মানুষ
ষড়রিপুর দাস। এর মধ্যে দ্বিতীয় রিপু ক্রোধ বা রাগ। পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে দেবতাদের
বিভিন্ন সময়ে ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে অ্যারিস রাগ বা ক্রোধের
জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যারিস কখন কিভাবে কার ওপর রেগে যান, এই ভয়ে তার জন্য কোনো উপাসনালয় তৈরি করা হয়নি। দুর্বাশা মুনিও রাগের জন্য
পরিচিত।
মানুষ কেন রাগে? এককথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
নানাবিধ কারণ রয়েছে। আনন্দ-বেদনা-হতাশার মতো নিত্যনৈমিত্তিক আবেগের মতো ক্রোধ বা রাগও
একটি আবেগ। কোনো ঘটনায় আমরা যেমন খুশি কিংবা মনঃক্ষুণ্ন হই, তেমনি কোনো কোনো ঘটনায় রাগান্বিত হই। একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রাগ
মেনে নেওয়া গেলেও, মাত্রাবিহীন রাগারাগি কারও কাম্য নয়। অতিরিক্ত
ক্রোধ স্বাস্থ্যহানিকর। সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে
অতিরিক্ত ক্রোধের কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। রেগে
যাওয়ার পরের দুই ঘণ্টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই সময়েই হার্ট অ্যাটাক এবং
স্ট্রোকগুলি ঘটে থাকে। যাদের হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি আছে তাদের জন্য এসময়টা আরও
বিপজ্জনক। একবার ক্রোধে ফেটে পড়ার পরের দুই ঘণ্টায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা
পাঁচ গুণ বেড়ে যায়; আর স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তিন গুণ বাড়ে।
অবশ্য মাঝে মধ্যে রেগে গেলে তত ভয়
নেই। এরফলে বছরে প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে বড়জোর প্রতিমাসে একটি হার্ট অ্যাটাক
বেশী হতে পারে; যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশী তাদের মধ্যে ৪ জনের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার
সম্ভাবনা। কিন্তু যারা অযথা অকারণে প্রতিনিয়ত রেগে থাকেন তাদের নিয়ে খুবই বিপদ। দিনে পাঁচবার ক্রোধান্বিত হলে অন্যদিক
দিয়ে সুস্থ মানুষেরও বছরে প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ১৫৮ জনের হার্ট অ্যাটাকের
সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি থাকে, তাহলে ৬৫৭ জনের হার্ট
অ্যাটাকের আশঙ্কা রয়েছে। তার মানে রাগী মেজাজ বা অকারণে সব সময় ক্রোধান্বিত থাকা
একটি মারাত্মক ঝুঁকির বিষয়।
কিন্তু কেন রাগার পরে এমন হচ্ছে তা এখনও
বোঝা যাচ্ছে না। ক্রোধ সরাসরি হৃদ যন্ত্র কিংবা রক্তনালীর কোন ক্ষতি করে না।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় রাগী
মানুষেরা ক্রনিক মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগে ভুগে থাকে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং
উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য মানুষ ধূমপান করে, মদ খায়; এছাড়া তাদের শারীরবৃত্তিক
এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যায় যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ সবকিছুই হার্ট অ্যাটাক কিংব স্ট্রোক করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে রাখে।
রাগ সেখানে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে মাত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেগে গেলে কিভাবে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে
পারি?
এর কোনো সহজ সমাধান নেই। রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত কিছু
না করে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। রাগের যথার্থ কারণ আছে কিনা তা ভাবতে হবে এবং
বিষয়টির ঠিক-বেঠিক দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে,
আজকে আপনি রাগ করছেন,
আগামীকাল আপনার রাগ থাকবে না। কিন্তু রাগের
মাথায় যে মানসিক কিংবা শারীরিক আঘাত অপরকে করা হয়, সেটি কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন।
এ জন্য রাগের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করার পরিবর্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে নিরিবিলি কোথাও
ঘটনার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সর্বোত্তম।
যদি এমন করা সম্ভব না হয়,
তাহলে রাগের প্রতিক্রিয়া কোনো ভঙ্গুর বস্তুর
ওপরে প্রক্ষেপ করা যায়। যেমন রাগ কমানোর জন্য অনেককে দেয়ালে মুষ্টাঘাত করতে দেখা যায়,
কেউ কেউ থালা-বাসন ভাঙেন। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়াও
অনেক সময় আশপাশের মানুষের জন্য ভীতি সৃষ্টি করে। এ জন্য বলা হয়,
রেগে গেলে খেলতে চলে যান,
দৌড়াতে পারেন কিংবা টিভি দেখতে পারেন।
এ ধরনের ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে রাগ কমানো যায়। রেগে যাওয়া স্বাভাবিক আবেগ। রাগার অধিকার
সবারই আছে। কিন্তু রাগের বশে কাউকে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। রাগের কারণে হতাশা এলে
ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। অতএব হতাশা গ্রাস করার আগেই রাগের কারণ বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে
হবে। অনেকের রেগে যাওয়া একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, বলা যায় রেগে যাওয়া একটি নেশা হয়ে যায়।
সবশেষে রাগ সম্পর্কে একটি শিক্ষামূলক গল্প।
এক ছেলে প্রচন্ড রাগী ছিলো। খুব সামান্য কারণেই রেগে যেত । তার বাবা তাকে একটা পেরেক ভর্তি বাক্স দিয়ে বললো, “যতবার তুমি রেগে যাবে ততবার একটা করে পেরেক বাগানের কাঠের বেড়াতে ঢুকিয়ে আসবে”। প্রথমদিনে ছেলেটি বাগানে গিয়ে ৩৭টি পেরেক মারলো। পরের কয়েক সপ্তাহে তার রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আসার ফলে কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এলো। সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রন করা বেশি সহজ। শেষপর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না। সে তার বাবাকে এই কথা জানালো। তারা বাবা তাকে বললো, “তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলবে”।
অনেক দিন পরে ছেলেটি তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই সে খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো, “তুমি ভালভাবেই তোমার কাজ সম্পন্ন করেছো। এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারো। কিন্তু দেখো প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলো এখনো রয়ে গিয়েছে। কাঠের বেড়াটি আর কখনই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে তুমি যেন একটি পেরেক ঠুকে দাও, পরবর্তিতে তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নিলেও কিন্তু তার মনে ঠিক এমন ক্ষত থেকে যায়। তাই নিজের রাগতে নিয়ন্ত্রন করতে শেখো। মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর”। তাইতো রবি ঠাকুর বলেছেন,
“ বঁধু, মিছে রাগ করো না, করো না।
মম মন বুঝে দেখো মনে মনে
মনে রেখো, কোরো করুণা”।
অতএব রাগের আগুন বশে রাখুন।
মনে রাখতে হবে, “রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন”।