শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Saturday 14 May 2016

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা

গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকেনিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনেএকটি গুরুত্বপূর্ণ রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। অনেকরই হয়তো এটা নজর এড়িয়ে গিয়েছে। রিভিউয়ের বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা।আমরা সচরাচর বাংলাদেশে চিকিৎসকদের ওপর রোগী কিংবা তার আত্মীয়স্বজনদের হামলার খবর শুনে অভ্যস্ত।

কিন্তু বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কিন্তু এর সমাধান এখনও অস্পষ্ট। কারণ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রতি মন্দ আচরণ, অত্যাচার কিংবা সহিংসতার খবর অনেকক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না, ভুক্তভোগীরাও এটা জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন। এজন্য এটা নিয়ে তেমন কোন বিচার-বিশ্লেষণ কিংবা গবেষণা হয় না।
    
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বোস্টনের একটি বিখ্যাত হাসপাতালের শল্য চিকিৎসককে তারই এক রোগীর ছেলে প্রকাশ্যে গুলি করে এবং এতে ওই চিকিৎসক মৃত্যু বরণ করেন। ঘটনাটি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সকলের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এটা নিয়ে ব্যাপক তদন্ত শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের চিকিৎসক জেমস ফিলিপস নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের রিভিউটি লিখেছেন।
   
এরকম হত্যাকাণ্ড প্রতিদিন ঘটে না সত্য; কিন্তু চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিনিয়ত রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের দুর্ব্যবহার, গালি-গালাজ, শারীরিক হামলা, যৌন হয়রানি কিংবা সহিংস আচরণের শিকার হতে হয়। স্বাস্থ্যকর্মীগণ মানবতার স্বার্থে এধরণের অন্যায় আচরণ অগ্রাহ্য করেই নিরবিচ্ছিন্ন সেবাদান করে যান। ডাঃ ফিলিপসের ভাষায়, “সাধারণ মানুষ যতটুকু জানতে পারে আসলে কর্মস্থলে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তার চেয়ে অনেক বেশী নিগ্রহ এবং অন্যায় আচরণের শিকার হয়ে থাকেনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এসম্পর্কে খুব কমই সচেতন বলে মনে হয়। এরজন্য এ বিষয়ে একটি আদ্যপান্ত অনুসন্ধান হওয়া দরকার এবং সমাধানের পথ খোঁজা জরুরীতিনি আরও বলেছেন, “মার্কিন আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের পরে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই সবচেয়ে সহিংসতাপূর্ণ কর্মস্থলে কাজ করছেন; কিন্তু কিভাবে এটা মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে তাদের খুব কমই ধারণা আছে এবং কোন প্রশিক্ষণই নেই। এখন এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় এসেছে”।    

সহিংসতার যে হিসেব নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে তা আসলেই ভয়ংকর। যেমনঃ
 
  • ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কর্মস্থলে যত শারীরিক নিগ্রহের ঘটনার প্রমাণ মিলেছে তার ৭৫ শতাংশই ঘটেছে হাসপাতাল-ক্লিনিকে।
  • জরুরী বিভাগে কর্মরত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জন কোন না কোন পর্যায়ে সহিংস আচরণের শিকার হয়েছেন।
  • গত বছর প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুসারে সারাদেশে ৭৮% জরুরী বিভাগের চিকিৎসক কর্মস্থলে নিগ্রহের শিকার হয়েছেণ।
  • জরুরী বিভাগের ১০০% নার্স মৌখিক খারাপ আচরণ বা গালি-গালাজের অভিযোগ করেছেন এবং ৮২% নার্স বলেছেন তারা শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।
  • মানসিক রোগের চিকিৎসকদের মধ্যে শতকরা ৪০ জন শারীরিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।  
  • বস্তুত সাইকিয়াট্রি বিভাগে নিগৃহীত হওয়ার হার অন্যান্য কর্মস্থলের চেয়ে ৬৯ গুণ বেশী।   
  • যে সকল স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ীতে যেয়ে সেবা দিয়ে থাকেন তাদের মধ্যে বছরে শতকরা ৬১ জন নিগৃহীত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। 
  • পারিবারিক চিকিৎসক বা জিপিরাও ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। তবে তাদের সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য সংগৃহীত হয়নি।

অবশ্য এই তথ্য পরিপূর্ণ নয়। প্রকৃত সমস্যা হয়তো এর চেয়ে আরও বেশী এবং জটিল হতে পারে। জরুরি বিভাগ, হাসপাতালের ইনডোর এবং সাইকিয়াট্রি বিভাগ থেকেই সবচেয়ে বেশী তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কারণ এই জায়গাগুলিতেই বেশী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় স্বাস্থ্য কর্মীদের মধ্যে নার্সদের ওপরেই বেশী উৎপাত এবং অত্যাচার করা হয়।

স্বভাবতই সকলের মনে প্রশ্ন  কেন এমন ঘটছে?

মূলত যে সকল রোগী কিংবা রোগীর স্বজন এ ধরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তারা সাধারনত মানসিকভাবে বিকৃত, মাদকাসক্ত, স্মৃতিবিভ্রম কিংবা স্মৃতিভ্রংশতা রোগে আক্রান্ত অথবা কোন না কোন ধরণের মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। এছাড়া চিকিৎসকের সাক্ষাত পেতে দীর্ঘ বিলম্ব, অতিরিক্ত রোগীর ভিড়, হাসপাতালের খাবারের মান খারাপ, রোগ সম্পর্কে দুঃসংবাদ শোনা, খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা, কারা বন্দী কিংবা পুলিশের কাস্টডিতে থাকা ইত্যাদি কারণেও নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে।

অনেকে মনে করছেন মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীরা এধরণের অপকর্মের সঙ্গে বেশী জড়িত, এটা ভাবার কোন কারণ নয়। কারণ কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে নিগ্রহের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অর্ধেকই পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী। আর অনেক ঘটনাই স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্তৃপক্ষের নিকটে কখনই জানায় না।
       
কর্তৃপক্ষের  নিকট হয়রানির অভিযোগ না করা ধরণের সমস্যা নিরসনের পথে একটি বড় অন্তরায়

দেখা যাচ্ছে মাত্র ৩০% নার্স এবং ২৬% চিকিৎসক কর্তৃপক্ষের  নিকট হাসপাতালে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ জানিয়েছেন চিকিৎসা পেশার সংস্কৃতি হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মীরা যেন ধরেই নিয়েছেন ধরণের নিগ্রহ পেশার অংশ কিন্তু দিনে দিনে এর সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে সঙ্গত কারণেই গবেষকগণ মনে করছেন মূল সমস্যা হিমবাহের মতো দৃশ্যমান অংশের চেয়ে আরও গভীর এবং ব্যাপক আর আইনের দৃষ্টিতে কোনটি প্রকৃত নিগ্রহ আর কোনটি নয়, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে কারণ যারা মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছে তাদের আচরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাকৃত তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হচ্ছে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য সব ধরণের স্বাস্থ্যকর্মীর কার্যক্রম নিরাপদ করার জন্য কারও দ্বারা কোন ধরণের অভব্য কিংবা নিগ্রহমূলক আচরণ কোন অবস্থাতেই বরদাশত করা কাম্য নয় আর এজন্যই মানসিকভাবে সুস্থ কিংবা অসুস্থ রোগী কিংবা রোগীর স্বজন যেই সহিংস আচরণ করুক না কেন তা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা জরুরী

হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে অসুস্থ ব্যক্তিরাই আসেন এটা মনে করাই সঙ্গত যে এরা এবং এদের স্বজনেরা যেকোনো সময় অসঙ্গত সহিংস আচরণ করতে পারেন; কারণ এদের মানসিক স্থিতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক থাকে না হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের এই সচেতনতা থাকলে এবং যেকোন অসঙ্গত আচরণ সম্পর্কে রিপোর্ট করলে এবং রোগীদের নথিতে তা লিখিত থাকলে ভবিষ্যতে ধরণের অপ্রিয় পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব             

কর্মস্থলে সহিংস আচরণ পরিহার করার জন্য কি করণীয় তা নিয়ে আসলে তেমন কোন গবেষণা হয়নি আর এটা প্রতিরোধের জন্য তেমন কোন মহৌষধও কারও জানা নেই প্রতিটি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের কিছু নিজস্বতা রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের আচার-আচরণও কোন বাধা-ধরা নিয়ম দ্বারা পরিচালিত নয় ফলে হাসপাতালসমূহকে সহিংসতামুক্ত রাখার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রাখাই সঙ্গত বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন রক্তবাহিত জীবাণু প্রতিরোধের জন্য আমরা যেমন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকি, হাসপাতাল-ক্লিনিকে সহিংসতা সম্পর্কেও তেমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যেকোনো ধরণের অসঙ্গত নিগ্রহমূলক আচরণের জন্যজিরো টলারেন্সনীতিই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হচ্ছে হাসপাতাল-ক্লিনিকের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তিই প্রবেশ করবে তার একটি স্পস্ট ধারণা থাকা জরুরী যে এখানে প্রত্যেকের যেকোনো ধরণের হুমকিমূলক অসঙ্গত এবং সহিংস আচরণ থেকে মুক্ত এবং নিরাপদ থাকার অধিকার রয়েছে
   
সমাধান হিসেবে অনেকেই অনেক ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছেঃ আগ্রাসী মনোভাব এবং রাগ কমানোর চিকিৎসা প্রদান, স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দান, সংবেদনশীল এলাকায় বেড়া কিংবা প্রাচীর দেওয়া, হাসপাতালের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিকিউরটি ক্যামেরার আওতায় রাখা, মেটাল ডিটেক্টর স্থাপন করা, হাসপাতালে প্রশিক্ষিত প্রহরী রাখা, হাসপাতালে যেকোনো ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ইত্যাদি এছাড়া হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোন স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অপরাধে দণ্ড দানের জন্য কি আইন প্রণয়ন করা যায় সেটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে

তবে এসবের পাশাপাশি হাসপাতালসমূহের সেবার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিশ্চিত করা, রোগীর ভিড় এবং চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষার সময় কমানো, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুসম কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা এবং রোগীদের বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দ্রুত প্রদানের ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সর্বোপরি প্রতিটি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে সহিংস আচরণ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে এই কমিটির কাজ হবে যে কোন ধরণের সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান করে তার প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানানো এছাড়া প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী যেন নির্ভয়ে তার প্রতি ঘটে যাওয়া যে কোন সহিংস আচরণ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন তার নিশ্চয়তা প্রদান করা

পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যথাযথ সুপারভিশন থাকলে সহিংস আচরণ প্রতিরোধ করা কঠিন কোন কাজ নয় তবে সকলেই মনে করছেন হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা চিকিৎসা কর্মীদের কর্মস্থলকে যেকোন ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা এবং নিগ্রহ থেকে নির্ঝঞ্ঝাট এবং নিরাপদ করার জন্য আরও বিশ্লেষণ এবং গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে  

( সম্পর্কে যারা আরও বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তারা নীচের তথ্যসূত্রে দেওয়া নিবন্ধটি পড়তে পারেন)

তথ্যসূত্রঃ  Phillips JP. Workplace Violence against Health Care Workers in the United States. New England Journal of Medicine. 2016; 374(17):1661-9. 


শনিবার, 14 মে 2016

No comments:

Post a Comment