“অ্যাডিকশন” বা আসক্তি শব্দটি
বাবা-মায়ের নিকট ভয়ের বিষয়। কোন বাবা-মা তার সন্তান কোন কিছুতে আসক্ত হোক, এটা কখনই চান না। আসক্তির প্রশ্ন আসলে আমরা সব সময়
মদ-গাঁজা কিংবা ইয়াবা-হেরোইনের কথা ভাবি। কিন্তু
এসব ছাড়াও অনেক রকমের আসক্তি হতে পারে। “অ্যাডিকশন” বা আসক্তি বলতে কোন কিছু সেবন কিংবা গ্রহণের (যেমন-হেরোইন) কিংবা করার(যেমন-জুয়া
খেলা) অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা এবং সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। সেই অর্থে আজকাল শিশু-কিশোর
কিংবা বড়দের অনেকেই স্মার্ট ফোন বা মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্ত।
কিছুদিন আগে কমন সেন্স
মিডিয়া ১২৪০ জন পিতা-মাতা এবং তাদের সন্তানদের ওপরে একটি জরীপ করেছে। এর ফলাফলে দেখা
যায়-
• শতকরা ৫০ জন শিশু-কিশোর মনে করে তাদের মোবাইল ডিভাইসের
প্রতি আসক্তি রয়েছে(এবং এদের ২৮% মনে করে তাদের বাবা-মায়েরাও আসক্ত)।
• ২৭% বাবা-মা মনে করেন তারা মোবাইল ডিভাইসের প্রতি
আসক্ত (এবং ৫৯% মনে করেন তাদের সন্তানেরাও আসক্ত)।
• ৬৬% বাবা-মা মনে করেন তাদের সন্তানেরা মোবাইল ডিভাইসের
পিছনে অতিরিক্ত সময় অপচয় করছে। ৫২% সন্তান বাবা-মায়েদের এমন ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ
করেছে।
• ৪৮% পিতামাতা
এবং ৭২% সন্তান মনে করে যেকোন টেক্সট মেসেজ কিংবা অন্য নোটিফিকেশন আসলে সঙ্গে
সঙ্গে তার জবাব দেওয়া উচিৎ।
• ৬৯% বাবা-মা এবং ৭৮% সন্তান তাদের মোবাইল ডিভাইস
ঘণ্টায় ঘণ্টায় চেক করে দেখে।
• অবশ্য ৫০% বাবা-মা এবং ৩৩% সন্তান স্বীকার করেছে
যে তারা মাঝে মাঝে মোবাইলের পিছনে সময় কম ব্যয় করার চেষ্টা করে।
বলতেই হবে যে জরীপের
ফলাফল বেশ চিন্তা করার মতো। পিতা-মাতা এবং সন্তান-সন্ততি উভয়েই একমত যে মোবাইল ডিভাইস
তাদের অনেক সময় নিয়ে নিচ্ছে।
অবশ্য এটা ঠিক যে
কেউ যদি ইন্সটাগ্রাম কিংবা ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাহলে হয়তো আপাত দৃষ্টিতে তার ইয়াবা কিংবা হেরোইন সেবনের মতো তেমন কোন ক্ষতি
হয়না। এজন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির এধরণের ব্যবহারকে কেউ আসক্তি হিসেবে গণ্য করতে প্রস্তুত
নন। যদিও এধরণের প্রযুক্তি ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া কি সেসম্পর্কে কার্যত
আমাদের কোন অভিজ্ঞতা এখনও নেই। আর এ নিয়ে তেমন কোন গবেষণার ফলাফলও আমাদের হাতে নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে এসকল
ডিভাইস আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করছে, মানসিকভাবে আমাদেরকে
অন্যপথে চালিত করছে। এটা বোঝার জন্য তেমন পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। আমাদের মনঃসংযোগ
করার, একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতার
এবং স্মৃতি ধারণের যে ক্ষমতা, তা বিচার করলে বহুকাজ
একসঙ্গে করার চেষ্টা বা “মালটি-টাস্কিং” মানেই হচ্ছে প্রয়োজনীয়
অনেক কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করতে না পারা। আর প্রয়োজনীয় কাজের প্রতি মনোনিবেশ না করা
মানেই তার একটি প্রতিফল কিংবা প্রতিক্রিয়া ঘটা।
শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে
এটার প্রকাশ ঘটছে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে। ছাত্র-ছাত্রীরা যদি সোশ্যালমিডিয়া
নিয়ে বেশী সময় ব্যয় করে, অবশ্যই তাদের লেখাপড়ার
সময় কমে যাচ্ছে। বড়রা যদি মোবাইল ডিভাইসে বেশী সময় দিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করতে চায়,
অবশ্যই তাদের প্রকৃত সামাজিক
সম্পর্ক রক্ষার মান এবং সময়ে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে এসকল ডিভাইস আমাদের ঘুমের
সময় নিয়ে নিচ্ছে। আর নির্ঘুম রাত মানেই বাড়তি শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং শেষ পর্যন্ত
স্বাস্থ্যের ওপর তার একটি প্রভাব পড়তে বাধ্য। আজকাল রাস্তায় হাঁটতে, গাড়ীতে চলতে, অফিস-আদালত কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেককে এক নিবিষ্ট
চিত্তে মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় এটা আমাদের দুর্ঘটনার
কারণ। তার চেয়েও বড় কথা এরফলে যাদের প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়ার কথা, তারা সেটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে কি আমরা সকলে
সকলের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছি, নাকি সামাজিকভাবে
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হচ্ছি। পিতা-মাতা হিসেবে মোবাইল ডিভাইসে আমরা যত বেশী সময়
ব্যয় করব, আমাদের সন্তান এবং
পরিবার তত কম সময় পাবে। সময়ের আকালের যুগে এটা সময়ের সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। দুয়েক
দিনে হয়তো এর প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে না; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অবশ্যই এর একটি প্রভাব পড়বে- পিতা-মাতা-সন্তান এবং পরিবারের
ওপর। এজন্য আমাদের আরও গবেষণা এবং বিশ্লেষণ দরকার। তবে এখন সকলের জন্য একটি বার্তা
অত্যন্ত পরিস্কার- মোবাইল ডিভাইসসমূহ ভেবে-চিন্তে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
প্রত্যেক ব্যক্তি
এবং প্রত্যেক পরিবারের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য হয়তো একই পরামর্শ
প্রযোজ্য নয়। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে সকলেরই খেয়াল রাখা উচিতঃ
১) পথ চলতে,
যানবাহন চালনা এবং চলাচলের
সময় মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। কারণ এটা অনেক দুর্ঘটনা থেকে আমাদের রক্ষা
করবে।
২) কোন কিছু শেখার
সময় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় (যেমন স্কুলে হোম ওয়ার্ক করার সময় কিংবা অফিসের কাজের
সময়)মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত।
৩) সামাজিক অনুষ্ঠান,
পার্টিতে, কারও সঙ্গে আলাপচারিতার সময় কিংবা কোথাও বেড়াতে
গিয়ে মোবাইল ডিভাইসে ডুবে না থাকাই উত্তম। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সম্পর্ক আমাদের
শারীরিক এবং মানসিক সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল ডিভাইস দিয়ে এটা বিনষ্ট করা
একান্তই বোকামি।
অতএব আমাদের চারপাশে
কি ঘটছে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া জরুরী। প্রিয়জনদের সময় দেওয়া এবং তাদের প্রতি পরিপূর্ণ
মনোযোগ দেওয়া সকলের জন্যই হিতকর।
তথ্যসূত্রঃ https://www.commonsensemedia.org
No comments:
Post a Comment