শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday 29 April 2014

একটি সাঁকোর জন্য আর কতদিন ?

এক ভদ্রলোক নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন নদীতে একজন ডুবন্ত মানুষ। ভদ্রলোক কালবিলম্ব না করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং ডুবন্ত মানুষটিকে উদ্ধার করে তীরে তুলে আনলেন। কিন্তু পাড়ে উঠতে না উঠতেই তিনি দেখতে পেলেন আরেক জন ডুবন্ত মানুষ। তিনি তাকেও উদ্ধার করলেন। দ্বিতীয়জনকে নিয়ে আসতে না আসতেই তার চোখে পড়লো নদীতে আরও কয়েকজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে। এভাবে ডুবন্ত মানুষদের উদ্ধার করতে করতে ভদ্রলোক নিজেই অসুস্থ হয়ে নদীর পাড়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি মনে মনে চিন্তা করছেন যে এই নদীতে এত মানুষ ডুবে যাচ্ছে কেন?

পরদিন তিনি নদীর পাড় দিয়ে উজানের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। দুই পাড়ে কোন তেমন জনবসতি নেই। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরে তিনি দেখতে পেলেন নদীর দুই পাড়ে দুটি গ্রাম। এক গ্রামের মানুষ নানা প্রয়োজনে অন্য গ্রামে যায়। কিন্তু নদীতে কোন পারাপারের ব্যবস্থা নেই। নদীর ওপর কোন সাঁকোও নেই। ফলে প্রতিদিন অনেকেই নদী পার হতে গিয়ে ডুবে যায়।

কিন্তু ভদ্রলোকের পক্ষে একা কি আর এত ডুবন্ত মানুষকে প্রতিদিন উদ্ধার করা সম্ভব। এরজন্য দরকার একটি সাঁকো। আমাদের অবস্থা হয়েছে এরকম। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি দুই পাড়ের দুটি গ্রাম। মাঝখানে বিশাল নদী; কিন্তু নেই কোন সাঁকো। আমরা সবাই ডুবন্ত মানুষ।


আজ চিকিৎসক-সংবাদকর্মী কিংবা চিকিৎসক-রোগীর সঙ্গে যে সকল সমস্যা তার মূলেও সেই নদী। কিন্তু নেই সাঁকোর বন্ধন। আমরা একটি সাঁকোর জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবো?  

Monday 28 April 2014

স্যার-এ কি সার?

“স্যার” শব্দ পাওয়া যায় মধ্যযুগের ফরাসী ভাষায়ফরাসী messire  থেকে sire এবং পরে তা পরিণত হয়েছে sir শব্দে। এর অর্থ “আমার প্রভু” (mylord) পুরনো ফরাসী ভাষায় sieur এসেছে Seigneur থেকে। এ শব্দটির অর্থও “প্রভু”। ল্যাটিন ভাষায় সিনিয়র বা গুরুজনদের উদ্দেশ্য করেও এটা বলা হতো এবং মূলত সেখান থেকে এটা ইউরোপীয় ভাষাসমূহে প্রবেশ করে। ১২০৫ সাল থেকে ইংরেজ নাইট বা ব্যারনদের(knight or baronet) সম্মান করে “স্যার” সম্বোধন করা হতো। ইংরেজীতে “স্বাধীন পুরুষ”, “পিতা” এবং “গুরুত্বপূর্ণ মানুষ” বোঝানোর জন্যও স্যার বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে স্যার শব্দের বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায়। সাধারনত উচ্চ পদস্থ এবং মর্যাদার কর্মকর্তাদের এবং শিক্ষকদের “স্যার” সম্বোধন করা হতে থাকে। ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদেরকেও স্যার সম্বোধন করে থাকে।  মহিলাদের জন্য সমতুল্য শব্দ হচ্ছে “ম্যাম” বা “ম্যাডাম” (ma'am or madam)তবে কম বয়সী মেয়েরা এটা শুনতে পছন্দ করে না। তারা “মিস” (miss) ডাকলে আনন্দ পায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে নাইটের সমতুল্য শব্দ হচ্ছে “ডেম” বা “লেডি”( Dame or Lady)নাইটের পত্নীদের এভাবেই সম্বোধন করা হয়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যখন সূর্য অস্ত যেতো না তখন প্রতি বছর অনেককে ঘটা করে “নাইট” (এবং লেডি) উপাধি দেওয়া হতো। ভারতে ব্রিটিশ রাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬১ সাল থেকে অনেক বিখ্যাত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ভারতীয় নাগরিককে the Order of the Star of India প্রদান করা শুরু হয়। ১৮৭৮ সাল থেকে জুনিয়র অফিসারদের The Order of the Indian Empire উপাধি দেওয়া প্রচলন হয়। এসকল তকমা প্রাপ্তদের “স্যার” বলা হতো। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত  ভেঙ্গে স্বাধীন ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এ সকল উপাধি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে এটা সরকারীভাবে নিষিদ্ধ হয় ১৯৫০ সালে আর পাকিস্তান নিষিদ্ধ করে ১৯৫৬ সালে।

মজার বিষয় হচ্ছে আধুনিক পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন আর সাধারনভাবে “স্যার” সম্বোধন শোনা যায় না। প্রত্যেকের নামের দুটি অংশ-প্রথম নাম এবং পারিবারিক নাম। যেমন একজনের নাম হায়দার আলী। হায়দার আলীর পরিচিতজন তাকে শুধু “হায়দার” বলে ডাকে; কিন্তু যারা তাকে চেনেনা তারা তাকে “মিঃ আলী” বলে সম্বোধন করে। হায়দার আলী যদি কোন স্কুলের টিচার হন, তাহলে তার সকল ছাত্রছাত্রী তাকে “মিঃ আলী” বলে সম্বোধন করে থাকে। কিন্তু সহকর্মীরা “তাকে” হায়দার বলে ডাকে।

ততোধিক মজার বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশদের প্রভুত্ব থেকে মুক্ত হয়ে উপমহাদেশের জনগণ ব্রিটিশ তকমা দেওয়ার প্রচলন আদেশ জারী করে বন্ধ করেছে। কিন্তু নিজেরা এখনও “স্যার” অর্থাৎ “হে প্রভু” ডাক শুনতে চায়; এই বেলায় অফিসার, ডাক্তার, উকিল-মোক্তার কিংবা বিচারক কোন ফারাক দেখা যায় না। সবার মনের ভিতরেই প্রভু হওয়ার সুপ্ত বাসনা। কেউ সেবক হতে চায় না। 

Tuesday 15 April 2014

স্মার্ট ফোন এবং ট্যাবলেট পিসি-র টাচ স্ক্রিনের জীবাণু

চিকিৎসক এবং হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মীদের স্মার্ট ফোন এবং ট্যাবলেট পিসি-র টাচ স্ক্রিন নানারকম জীবাণু দ্বারা আক্রান্তসম্প্রতি জার্মান হাসপাতালে চিকিৎসক এবং সেবিকাদের স্মার্ট ফোন এবং ট্যাবলেট পিসি-র টাচ স্ক্রিন পরীক্ষা করে এমনই দেখা গিয়েছেএটা শুধু চিকিৎসক এবং সেবিকাদের ব্যক্তিগত সুস্থতার জন্যই হুমকি নয়, তাদের পরিবার এবং রোগীদের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে। স্মার্ট ফোন এবং ট্যাবলেট পিসি-র টাচ স্ক্রিনে যে সকল জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ Staphylococcus aureusEnterococcus, and Enterobacteriaceae জাতীয় ব্যাকটেরিয়া। এজন্য সতর্কতা হিসেবে সকল চিকিৎসক এবং সেবিকার উচিত তাদের স্মার্ট ফোন এবং ট্যাবলেট পিসি-র টাচ স্ক্রিন নিয়মিত পরিস্কার করা; বিশেষত হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফেরার আগে অবশ্যই তা করা উচিত। অন্যথায় তাদের শিশুদের মধ্যে খুব সহজেই এসকল জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। কারণ বাড়ী ফেরার পর অনেকের বাচ্চাই বাবা-মায়ের ফোন নিয়ে খেলা করে কিংবা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকে।   

তথ্যসূত্রঃ 16th International Congress on Infectious Diseases (ICID): Abstract 61.014. Presented  April 5, 2014.

Friday 4 April 2014

গাঁজায় কেমন আসক্তি হয়?


গাঁজার নেশা সৃষ্টিকারী মূল উপাদানটির নাম টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল (THC) গাঁজায় এর পরিমাণ যত বেশী হবে, সেটা তত শক্তিশালী অনেকের মনে একটি প্রশ্ন ছিল যে শক্তিশালী গাঁজা সেবন করলে কি আসক্তি জন্মানোর সম্ভাবনা বেশী?
সম্প্রতি একটি গবেষণার ফলাফলে প্রশ্নের জবাব মিলেছে ডাচ গবেষকগণ এখন বলছেন কড়া ডোজের গাঁজা সেবনের সময় গাঁজাখোররা এমনভাবে ধোঁয়া টানে যে আসলে তার ফলে শরীরে খুব বেশী টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনল প্রবেশ করে না ফলে আসক্তি জন্মানোর বিষয়টি তেমন উল্লেখযোগ্য নয় আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তি ইন্সটিটিইউটের একদল গবেষক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় একশো গাঁজাখোরের ওপর টানা দেড় বছর পর্যবেক্ষণ শেষে তারা বলছেন কড়া ডোজের গাঁজা টানলেই যে বেশী আসক্তি জন্মাবে ব্যাপারটা তা নয় কারণ গাঁজার ডোজ কড়া হলেও গাঁজাখোরেরা ধোঁয়া এমনভাবে টানে যে শরীরে তা মাত্রাতিরিক্ত হতে পারে না
দেখা যায় প্রতি দশ জন গঞ্জিকা সেবনকারীর মধ্যে একজন এতে আসক্ত বা নির্ভরশীল হয়ে যায় যারা নিয়মিত এবং অতিরিক্ত কড়া গাঁজা সেবন করে তাদের মধ্যেই আসক্তির সম্ভাবনা বেশী আসক্তি জন্মানোর মূল উপাদান টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনল (THC)  
ডাচ গবেষকগণ নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন আস্তানা থেকে প্রথমে ৬০০ গাঁজাখোর খুঁজে বের করেন তাদের মধ্য থেকে তারা ৯৮ জনকে তাদের পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন করেন এদের গাঁজা সেবনের পুরো প্রক্রিয়াটি টানা দেড় বছর ধরে অনুসরণ করা হয় তাদের গাঁজা সেবনের ধরণ, সময়কাল, কতটুকু ধোঁয়া টানছে, কতটুকু গাঁজা নিচ্ছে এবং তার মধ্যে কি পরিমাণ টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনল আছে- এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসেব রাখা হয় তারপরে তারা ফলাফল হিসেব করে বলছেনঃ
·         গাঁজাখোরদের পুরিয়াতে টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনলের পরিমাণ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত থাকে
·         গাঁজার পুরিয়াতে টেট্রা হাইড্রোক্যানাবিনলের পরিমাণ যত বেশী থাকে, গাঁজাখোরেরা ধোঁয়া তত কম টানে কারণ অল্প ধোঁয়াতেই তার নেশা জমে যায়।
·         ধোঁয়া টানার পরিমাণ আবার নির্ভর করে আসক্তি জন্মানোর ওপর যারা গাঁজায় আসক্ত হয়ে পড়ে তারা ধোঁয়া বেশী টানে
·         মাসে কতটুকু টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল গ্রহণ করে সেটার সঙ্গে দেড় বছর পড়ে নির্ভরশীলতা জন্মানোর সম্পর্কটি তেমন সরাসরি নয়

যেকোনো মাদকাসক্তি জন্মানোর পেছনে অনেক রকম কারণ জড়িত থাকে এখানে ব্যক্তির আর্থসামাজিক অবস্থা, তার মানসিক পরিস্থিতি এবং পরিবেশের প্রভাবের সঙ্গে বংশগতির মিথস্ক্রিয়া কাজ করে থাকে অনেকে মনে করছেন ডাচ গবেষণা থেকে এখনই কোন সিদ্ধান্তে আসা সমীচীন নয়। তবে অতিরিক্ত গাঁজা শরীর এবং মন দুয়ের জন্যই ক্ষতিকর এজন্য এসম্পর্কে আরও বিস্তারিত পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে

তথ্যসূত্রঃ van der Pol P, Liebregts N, Brunt T, et al. Cross-sectional and prospective relation of cannabis potency, dosing and smoking behaviour with cannabis dependence: an ecological study. Addiction. Published online March 16 2014

বঁধু, মিছে রাগ করো না, করো না।


মানুষ ষড়রিপুর দাস। এর মধ্যে দ্বিতীয় রিপু ক্রোধ বা রাগ। পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে দেবতাদের বিভিন্ন সময়ে ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে অ্যারিস রাগ বা ক্রোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যারিস কখন কিভাবে কার ওপর রেগে যান, এই ভয়ে তার জন্য কোনো উপাসনালয় তৈরি করা হয়নি। দুর্বাশা মুনিও রাগের জন্য পরিচিত।
মানুষ কেন রাগে? এককথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। আনন্দ-বেদনা-হতাশার মতো নিত্যনৈমিত্তিক আবেগের মতো ক্রোধ বা রাগও একটি আবেগ। কোনো ঘটনায় আমরা যেমন খুশি কিংবা মনঃক্ষুণ্ন হই, তেমনি কোনো কোনো ঘটনায় রাগান্বিত হই। একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রাগ মেনে নেওয়া গেলেও, মাত্রাবিহীন রাগারাগি কারও কাম্য নয়। অতিরিক্ত ক্রোধ স্বাস্থ্যহানিকর। সাম্প্রতিক গবেষণায় তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত ক্রোধের কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। রেগে যাওয়ার পরের দুই ঘণ্টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই সময়েই হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকগুলি ঘটে থাকে। যাদের হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি আছে তাদের জন্য এসময়টা আরও বিপজ্জনক। একবার ক্রোধে ফেটে পড়ার পরের দুই ঘণ্টায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ গুণ বেড়ে যায়; আর স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা তিন গুণ বাড়ে।
অবশ্য মাঝে মধ্যে রেগে গেলে তত ভয় নেই। এরফলে বছরে প্রতি ১০,০০০ মানুষের মধ্যে বড়জোর প্রতিমাসে একটি হার্ট অ্যাটাক বেশী হতে পারে; যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশী তাদের মধ্যে ৪ জনের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু যারা অযথা অকারণে প্রতিনিয়ত রেগে থাকেন তাদের নিয়ে খুবই  বিপদ। দিনে পাঁচবার ক্রোধান্বিত হলে অন্যদিক দিয়ে সুস্থ মানুষেরও বছরে প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ১৫৮ জনের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি থাকে, তাহলে ৬৫৭ জনের হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা রয়েছে। তার মানে রাগী মেজাজ বা অকারণে সব সময় ক্রোধান্বিত থাকা একটি মারাত্মক ঝুঁকির বিষয়।
কিন্তু কেন রাগার পরে এমন হচ্ছে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ক্রোধ সরাসরি হৃদ যন্ত্র কিংবা রক্তনালীর কোন ক্ষতি করে না।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় রাগী মানুষেরা ক্রনিক মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগে ভুগে থাকে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য মানুষ ধূমপান করে, মদ খায়; এছাড়া তাদের শারীরবৃত্তিক এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যায় যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ সবকিছুই হার্ট অ্যাটাক কিংব স্ট্রোক করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে রাখে। রাগ সেখানে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে মাত্র।   

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেগে গেলে কিভাবে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?
এর কোনো সহজ সমাধান নেই। রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত কিছু না করে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। রাগের যথার্থ কারণ আছে কিনা তা ভাবতে হবে এবং বিষয়টির ঠিক-বেঠিক দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকে আপনি রাগ করছেন, আগামীকাল আপনার রাগ থাকবে না। কিন্তু রাগের মাথায় যে মানসিক কিংবা শারীরিক আঘাত অপরকে করা হয়, সেটি কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। এ জন্য রাগের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করার পরিবর্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে নিরিবিলি কোথাও ঘটনার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সর্বোত্তম।
যদি এমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে রাগের প্রতিক্রিয়া কোনো ভঙ্গুর বস্তুর ওপরে প্রক্ষেপ করা যায়। যেমন রাগ কমানোর জন্য অনেককে দেয়ালে মুষ্টাঘাত করতে দেখা যায়, কেউ কেউ থালা-বাসন ভাঙেন। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়াও অনেক সময় আশপাশের মানুষের জন্য ভীতি সৃষ্টি করে। এ জন্য বলা হয়, রেগে গেলে খেলতে চলে যান, দৌড়াতে পারেন কিংবা টিভি দেখতে পারেন। এ ধরনের ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে রাগ কমানো যায়। রেগে যাওয়া স্বাভাবিক আবেগ। রাগার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু রাগের বশে কাউকে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। রাগের কারণে হতাশা এলে ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। অতএব হতাশা গ্রাস করার আগেই রাগের কারণ বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকের রেগে যাওয়া একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, বলা যায় রেগে যাওয়া একটি নেশা হয়ে যায়।
সবশেষে রাগ সম্পর্কে একটি শিক্ষামূলক গল্প।
এক ছেলে প্রচন্ড রাগী ছিলো। খুব সামান্য কারণেই রেগে যেত তার বাবা তাকে একটা পেরেক ভর্তি  বাক্স দিয়ে বললো, “যতবার তুমি রেগে যাবে ততবার একটা করে পেরেক বাগানের কাঠের বেড়াতে ঢুকিয়ে আসবে প্রথমদিনে ছেলেটি বাগানে গিয়ে ৩৭টি পেরেক মারলো পরের কয়েক সপ্তাহে তার রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আসার ফলে কাঠে নতুন পেরেকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এলো। সে বুঝতে পারলো হাতুড়ী দিয়ে কাঠের বেড়ায় পেরেক বসানোর চেয়ে তার রাগকে নিয়ন্ত্রন করা বেশি সহজ। শেষপর্যন্ত সেই দিনটি এলো যেদিন তাকে একটি পেরেকও মারতে হলো না। সে তার বাবাকে এই কথা জানালো। তারা বাবা তাকে বললো, তুমি যেসব দিনে তোমার রাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারবে সেসব দিনে একটি একটি করে পেরেক খুলে ফেলবে
অনেক দিন পরে ছেলেটি তার বাবাকে জানালো যে সব পেরেকই সে খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তার বাবা এবার তাকে নিয়ে বাগানে গেল এবং কাঠের বেড়াটি দেখিয়ে বললো,তুমি ভালভাবেই তোমার কাজ সম্পন্ন করেছো এখন তুমি তোমার রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারো কিন্তু দেখো প্রতিটা কাঠে পেরেকের গর্তগুলো এখনো রয়ে গিয়েছে। কাঠের বেড়াটি আর কখনই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। যখন তুমি কাউকে রেগে গিয়ে কিছু বলো তখন তার মনে তুমি যেন একটি পেরেক ঠুকে দাও, পরবর্তিতে তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নিলেও কিন্তু তার মনে ঠিক এমন ক্ষত থেকে যায় তাই নিজের রাগতে নিয়ন্ত্রন করতে শেখো। মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর তাইতো রবি ঠাকুর বলেছেন,
বঁধু, মিছে রাগ করো না, করো না।
মম মন বুঝে দেখো মনে মনে
মনে রেখো, কোরো করুণা”

অতএব রাগের আগুন বশে রাখুন। মনে রাখতে হবে, “রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন”।