শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Monday 30 May 2016

নিজের কম্বল নিজে নিয়ে নিন


নিজের কম্বল নিজে নিয়ে নিন

ইন্টারসিটি ট্রেনে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা একই কম্পার্টমেন্টে জায়গা পেয়েছেন। দুজনে খুব ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। ভদ্রলোক উপরের বার্থে আর ভদ্রমহিলা নীচের বার্থে।
মাঝরাতে হঠাৎ ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি একটু ইতস্তত করে ভদ্রমহিলাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন, “দেখুন কিছু মনে করবেন না; আমার খুব ঠান্ডা লাগছে। আপনি কি দয়া করে আমার সুটকেস থেকে কম্বলটা বের করে আমাকে দেবেন?”
ভদ্রমহিলা উত্তরে বললেন “আমার একটা ভালো আইডিয়া আছে। আজকের রাতের জন্য মনে করি না আমরা স্বামী আর স্ত্রী?”
ভদ্রলোক খুব অবাক হলেও মনে মনে খুশি হয়ে বললেন “তাই নাকি? দারুণ আইডিয়া!! তাহলে এখন আমাকে কি করতে হবে?”

“তেমন কিছুই না। উঠুন আর নিজের কম্বল নিজে নিয়ে নিন”।


Saturday 28 May 2016

সেলফি প্রেমিকদের নার্সিসিজম


সেলফি তোলা আজকাল ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি এমন কি রাজনীতিবিদরাও সেলফি তুলতে ব্যস্ত সবার ইচ্ছে একটু মজা করার জন্য কিংবা নিজেকে প্রচার করার জন্য একটি সুন্দর সেলফি তোলা আর কাজটিও আজকাল খুব সহজ অন্য কাউকে ডাকতে হয়না, নিজেই নিজের ছবি তুলে সারা দুনিয়ায় প্রচার করে দেওয়া যায়

সম্প্রতি মানুষের সেলফি তোলার এমন প্রবণতা নিয়ে Social Psychological and Personality Science জার্নালে একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যারা সেলফি তুলতে ভালবাসেন তাদের নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা রয়েছে এবং তারা আসলে একধরণের নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমে ভুগছেন।

টরোন্টো ইউনিভার্সিটির ১৯৮ জন ছাত্র-ছাত্রী এই গবেষণায় অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে ১০০ জন নিজেকে সেলফিপ্রেমিক বলে দাবী করেছে। বাকীরা সচরাচর সেলফি তুলতে পছন্দ করে না। অন্য একজন এদের প্রত্যেকেরই আবার ছবি তুলে দিয়েছে। তারপর সেলফি এবং অন্যজনের তোলা ছবি - এ দুয়ের মধ্যে কোনটি তাদের প্রিয় জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিচারকদেরও উভয় ধরণের ছবির তুলনা করে মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল। দেখা যায় যারা সেলফি-প্রেমিক তারা নিজের তোলা সেলফিকেই সেরা বলেছেন। অন্যের তোলা ছবির চেয়ে নিজের সেলফিতেই তাদের সুন্দর দেখাচ্ছে বলে মনে করেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে বিচারকগণ তৃতীয় ব্যক্তিদের তোলা ছবিগুলিকে ভাল মনে করছেন। কিন্ত সেলফি-প্রেমিকদের তা কে বোঝাবে?
     

এজন্য গবেষকদের ধারণা যারা নিজেদের সেলফি তুলতে ভালবাসেন তারা আসলে একধরণের আত্মপ্রেম বা নার্সিসিজমে ভুগছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া সেলফির ওপর বন্ধুদের লাইক এবং প্রশংসাসূচক মন্তব্য তাদের এবিষয়ে কতটুকু প্রভাবিত করছে, সেটা নিয়ে অবশ্য একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। 

Wednesday 25 May 2016

ছায়ার ভাড়া



ছায়ার ভাড়াঃ একাল

একদা একদেশের রাজধানীর নাম ছিল ঢাকা। গাছপালার ছায়ায় ঢাকা ছিল বলেই এই নাম রাখা হয়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে সেই ঢাকা এক সময় খুবই বড় আধুনিক শহরে পরিণত হল। কিন্তু হারিয়ে গেল সবুজ বৃক্ষ আর লতাপাতা। ঢাকার পথপ্রান্তর ঢেকে গেল ইট-পাথরের দালান-কোঠায়।
একদিন এক মুসাফির ঢাকায় বেড়াতে এলেন।
তখন গ্রীষ্মকাল। ঢাকার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কিন্ত বিশ্রাম নেওয়ার মতো কোন গাছ খুঁজে পাচ্ছিলেন নাহোটেলে যাওয়ার মতো টাকা নেই, পরিচিত কোন বন্ধু-বান্ধবও নেই। তাই তিনি ঠিক করলেন একটি দালানের ছায়ায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবেন। কিন্তু দালানের ছায়ায় বসতে না বসতেই বাড়ীর মালিক এসে বললেন, “ভাড়া দেন”।
মুসাফির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, কিসের জন্য ভাড়া দেব?”
বাড়ীর মালিক বললেন, “এইযে আপনি আমার বাড়ীর ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এটার জন্য ভাড়া দেন”।

ছায়ার ভাড়াঃ সেকাল

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক মুসাফির গ্রীসে বেড়াতে গিয়েছেন। তার এথেন্স থেকে মেগারা যাওয়ার ইচ্ছে হল। কিন্তু যাওয়ার কোন বাহন নেই। আবার এতদূর হেঁটে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি এক গাধা ভাড়া করলেন। গাধার মালিক তাকে চড়িয়ে নিয়ে যেতে রাজী হল। মুসাফির এজন্য তাকে খুবই কৃতজ্ঞতা জানালেন।
তখন গ্রীষ্মকাল। পথে কাঠফাটা রোদ। অচিরেই তারা রোদে আর গরমে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তাই এক জায়গায় যেয়ে মুসাফির বিশ্রাম নেওয়ার জন্য গাধা থেকে নামলেন। সেখানে আশেপাশে কোন গাছপালাও নেই, বাড়ী ঘরও নেই। তাই ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন তিনি গাধার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিবেন। কিন্তু গাধার মালিকও ওখানে বসে বিশ্রাম নিতে চাইল। মুসাফির বললেন, “আমি গাধা ভাড়া নিয়েছি। অতএব গাধার ছায়ায় বিশ্রাম নেওয়া আমার অধিকার”। গাধার মালিকও ছাড়ার পাত্র নয়। তিনি বললেন, “মহাশয়, আমি গাধা ভাড়া দিয়েছি। গাধার ছায়াতো ভাড়া দেইনি”। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল বাক-বিতন্ডা। শেষপর্যন্ত হাতাহাতি, মারামারি শুরু হল।
এদিকে গাধা ছাড়া পেয়ে এক-পা দু-পা করে ওখান থেকে পালিয়ে গেল।


(এটা নিছক গল্পমাত্র।এখানে কোন নীতিবাক্য সন্ধান করার প্রয়োজন নেই।)

Saturday 21 May 2016

মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি



অ্যাডিকশন বা আসক্তি শব্দটি বাবা-মায়ের নিকট ভয়ের বিষয়। কোন বাবা-মা তার সন্তান কোন কিছুতে আসক্ত হোক, এটা কখনই চান না। আসক্তির প্রশ্ন আসলে আমরা সব সময় মদ-গাঁজা কিংবা  ইয়াবা-হেরোইনের কথা ভাবি। কিন্তু এসব ছাড়াও অনেক রকমের আসক্তি হতে পারে। অ্যাডিকশন বা আসক্তি বলতে কোন কিছু সেবন কিংবা গ্রহণের (যেমন-হেরোইন) কিংবা করার(যেমন-জুয়া খেলা) অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা এবং সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। সেই অর্থে আজকাল শিশু-কিশোর কিংবা বড়দের অনেকেই স্মার্ট ফোন বা মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্ত।
 
কিছুদিন আগে কমন সেন্স মিডিয়া ১২৪০ জন পিতা-মাতা এবং তাদের সন্তানদের ওপরে একটি জরীপ করেছে। এর ফলাফলে দেখা যায়-
             শতকরা ৫০ জন শিশু-কিশোর মনে করে তাদের মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি রয়েছে(এবং এদের ২৮% মনে করে তাদের বাবা-মায়েরাও আসক্ত)
             ২৭% বাবা-মা মনে করেন তারা মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্ত (এবং ৫৯% মনে করেন তাদের সন্তানেরাও আসক্ত)
             ৬৬% বাবা-মা মনে করেন তাদের সন্তানেরা মোবাইল ডিভাইসের পিছনে অতিরিক্ত সময় অপচয় করছে। ৫২% সন্তান বাবা-মায়েদের এমন ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।    
             ৪৮% পিতামাতা  এবং ৭২% সন্তান মনে করে যেকোন টেক্সট মেসেজ কিংবা অন্য নোটিফিকেশন আসলে সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব দেওয়া উচিৎ।
             ৬৯% বাবা-মা এবং ৭৮% সন্তান তাদের মোবাইল ডিভাইস ঘণ্টায় ঘণ্টায় চেক করে দেখে।
             অবশ্য ৫০% বাবা-মা এবং ৩৩% সন্তান স্বীকার করেছে যে তারা মাঝে মাঝে মোবাইলের পিছনে সময় কম ব্যয় করার চেষ্টা করে।
বলতেই হবে যে জরীপের ফলাফল বেশ চিন্তা করার মতো। পিতা-মাতা এবং সন্তান-সন্ততি উভয়েই একমত যে মোবাইল ডিভাইস তাদের অনেক সময় নিয়ে নিচ্ছে।
অবশ্য এটা ঠিক যে কেউ যদি ইন্সটাগ্রাম কিংবা ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাহলে হয়তো আপাত দৃষ্টিতে  তার ইয়াবা কিংবা হেরোইন সেবনের মতো তেমন কোন ক্ষতি হয়না। এজন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির এধরণের ব্যবহারকে কেউ আসক্তি হিসেবে গণ্য করতে প্রস্তুত নন। যদিও এধরণের প্রযুক্তি ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া কি সেসম্পর্কে কার্যত আমাদের কোন অভিজ্ঞতা এখনও নেই। আর এ নিয়ে তেমন কোন গবেষণার ফলাফলও আমাদের হাতে নেই।   
  
বাস্তবতা হচ্ছে এসকল ডিভাইস আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করছে, মানসিকভাবে আমাদেরকে অন্যপথে চালিত করছে। এটা বোঝার জন্য তেমন পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। আমাদের মনঃসংযোগ করার, একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতার এবং স্মৃতি ধারণের যে ক্ষমতা, তা বিচার করলে বহুকাজ একসঙ্গে করার চেষ্টা বা মালটি-টাস্কিং মানেই হচ্ছে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করতে না পারা। আর প্রয়োজনীয় কাজের প্রতি মনোনিবেশ না করা মানেই তার একটি প্রতিফল কিংবা প্রতিক্রিয়া ঘটা। 
শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এটার প্রকাশ ঘটছে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে। ছাত্র-ছাত্রীরা যদি সোশ্যালমিডিয়া নিয়ে বেশী সময় ব্যয় করে, অবশ্যই তাদের লেখাপড়ার সময় কমে যাচ্ছে। বড়রা যদি মোবাইল ডিভাইসে বেশী সময় দিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করতে চায়, অবশ্যই তাদের প্রকৃত সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার মান এবং সময়ে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে এসকল ডিভাইস আমাদের ঘুমের সময় নিয়ে নিচ্ছে। আর নির্ঘুম রাত মানেই বাড়তি শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যের ওপর তার একটি প্রভাব পড়তে বাধ্য। আজকাল রাস্তায় হাঁটতে, গাড়ীতে চলতে, অফিস-আদালত কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেককে এক নিবিষ্ট চিত্তে মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় এটা আমাদের দুর্ঘটনার কারণ। তার চেয়েও বড় কথা এরফলে যাদের প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়ার কথা, তারা সেটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে কি আমরা সকলে সকলের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছি, নাকি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হচ্ছি। পিতা-মাতা হিসেবে মোবাইল ডিভাইসে আমরা যত বেশী সময় ব্যয় করব, আমাদের সন্তান এবং পরিবার তত কম সময় পাবে। সময়ের আকালের যুগে এটা সময়ের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। দুয়েক দিনে হয়তো এর প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে না; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অবশ্যই এর একটি প্রভাব পড়বে- পিতা-মাতা-সন্তান এবং পরিবারের ওপর। এজন্য আমাদের আরও গবেষণা এবং বিশ্লেষণ দরকার। তবে এখন সকলের জন্য একটি বার্তা অত্যন্ত পরিস্কার- মোবাইল ডিভাইসসমূহ ভেবে-চিন্তে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রত্যেক পরিবারের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য হয়তো একই পরামর্শ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে সকলেরই খেয়াল রাখা উচিতঃ
১) পথ চলতে, যানবাহন চালনা এবং চলাচলের সময় মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। কারণ এটা অনেক দুর্ঘটনা থেকে আমাদের রক্ষা করবে।
২) কোন কিছু শেখার সময় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় (যেমন স্কুলে হোম ওয়ার্ক করার সময় কিংবা অফিসের কাজের সময়)মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত।
৩) সামাজিক অনুষ্ঠান, পার্টিতে, কারও সঙ্গে আলাপচারিতার সময় কিংবা কোথাও বেড়াতে গিয়ে মোবাইল ডিভাইসে ডুবে না থাকাই উত্তম। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সম্পর্ক আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল ডিভাইস দিয়ে এটা বিনষ্ট করা একান্তই বোকামি।       
অতএব আমাদের চারপাশে কি ঘটছে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরী। প্রিয়জনদের সময় দেওয়া এবং তাদের প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সকলের জন্যই হিতকর।  
তথ্যসূত্রঃ https://www.commonsensemedia.org

Saturday 14 May 2016

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা

গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকেনিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনেএকটি গুরুত্বপূর্ণ রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। অনেকরই হয়তো এটা নজর এড়িয়ে গিয়েছে। রিভিউয়ের বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা।আমরা সচরাচর বাংলাদেশে চিকিৎসকদের ওপর রোগী কিংবা তার আত্মীয়স্বজনদের হামলার খবর শুনে অভ্যস্ত।

কিন্তু বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কিন্তু এর সমাধান এখনও অস্পষ্ট। কারণ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রতি মন্দ আচরণ, অত্যাচার কিংবা সহিংসতার খবর অনেকক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না, ভুক্তভোগীরাও এটা জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন। এজন্য এটা নিয়ে তেমন কোন বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা গবেষণা হয় না।
    
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বোস্টনের একটি বিখ্যাত হাসপাতালের শল্য চিকিৎসককে তারই এক রোগীর ছেলে প্রকাশ্যে গুলি করে এবং এতে ওই চিকিৎসক মৃত্যু বরণ করেন। ঘটনাটি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সকলের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এটা নিয়ে ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের চিকিৎসক জেমস ফিলিপস নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের রিভিউটি লিখেছেন।
   
এরকম হত্যাকাণ্ড প্রতিদিন ঘটে না সত্য; কিন্তু চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিনিয়ত রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের দুর্ব্যবহার, গালি-গালাজ, শারীরিক হামলা, যৌন হয়রানি কিংবা সহিংস আচরণের শিকার হতে হয়। স্বাস্থ্যকর্মীগণ মানবতার স্বার্থে এধরণের অন্যায় আচরণ অগ্রাহ্য করেই নিরবিচ্ছিন্ন সেবাদান করে যান। ডাঃ ফিলিপসের ভাষায়, “সাধারণ মানুষ যতটুকু জানতে পারে আসলে কর্মস্থলে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তার চেয়ে অনেক বেশী নিগ্রহ এবং অন্যায় আচরণের শিকার হয়ে থাকেনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এসম্পর্কে খুব কমই সচেতন বলে মনে হয়। এরজন্য এ বিষয়ে একটি আদ্যপান্ত অনুসন্ধান হওয়া দরকার এবং সমাধানের পথ খোঁজা জরুরীতিনি আরও বলেছেন, “মার্কিন আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের পরে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ কর্মস্থলে কাজ করছেন; কিন্তু কিভাবে এটা মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে তাদের খুব কমই ধারণা আছে এবং কোন প্রশিক্ষণই নেই। এখন এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় এসেছে”।    

সহিংসতার যে হিসেব নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে তা আসলেই ভয়ংকর। যেমনঃ
 
  • ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কর্মস্থলে যত শারীরিক নিগ্রহের ঘটনার প্রমাণ মিলেছে তার ৭৫ শতাংশই ঘটেছে হাসপাতাল-ক্লিনিকে।
  • জরুরী বিভাগে কর্মরত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন কোন না কোন পর্যায়ে সহিংস আচরণের শিকার হয়েছেন।
  • গত বছর প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুসারে সারাদেশে ৭৮% জরুরী বিভাগের চিকিৎসক কর্মস্থলে নিগ্রহের শিকার হয়েছেণ।
  • জরুরী বিভাগের ১০০% নার্স মৌখিক খারাপ আচরণ বা গালি-গালাজের অভিযোগ করেছেন এবং ৮২% নার্স বলেছেন তারা শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
  • মানসিক রোগের চিকিৎসকদের মধ্যে শতকরা ৪০ জন শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।  
  • বস্তুত সাইকিয়াট্রি বিভাগে নিগৃহীত হওয়ার হার অন্যান্য কর্মস্থলের চেয়ে ৬৯ গুণ বেশী।   
  • যে সকল স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ীতে যেয়ে সেবা দিয়ে থাকেন তাদের মধ্যে বছরে শতকরা ৬১ জন নিগৃহীত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। 
  • পারিবারিক চিকিৎসক বা জিপিরাও ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। তবে তাদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য সংগৃহীত হয়নি।

অবশ্য এই তথ্য পরিপূর্ণ নয়। প্রকৃত সমস্যা হয়তো এর চেয়ে আরও বেশী এবং জটিল হতে পারে। জরুরি বিভাগ, হাসপাতালের ইনডোর এবং সাইকিয়াট্রি বিভাগ থেকেই সবচেয়ে বেশী তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কারণ এই জায়গাগুলিতেই বেশী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে নার্সদের ওপরেই বেশী উৎপাত এবং অত্যাচার করা হয়।

স্বভাবতই সকলের মনে প্রশ্ন  কেন এমন ঘটছে?

মূলত যে সকল রোগী কিংবা রোগীর স্বজন এ ধরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তারা সাধারনত মানসিকভাবে বিকৃত, মাদকাসক্ত, স্মৃতিবিভ্রম কিংবা স্মৃতিভ্রংশতা রোগে আক্রান্ত অথবা কোন না কোন ধরণের মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। এছাড়া চিকিৎসকের সাক্ষাত পেতে দীর্ঘ বিলম্ব, অতিরিক্ত রোগীর ভিড়, হাসপাতালের খাবারের মান খারাপ, রোগ সম্পর্কে দুঃসংবাদ শোনা, খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা, কারা বন্দী কিংবা পুলিশের কাস্টডিতে থাকা ইত্যাদি কারণেও নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে।

অনেকে মনে করছেন মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীরা এধরণের অপকর্মের সঙ্গে বেশী জড়িত, এটা ভাবার কোন কারণ নয়। কারণ কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে নিগ্রহের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অর্ধেকই পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী। আর অনেক ঘটনাই স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্তৃপক্ষের নিকটে কখনই জানায় না।
       
কর্তৃপক্ষের  নিকট হয়রানির অভিযোগ না করা ধরণের সমস্যা নিরসনের পথে একটি বড় অন্তরায়

দেখা যাচ্ছে মাত্র ৩০% নার্স এবং ২৬% চিকিৎসক কর্তৃপক্ষের  নিকট হাসপাতালে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন চিকিৎসা পেশার সংস্কৃতি হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন ধরেই নিয়েছেন ধরণের নিগ্রহ পেশার অংশ কিন্তু দিনে দিনে এর সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে সঙ্গত কারণেই গবেষকগণ মনে করছেন মূল সমস্যা হিমবাহের মতো দৃশ্যমান অংশের চেয়ে আরও গভীর এবং ব্যাপক আর আইনের দৃষ্টিতে কোনটি প্রকৃত নিগ্রহ আর কোনটি নয়, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে কারণ যারা মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছে তাদের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাকৃত তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য সব ধরণের স্বাস্থ্যকর্মীর কার্যক্রম নিরাপদ করার জন্য কারও দ্বারা কোন ধরণের অভব্য কিংবা নিগ্রহমূলক আচরণ কোন অবস্থাতেই বরদাশত করা কাম্য নয় আর এজন্যই মানসিকভাবে সুস্থ কিংবা অসুস্থ রোগী কিংবা রোগীর স্বজন যেই সহিংস আচরণ করুক না কেন তা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা জরুরী

হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে অসুস্থ ব্যক্তিরাই আসেন এটা মনে করাই সঙ্গত যে এরা এবং এদের স্বজনেরা যেকোনো সময় অসঙ্গত সহিংস আচরণ করতে পারেন; কারণ এদের মানসিক স্থিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক থাকে না হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের এই সচেতনতা থাকলে এবং যেকোন অসঙ্গত আচরণ সম্পর্কে রিপোর্ট করলে এবং রোগীদের নথিতে তা লিখিত থাকলে ভবিষ্যতে ধরণের অপ্রিয় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব             

কর্মস্থলে সহিংস আচরণ পরিহার করার জন্য কি করণীয় তা নিয়ে আসলে তেমন কোন গবেষণা হয়নি আর এটা প্রতিরোধের জন্য তেমন কোন মহৌষধও কারও জানা নেই প্রতিটি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের কিছু নিজস্বতা রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের আচার-আচরণও কোন বাধা-ধরা নিয়ম দ্বারা পরিচালিত নয় ফলে হাসপাতালসমূহকে সহিংসতামুক্ত রাখার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রাখাই সঙ্গত বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন রক্তবাহিত জীবাণু প্রতিরোধের জন্য আমরা যেমন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকি, হাসপাতাল-ক্লিনিকে সহিংসতা সম্পর্কেও তেমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যেকোনো ধরণের অসঙ্গত নিগ্রহমূলক আচরণের জন্যজিরো টলারেন্সনীতিই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হচ্ছে হাসপাতাল-ক্লিনিকের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তিই প্রবেশ করবে তার একটি স্পস্ট ধারণা থাকা জরুরী যে এখানে প্রত্যেকের যেকোনো ধরণের হুমকিমূলক অসঙ্গত এবং সহিংস আচরণ থেকে মুক্ত এবং নিরাপদ থাকার অধিকার রয়েছে
   
সমাধান হিসেবে অনেকেই অনেক ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছেঃ আগ্রাসী মনোভাব এবং রাগ কমানোর চিকিৎসা প্রদান, স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দান, সংবেদনশীল এলাকায় বেড়া কিংবা প্রাচীর দেওয়া, হাসপাতালের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিকিউরটি ক্যামেরার আওতায় রাখা, মেটাল ডিটেক্টর স্থাপন করা, হাসপাতালে প্রশিক্ষিত প্রহরী রাখা, হাসপাতালে যেকোনো ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ইত্যাদি এছাড়া হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোন স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অপরাধে দণ্ড দানের জন্য কি আইন প্রণয়ন করা যায় সেটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে

তবে এসবের পাশাপাশি হাসপাতালসমূহের সেবার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিশ্চিত করা, রোগীর ভিড় এবং চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষার সময় কমানো, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুসম কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা এবং রোগীদের বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দ্রুত প্রদানের ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সর্বোপরি প্রতিটি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে সহিংস আচরণ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে এই কমিটির কাজ হবে যে কোন ধরণের সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানানো এছাড়া প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী যেন নির্ভয়ে তার প্রতি ঘটে যাওয়া যে কোন সহিংস আচরণ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন তার নিশ্চয়তা প্রদান করা

পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যথাযথ সুপারভিশন থাকলে সহিংস আচরণ প্রতিরোধ করা কঠিন কোন কাজ নয় তবে সকলেই মনে করছেন হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা চিকিৎসা কর্মীদের কর্মস্থলকে যেকোন ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা এবং নিগ্রহ থেকে নির্ঝঞ্ঝাট এবং নিরাপদ করার জন্য আরও বিশ্লেষণ এবং গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে  

( সম্পর্কে যারা আরও বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তারা নীচের তথ্যসূত্রে দেওয়া নিবন্ধটি পড়তে পারেন)

তথ্যসূত্রঃ  Phillips JP. Workplace Violence against Health Care Workers in the United States. New England Journal of Medicine. 2016; 374(17):1661-9. 


শনিবার, 14 মে 2016