদ্ধে আমরা যে সকল পদক্ষেপ নেই, যিকা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্যও একই ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।         
তথ্যসূত্রঃ
1.       Fauci AS, Morens DM. Zika Virus in the Americas - Yet Another Arbovirus Threat. The New England journal of medicine. 2016 Jan 13. PubMed PMID: 26761185.
2.       http://www.cdc.gov/media/releases/2016/s0315-zika-virus-travel.html (Accessed on 19 January 2016)


No comments:

Post a Comment