শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Monday 29 February 2016

নিখিলের পানে নিখিল

অবশেষে নিখিল চলে গেল। 

খবরটা পড়ে অনেকক্ষণ মন খুব খারাপ ছিল।
কিন্তু নিখিলের সঙ্গে আমার অনেক ভাল সময় কেটেছে। নিখিল আমার স্কুলের বন্ধু। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল। মেধাবী ছাত্র ছিল। কথা বলত অসাধারণ গুছিয়ে। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো সুন্দর। আমার ওকে রীতিমতো হিংসে হতো। কিন্তু নিখিল ছিল অসাধারণ বন্ধুবৎসল।ক্লাস এইটে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওদের বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল বাজিতপুর হাটের পাশে। ওই বছরই আমি বাবার নিকট থেকে একটা সাইকেল পেয়েছিলাম। ছুটির দিনে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগতো। তখন টাঙ্গাইল শহর খুব নিরিবিলি আর সবুজ ঘেরা ছিল। আমার যাওয়ার মতো জায়গা খুব বেশী ছিল না আমাদের বাসস্ট্যান্ডের পাশের বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে বের হলে একটু পরেই সরু রাস্তা চলে গেছে বাজিতপুর। দুপাশে ধানক্ষেত আর নানারকম গাছে ঘেরা। সোজা পৌঁছে যেতাম ওদের বাসায়। টাঙ্গাইল বাজিতপুরের শাড়ী বিখ্যাত। হাট বসে খুব ভোরে। সারাদিন হাটের দোকানগুলো ফাঁকা পড়ে থাকতোকিন্তু নিখিলের সঙ্গে গল্পে ভরে উঠত সময়টা। তারপর স্কুলজীবন শেষে কে কোথায় চলে গেলাম।

অনেকদিন দেখা নেই।

কর্মস্থল রাজশাহী থেকে সিল্কসিটি ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলাম। কেন যেন টাঙ্গাইলের কাছে যেয়ে ট্রেন থেমে গেল। শুনলাম আর আজ ঢাকা যাওয়া হবেনা। কি আর করা ট্রেন থেকে নেমে বাজিতপুর চলে গেলাম নিখিলদের বাড়ি। জায়গাটা ঠিক চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু নিখিল সেই আগের মতই আছে। বৌদি আর ওর পুত্রকন্যা নিয়ে সংসারী নিখিল।কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম করেছে। সারাবিকেল ওর সঙ্গে স্মৃতিচারণ করে রাতের বাসে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ফিরলাম। কিন্তু মনে হল সেই সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফেরার কথা। আহা! সেই সোনার খাঁচার দিনগুলি। কিন্তু ডায়াবেটিস ওকে বেশ কাবু করে ফেলেছে। তারপর রাজশাহী-ঢাকা আসা যাওয়ার পথে আরও কয়েকবার ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে।    

গতকাল সেই নিখিল নিখিলের পানে চলে গেল। ভাল থেকো বন্ধু।আমাদেরই বা আর কয়দিন বাকী আছে কে জানে? তোমার আত্মা শান্তিতে থাক-এই কামনা করি। 

Saturday 27 February 2016

একবিংশ শতকে শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ

কিছুদিন আগে সিডনিতে এক টিভি চ্যানেলের অফিসের সামনে মায়েরা এক অভিনব প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রতিবাদ হিসেবে তারা প্রকাশ্যে নিজ শিশুদের বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন কারণ ওই টিভি চ্যানেলের এক জনপ্রিয় উপস্থাপক কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন যে, উন্মুক্ত স্থানে শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময় মায়েদের একটু সতর্ক থাকা উচিত কিংবা আড়ালে যাওয়া উচিত। মায়েরা তার কথায় খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তারা বাড়তি আড়ালে কেন যাবেন? যারা স্তন পান করানোকে লজ্জার বিষয় মনে করে তাদের নিশ্চয় মানসিক সমস্যা আছে। বলাবাহুল্য ওই উপস্থাপক ভদ্রলোক পরে মায়েদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে কোন রকমে তাদের ক্ষোভ থেকে রক্ষা পান।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে এটা উল্লেখ করলাম কারণ সম্প্রতি “ল্যানসেট” পত্রিকায় মায়ের বুকের দুধের উপকারিতা নিয়ে একটি বিশেষ সিরিজ প্রকাশ করেছে। 
  
শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ পান করবে-এটা এতই সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনা যে বুকের দুধ পান করানো নিয়ে কেন এত শোরগোল সেটাই অনেকসময় বোধগম্য হয় না। কিন্তু ঘটনাচক্রে পরিস্থিতি এমন   দাঁড়িয়েছে যে, বুকের দুধ পান অভ্যাস করানো একটি বিশাল প্রচারণা অভিযানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আধুনিক হতে গিয়ে এক পর্যায়ে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর প্রয়োজনীয়তাই ভুলতে বসেছিলেন। গত তিন দশকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তারপরেও দেখা যাচ্ছে সব মা যদি তাদের শিশুকে বুকের দুধ পান করাতেন তাহলে আরও ৮২৩,০০০ শিশু এবং ২০,০০০ মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। শুধু তাই নয় এরফলে ৩০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সাশ্রয় হতো।কারণ এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, বুকের দুধ পান করালে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকার ফলে রোগ সংক্রমণ কম হয় এবং শিশুর মেধাশক্তি বেশী হয়; অন্যদিকে বুকের দুধ পান করালে মায়েরা নিজেরাও উপকৃত হন তাদের অতিরিক্ত মেদভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ অন্যান্য ক্রনিক রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। কম আয়ের এবং মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ শিশু এক বছর বুকের দুধ পায় না; উন্নত দেশে মাত্র ২০% শিশু মায়ের দুধ পায়। প্রশ্ন হচ্ছে বুকের দুধ পান করানোর এত উপকারিতা জানার পরেও কেন পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না?

মায়েরা কেন শিশুকে বুকের দুধ পান করান না তার অনেক কারণ রয়েছে এর পেছনে যেমন আছে স্বাস্থ্যগত কিংবা মানসিক কারণ, তেমন আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আর এসব কারণ যে একেবারে অযৌক্তিক, ঠিক তাও বলা যাবে না এছাড়া রয়েছে গুঁড়ো দুধ বানানোর বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মনোহারী বিজ্ঞাপনের আগ্রাসন ফলে একে একে মায়েরা শিশুদের মুখে তুলে দিয়েছেন বোতলের দুধ কিন্তু এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যে খারাপ পরিণতি বয়ে আনছে আমরা বুঝেও তা না বোঝার ভান করছি      

উন্নত দেশসমূহেও এখন মায়েদের বুকের দুধ পান করানোর জন্য নানারকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃত্ব ছুটি ছাড়াও বুকের দুধ পান করানোর জন্য মায়েদের অফিসকালে বিরতি দেওয়া হচ্ছে, ব্রেস্ট পাম্পের জন্য ইনস্যুরেন্স সুবিধা দেওয়া হচ্ছে অফিস আদালতের পরিবেশকে মায়েদের বুকের দুধ পান করানোর অনুকূল করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রচারণা চলছে। আশা করা হচ্ছে এর ফলে বুকের দুধ পান করানোর হার অন্তত ২৫% বাড়বে।

অনেকে বলে থাকেন বুকের দুধ পান করাতে কোন অর্থ ব্যয় হয়না। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা আসলে তেমন নয়। দেশে দেশে বুকের দুধ পান করানোর পথে যে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে তা অতিক্রম করার জন্য ব্যাপক আর্থসামাজিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। নিঃসন্দেহ বুকের দুধ এর যে কোন বিকল্পের চেয়ে পুষ্টির দিক দিয়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিবেচনায়, স্নায়ুতন্ত্র কিংবা এন্ডোক্রিন গ্রন্থির বিকাশের জন্য, অর্থ এবং পরিবেশের জন্য বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। এর প্রস্তুতি, পরিবহন কিংবা সংরক্ষণের জন্য কোন আলাদা মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের দরকার হয় না।    

শুরু থেকে যদি বুকের দুধ পানের প্রচলন না থাকতো এবং আজ যদি এটা কেউ নতুন করে আবিস্কার করতেন, তাহলে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত দুইবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতেন। তাকে একবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো চিকিৎসা বিজ্ঞানে; আরেকবার দেওয়া হতো অর্থনীতিতে। সুস্বাস্থ্যের জন্য “স্তনই শ্রেষ্ঠ” যেমন সত্য; দেশের অর্থনীতির জন্যও তা কল্যাণকর। জরা, দারিদ্র এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে মায়ের বুকের দুধ শিশুর শুধু প্রথম টীকাই নয়; এটা তার শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সক্ষমতার জন্য টেকসই বিনিয়োগ।

বুকের দুধ পান করানোর এত উপকারিতার কথা জানার পরেও বুকের দুধ পান করানোর প্রতি আধুনিক মায়েদের অনীহা লক্ষণীয়। মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শিশুদের জন্য বিকল্প দুধ বাজারজাত করে বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ প্রতি বছর তাদের পকেট ভারী করছে। ২০১৪ সালের হিসেবে দেখা যায় শিশুদের গুঁড়ো দুধ বিক্রি করে কোম্পানিগুলো প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। আর শিশুদের মায়ের বুকের দুধ পান না করানোর ফলে সব মিলিয়ে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আগেই বলা হয়েছে তার মুল্য ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশী। অর্থাৎ বলা যায় বুকের দুধ পান করালে শুধু শিশুর উপকার নয়; এর ফলে শিশুর মা, তাদের সমাজ এবং পরিবেশ সামগ্রিকভাবে উপকৃত হয়। আর এটা অর্জনের জন্য আমাদের সামজিক সচেতনতা যেমন দরকার; তেমন দরকার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং দৃঢ় সমর্থন।


মূল বক্তব্যঃ 
১) বুকের দুধ পান করলে শিশুদের রোগব্যাধি কম হয় এবং শিশুর অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা কমে যায়। তাদের দাঁতের গঠন এবং সজ্জা ভাল হয়, মেধাশক্তি বেশী হয়।বুকের দুধ পানের এই উপকারিতা পরবর্তী সময়েও দেখতা পাওয়া যায়। কারণ যেসব শিশু দীর্ঘ সময় মায়ের বুকের দুধ পান করে তাদের মেদভুঁড়ি এবং ডায়াবেটিস কম হতে দেখা যায়।
২) বুকের দুধ পান করালে মায়ের নিজেরও উপকার হয়। বুকের দুধ পান করানো একধরণের প্রাকৃতিক জন্ম বিরতিকরণ প্রক্রিয়া। বুকের দুধ পান করালে মায়েরও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়; তাদের ওভারি এবং স্তন ক্যানসার হওয়ার আশংকা কমে যায়।
৩) কম এবং মধ্যম আয়ের দেশসমূহের চেয়ে বেশী আয়ের দেশে বুকের দুধ পান করানোর হার এবং সময়কাল কম। তবে কম এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতেও প্রতি ৩ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ১ জন ছয় মাস পুরোপুরি বুকের দুধ পান করে থাকে।
৪) আরও অধিকসংখ্যক মায়েরা যদি শিশুদের বুকের দুধ পান করাতেন তাহলে প্রতি বছর ৮২৩,০০০ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব এবং প্রতি বছর ২০,০০০ স্তন ক্যানসারে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়।
৫) আধুনিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য নিখুঁত নিরাপদ ওষুধ।
৬) মানবশিশুকে বুকের দুধ পান করানো একটি অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটা ধনী কিংবা গরীব সকল দেশের জন্যই জরুরী। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে ক্ষেত্রে মায়েদের বুকের দুধ পান করানো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।  
     
তথ্যসূত্রঃ
১)   Victora CG, Bahl R, Barros AJD, França GVA, Horton S, Krasevec J, et al. Breastfeeding in the 21st century: epidemiology, mechanisms, and lifelong effect. The Lancet.387 (10017):475-90.
২)   Rollins NC, Bhandari N, Hajeebhoy N, Horton S, Lutter CK, Martines JC, et al. Why invest, and what it will take to improve breastfeeding practices? The Lancet.387 (10017):491-504.

৩)   Breastfeeding: achieving the new normal. The Lancet.387 (10017):404.

Thursday 25 February 2016

মোবাইল ফোন এবং পুরুষের বীর্য

সন্তান না হওয়ার পেছনে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের সমস্যা দেখা যায়। কোন কোন পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে দিনে দিনে পুরুষের বীর্যের মান কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তার তেমন কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সন্দেহের তালিকায় অনেক কিছুই আছে। তবে অনেকে ইদানীং মোবাইল ফোন থেকে নিঃসৃত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনকে দায়ী করছেন। এটা সঠিক কিনা তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে সম্প্রতি ইসরাইলের ১০৬ জন পুরুষের বীর্য পরীক্ষা করে গবেষকগণ একটি ফলাফল দিয়েছেন। বলা হচ্ছে এদের মধ্যে যারা দিনে এক ঘণ্টার বেশী সময় মোবাইল ফোনে কথা বলে থাকেন আর কোমরের ৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যেই যাদের ফোন রাখা থাকে তাদের শতকরা ৪৭ জনের বীর্যে শুক্রাণুর ঘনত্ব কম। মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া অবস্থায় যারা কথা বলেনতাদের বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ আরও কম। অবশ্য গবেষকগণ মোবাইল ফোনকে সরাসরি পুরুষের বীর্যহীনতার জন্য দায়ী করেননি। কিন্তু তারা এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সঙ্গে পুরুষের বীর্যের এমন সর্বনাশের আসলেই কোন কারণ আছে কিনা, তা বড় আকারে পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন।


তথ্যসুত্রঃ Zilberlicht A, Wiener-Megnazi Z, Sheinfeld Y, Grach B, Lahav-Baratz S, Dirnfeld M. Habits of cell phone usage and sperm quality - does it warrant attention? Reproductive biomedicine online. 2015;31(3):421-6.

Tuesday 23 February 2016

টাক এবং প্রোস্টেট ক্যানসার

শৈশবে টাক নিয়ে একটি ছড়া মনে হয় সকলেরই পড়া আছে সেই টাকের মালিক ছিলেন সফদার ডাক্তার অনেকদিন পরে আবার সেটা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়লাম সফদার ডাক্তার, মাথা ভরা টাক তার-এটা নিয়ে আপত্তির কিছু নেই কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেভুলানো ছড়াটিতে একজন ডাক্তারের যে চিত্র অংকন করা হয়েছে তা রীতিমতো ভয়ংকর সাহিত্যশিল্পে এমন চিত্রণ অস্বাভাবিক কিছু নয় তবে একটি কোমলমতি শিশুর মনে টাকওয়ালা ডাক্তার সম্পর্কে এমন আজগুবি ধারণা সৃষ্টি করা কতটুকু শোভনীয় তা নিয়ে হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে। সেটা নিয়ে আপাতত বলার কিছু নেই। আজ টাকের কথা কেন এলো সেটা বলি। 

সত্যি কথা বলতে টাক কারও পছন্দের বিষয় নয়। টাকধারী ব্যক্তিও এটা পছন্দ করেন না, তার স্ত্রী-পরিজনও এটা কামনা করেন না। কিন্তু পুরুষের মাথায় টাক পড়ে এবং টাকমাথা ঢাকার জন্য চেষ্টা-তদবিরেরও কমতি নেই। আজকের আলোচনা তা নিয়েও নয়।

বেশ কিছুদিন যাবত টাকের সঙ্গে বিভিন্ন রোগব্যাধির সম্পর্ক নিয়ে নানারকম গবেষণার ফলাফল আসছে। সেই তালিকায় নতুন যোগ হয়েছে প্রোস্টেট ক্যানসার প্রসঙ্গ। অবশ্য গত দু’দশক ধরেই বিভিন্ন গবেষণায় প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে টাকের একটি সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে।আর এ সম্পর্ক একেবারে সূত্রবিহীন নয়। কারণ প্রোস্টেট ক্যানসার এবং টাক – এ দুটোর পেছনেই অ্যানড্রোজেনের ভূমিকা রয়েছে; আর দুটোর পেছনেই রয়েছে বংশগতির প্রভাব। অর্থাৎ বাপ-দাদার থাকলে পুত্রদেরও হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। যাহোক এতদিন পর্যন্ত প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি হিসেবে গণনা করা হতো-বেশী বয়স, গায়ের রঙ কাল হওয়া মানে যারা কৃষ্ণাঙ্গ, পরিবারে প্রোস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকা আর জিনের মিউটেশন(যেমন- BRCA mutations) 
   
কিন্তু গবেষণার নতুন ফলাফলের জন্য এখন প্রশ্ন জেগেছে তাহলে টাক হওয়াটাকেও কি একটি ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হবে? কারণ এই প্রথম প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে টাকের সম্পর্কটি জোরালোভাবে ধরা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে কেশবানদের চেয়ে টাকওয়ালাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% বেশী।  আমেরিকার National Health and Nutrition Examination Survey Epidemiologic Follow-up Study (NHEFS)-র দীর্ঘ ২১ বছরের পর্যবেক্ষণের পর এ ফলাফল জানা সম্ভব হয়েছে। আমেরিকার NHEFS একটি অনন্য পর্যবেক্ষণ। এটা ২১ বছর ধরে চলছে সেটাই প্রধান বিষয় নয়; একেবারে গবেষণার শুরুতেই এতে অংশগ্রহণকারীদের টাকের বিষয়টি চর্ম বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী চার হাজারের বেশী (৪৩১৫ জন) মানুষকে এই পর্যবেক্ষণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৩২৮৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের মধ্যে ১০৭ জনের মৃত্যুর কারণ প্রোস্টেট ক্যানসার। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে কেশবানদের চেয়ে যাদের মাথায় টাক আছে তাদের প্রোস্টেট ক্যানসারের কারণে মৃত্যুর হার ৫৬ শতাংশ বেশী। প্রশ্ন হচ্ছে টাক থাকলেই যেকোনো রকম টাক থাকলেই এরকম হয় নাকি কোন বিশেষ ধরণের টাকের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে? সেটা এখনও পরিস্কার নয়। তবে ইউরোলজিস্টদের নিকট প্রোস্টেট ক্যানসারের জন্য টাক থাকা না থাকা তেমন মুখ্য বিষয় নয়।কারণ টাকতো আর সিগারেটের মতো বিষয় নয়। ধূমপান করলে ফুসফুসের ক্যানসার হয়; অতএব ধূমপান নিবারণের চেষ্টা করলে অন্তত ফুসফুসের ক্যানসার হওয়া ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু টাকের তো এখনও কোন সন্তোষজনক চিকিৎসা নেই। অতএব টাক থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? প্রোস্টেট ক্যানসার যদি দরজাই কড়া নাড়ে তাহলে তাকে যথাযথ সমাদরের ব্যবস্থাই করতে হবে। কিন্তু তারপরও অনেকে নাছোড় বান্দা। তারা টাকের সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেকদূর যেতে চান। অনেকে বলছেন টাক থাকার কারণে যাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হচ্ছে তাদের শরীরের অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা কেমন তা দেখা দরকার। টাক এবং প্রোস্টেট ক্যানসার রোগী উভয়ের  অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রার মধ্যে সম্পর্কটি জানতে পারলে ভবিষ্যতে এই ক্যানসার প্রতিরোধের একটি উপায় বের করা সম্ভব হবে। আর কোন ধরণের টাকের সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক বেশী সেটিও একটি বিবেচনার বিষয়। নানা রকম টাক দেখা যায় কিন্তু আমরা এখন টাকের সেই জটিল শ্রেণী বিন্যাসের কথা বলতে চাই না সহজ কথায় সাধারনত কপালের দুপাশে(bitemporal), কপালের পেছনে (frontal) এবং মাথার ওপরে (vertex) টাক পড়তে দেখা যায়। ভার্টেক্সের টাক যাদের হয় তাদের মধ্যেই প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রকোপ বেশী। অন্যান্য ধরণের টাকের সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক তেমন প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে গবেষকগণ এ বিষয়ে এখনও শেষ কথা কিছু বলছেন না।
       
তবে এখন পর্যন্ত মোদ্দা কথা হচ্ছে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার জন্য মাথার টাক একটি ঝুঁকির বিষয়।


তথ্য সূত্রঃ Zhou CK, Levine PH, Cleary SD, Hoffman HJ, Graubard BI, Cook MB. Male Pattern Baldness in Relation to Prostate Cancer–Specific Mortality: A Prospective Analysis in the NHANES I Epidemiologic Follow-up Study. American Journal of Epidemiology. 2016; 183(3):210-7.

Monday 22 February 2016

চা-কফি এবং হৃদস্পন্দনের ছন্দ


যারা নিয়মিত কফি কিংবা চা পান করে থাকেন, তাদের সবসময় একটি ভয় থাকে যে বেশী ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করলে হৃদস্পন্দনের ছন্দ বিঘ্নিত হতে পারে কিন্তু এই ভয় আসলে অমূলক বলে মনে হচ্ছে Cardiovascular Health Study(CHS)-র প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নিয়মিত কফি,  চা কিংবা চকোলেটের সঙ্গে অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন কিংবা হৃদস্পন্দনের কোন ছন্দপতনের কোন সম্পর্ক নেই। তবে দিনে চারবারের বেশী কফি পান করলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন হতে পারে। সম্প্রতি জার্নাল অব আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনে(Journal of the American Heart Association)গবেষণার এই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়ের ব্যাপারে চিকিৎসক এবং রোগী উভয়ের মনেই আশংকা থাকে। স্বভাবতই প্রত্যেককে কফি কিংবা চা পানের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। গবেষকগণ এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু একই জার্নালে প্রকাশিত সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়েছে, গবেষণার ফলাফল যাই হোক ক্যাফেইনের সঙ্গে হৃদস্পন্দনের সম্পর্ক নিয়ে সতর্ক থাকাই উত্তম। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে সকলের জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ কি হবে? এর উত্তরে বলা হয়েছে এটি প্রত্যেকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের বিষয়। কেউ যদি কফি, চা কিংবা চকোলেট খেয়ে কোন অসুবিধা বোধ না করেন তাহলে তার জন্য কোন নিষেধ নেই। কিন্তু চা-কফি পানে কারও সমস্যা হলে তাকে এর থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেওয়াই শ্রেয়। 

বর্তমান গবেষণায় প্রায় ১৪০০ জন অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের প্রত্যেকের কফি, চা কিংবা চকোলেট খাওয়ার পরে হল্টার মনিটর করা হয়েছে। কিন্তু এদের কারও ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য হৃদস্পন্দনের সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার প্রমাণ মেলেনি।

অবশ্য সমালোচকদের মনে রয়েছে অন্য প্রশ্ন। ক্যাফেইন নিজে হয়তো কোন সমস্যা করছে না। কিন্তু যে কোন ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়ের সঙ্গেই প্রচুর চিনি মেশানো থাকে।এক মগ বড় কফিতে অনেকক্ষেত্রে ১৬০ মিলিগ্রাম থেকে ৪১৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে এবং এতে ক্যালরির পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪৫০ পর্যন্ত হতে পারে। এই বাড়তি মিষ্টি এবং ক্যালরিই শেষ পর্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং কাউকে নিশ্চিত মনে চা-কফি-চকোলেট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার আগে এটি মনে রাখা প্রয়োজন। 
  
তথ্যসূত্রঃ
১) Dixit S, Stein PK, Dewland TA, Dukes JW, Vittinghoff E, Heckbert SR, et al. Consumption of Caffeinated Products and Cardiac Ectopy. Journal of the American Heart Association. 2016;5(1).

 ২) Wilson PWF, Bloom HL. Caffeine Consumption and Cardiovascular Risks: Little Cause for Concern. Journal of the American Heart Association. 2016;5(1).  

Thursday 18 February 2016

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর এবং আমাদের স্মৃতিভ্রংশতা

কয়েকদিনের ব্যবধানেই প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর আবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। এবার প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের ওপর নতুন আরেক দোষ চেপেছে। চেপেছে বললে ভুল হবে। গবেষকগণ রীতিমত অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছেন। এর আগে একটি ছোটখাটো পর্যবেক্ষণে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশতার কিঞ্চিৎ সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছিল। তখন এটাকে কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এবার জার্মানি থেকে বেশ বড় রকমের পর্যবেক্ষণের ফলাফল জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন নিউরোলজিতে(JAMA Neurology) প্রকাশিত হয়েছে। একথা নতুন করে বলার দরকার নেই যে, ওষুধ হিসেবে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের সফলতার কোন তুলনা নেই কয়েক দশক ধরে এটা প্রেসক্রিপশনে সর্বাধিক লেখা ওষুধ। মূলত দুটো কারণে এটা হয়েছেঃ ডিসপেপসিয়ার চিকিৎসায় এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত; আর হৃদরোগে অ্যান্টিপ্লাটিলেট ওষুধের সঙ্গে পাকস্থলি থেকে কোন ধরণের রক্তক্ষরণ প্রতিরোধের জন্য এটা অবশ্যই ব্যবহার করা হয়। সুলভ এবং সহজলভ্য হওয়ার কারণে অনেকেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এটা ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াও এটা দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। উন্নত দেশেও বিনা প্রয়োজনে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর প্রেসক্রিপশনে লেখার নজির রয়েছে। কোন কোন জরীপে ৭০ শতাংশ প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর প্রয়োজন ছাড়াই লেখার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বৃদ্ধরোগীদের ওষুধের তালিকায় এটা অবশ্যই থাকতে দেখা যায়। এতদিন মনে করা হতো প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর খুবই নিরাপদ ওষুধ; এর তেমন কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণের ফলাফলে আর তেমন মনে করা সম্ভব হচ্ছে না।

জার্মানির ফলাফল এসেছে একটি সরকারি বীমা কোম্পানির গ্রাহকদের রোগবৃত্তান্ত এবং ওষুধের প্রেসক্রিপশন বিশ্লেষণ থেকে। জার্মানির মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের একভাগ এই বীমার আওতায় এবং এদের অর্ধেকই বৃদ্ধমানুষ। এদের মধ্যে প্রায় চুয়াত্তর হাজার মানুষ রয়েছে যাদের বয়স ৭৫ বছরের বেশী। বীমা গ্রহণের সময় এদের কারোই স্মৃতিভ্রংশতা ছিল না। কিন্তু ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এদের মধ্যে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের স্মৃতিভ্রংশতা শনাক্ত করা হয়েছে। এত অল্প সময়ে এত বেশী মানুষের স্মৃতিভ্রংশতা হওয়া একটু অস্বাভাবিক ঘটনাই বটে। প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের প্রেসক্রিপশনের ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায় এদের অনেকেই ২০০৪ সাল থেকে ১৮ মাস  কিংবা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর সেবন করেছেন। ব্যবহৃত প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের মধ্যে রয়েছে-ওমেপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল, ল্যান্সোপ্রাজল, এসমোপ্রাজল কিংবা রাবেপ্রাজল। এদের মধ্যে প্রায় তিন হাজার বীমাগ্রহণকারী প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর নিয়মিত আজীবন সেবন করে যাচ্ছেন। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর দীর্ঘদিন সেবনকারীদের স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের চেয়ে প্রায় ৫০% বেশী। উল্লেখ্য স্ট্রোক এবং বিষণ্ণতা থাকলে স্মৃতিভ্রংশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যাদের ডায়াবেটিস এবং যারা প্রতিদিন পাঁচ ধরণের বেশী ওষুধ সেবন করে তাদেরও স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত ওমেপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল এবং এসমোপ্রাজলের ক্ষেত্রে একই ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। যত বেশী সময় এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তাদের তত বেশী স্মৃতি হারানোর সম্ভাবনা।

প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর ব্যবহার করলে কেন কিংবা কিভাবে স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে তা এখনও কেউ ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। তবে গবেষকগন মনে করছেন বিনা প্রয়োজনে ঠিক যতদিন প্রয়োজন তার বেশী প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর সেবন না করাই উত্তম। এমন কি তারা খুব জরুরী দরকার না থাকলে পুরনো সেই অ্যান্টাসিড কিংবা র‍্যানিটিডিন ব্যবহার করার ওপরেও জোর দিচ্ছেন। কারণ প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের জন্য যদি সামান্য পরিমাণও স্মৃতিভ্রংশতা বাড়ে সংখ্যার হিসেবে বাস্তবে তা বিশাল সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বয়স ৭৫ থেকে ৮৪ বছরের মধ্যে। এদের শতকরা ৩ জনও যদি প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর সেবন করে; তাহলে হিসেব অনুসারে অন্তত ১০,০০০ নতুন স্মৃতিভ্রংশ রোগী শনাক্ত হবে। কিন্তু এত বিশালসংখ্যক ভুলো মানুষের চিকিৎসা করা সহজ বিষয় নয়। আর অচিরেই এটা নিউরোলজিস্ট তথা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্যই একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।                   

তথ্যসূত্রঃ
1.       Haenisch B, von Holt K, Wiese B, Prokein J, Lange C, Ernst A, et al. Risk of dementia in elderly patients with the use of proton pump inhibitors. European archives of psychiatry and clinical neuroscience. 2015;265(5):419-28.
2.       Gomm W, von Holt K, Thomé F, et al. Association of proton pump inhibitors with risk of dementia: A pharmacoepidemiological claims data analysis. JAMA Neurology. 2016.

3.       Kuller LH. DO proton pump inhibitors increase the risk of dementia? JAMA Neurology. 2016. 

Wednesday 10 February 2016

আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা এবং আমাদের তনু-মন

কথায় বলে, “দাঁতের সঙ্গে আঁতের সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে আঁতের সঙ্গে অর্থাৎ অন্ত্রের সঙ্গে শুধু দাঁত নয়, আরও অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের অন্ত্রে আক্ষরিক অর্থেই হাজার রকমের কোটি কোটি ক্ষুদ জীবাণু বাস করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে সাধারনত “আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা” বলা হয়। ব্যাকটেরিয়া হলেও এরা কিন্তু আমাদের শরীরের ক্ষতি করে না; বরং এরা আমাদের বন্ধু-প্রতিমএরা বাইরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে; খাদ্য হজম এবং পুষ্টি পরিশোষণে সাহায্য করে; ভিটামিন (ভিটামিন-কে এবং নানাধরণের ভিটামিন-বি) তৈরি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

কিন্তু অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া আমাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং আচরণের ওপরেও গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এর অর্থ আঁতের সঙ্গে মগজেরও সম্পর্ক আছে। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাসায়নিক অণুর সাহায্যে মস্তিস্কে বার্তা পাঠায় এবং এভাবেই মস্তিষ্কের কাজ-কর্ম প্রভাবিত করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেকের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস একেবারেই অনন্য। অর্থাৎ একজনের আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার সঙ্গে আরেকজনের মাইক্রোবায়োটার কোন মিল নেই; ঠিক যেমন একজনের আঙুলের ছাপের সঙ্গে অন্যজনেরটি মেলে না। তবে নানাভাবে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন-খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, রোগ-ব্যাধি, বয়স ইত্যাদি। জন্মের পরে আমাদের অন্ত্রে কোন জীবাণু থাকে না। কিন্তু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের অন্ত্রে নানারকম ব্যাকটেরিয়া আবাস তৈরি করে। কিন্তু এই আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হতে পারে; যেমন- মায়ের আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস, শিশুর জন্ম প্রক্রিয়া অর্থাৎ স্বাভাবিক সন্তান প্রসব কিংবা সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম, শিশুর প্রথম খাবার অর্থাৎ শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো হল নাকি বোতলের দুধ খাওয়ান হল, শিশুর জন্মের পরে অসুখ-বিসুখ, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, সার্বিক পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশের প্রভাব। সাধারনত শিশুর ৩ বছর বয়সে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা স্থিতিলাভ করে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন হতে পারে।
   
আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার স্বাভাবিক ভারসাম্য মাঝে মাঝে বিঘ্নিত হতে পারে। দেখা যায় আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার এরকম ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে স্নায়বিক, আন্ত্রিক এবং মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন শৈশবের উদ্বেগ (শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন হয়রানি যে কারণেই হোক না কেন) পরবর্তীতে আন্ত্রিক রোগ সৃষ্টি করতে পারে। কেন এমন হচ্ছে তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তন এখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণীর ওপর পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মাত্র দুই ঘণ্টার উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতিও আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস বদলে দিতে পারে। এরকম উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতি দুসপ্তাহ টানা চললে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিস্থিতিরও পরিবর্তন ঘটে। এর পুরো ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি; তবে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা, অন্ত্র এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যে একটি গভীর সংযোগ আছে এবিষয়ে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এজন্য আজকাল “প্রোবায়োটিক”-এর ব্যবহার বেড়েছে। প্রোবায়োটিক হচ্ছে আমাদের বন্ধু ক্ষুদে জীবাণু। হাজার হাজার বছর ধরে এরা মানুষের শরীরের উপকার করছে। প্রোবায়োটিক সাধারনত অন্ত্রে উপকারী জীবাণুর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস (Lactobacillus)  এবং বাইফিডোব্যাক্টেরিয়াম (Bifidobacterium) এধরণের অতি ব্যবহৃত পরিচিত প্রোবায়োটিক প্রোবায়োটিক উপকারী কিন্তু সবক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায় না। কখনও সুফল পাওয়া যায়, কখনও পাওয়া যায় নাকেন এমন হয় এরও কোন ব্যাখ্যা মেলে না। হয়ত সব প্রোবায়োটিক একরকম নয়; কিংবা বিভিন্নজনের ওপর প্রোবায়োটিকের বিভিন্ন ভূমিকা রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে অনেক আন্ত্রিক এবং মানসিক রোগের চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে মানসিক রোগের চিকিৎসায় কিছু প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গিয়েছে এই বিশেষ ধরণের প্রোবায়োটিকের নাম দেওয়া হয়েছেসাইকোবায়োটিক”(psychobiotics)এরা মানুষের বিষণ্ণতা লাঘব করতে পারে, উদ্বেগ প্রশমন করতে পারে। এজন্য অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে সকলের আগ্রহের শেষ নেই।

জন্মের পরে আমাদের অন্ত্রে সঠিক ব্যাকটেরিয়া যেন আবাস তৈরি করতে পারে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপরে পরবর্তী জীবনের অনেক রোগব্যাধির প্রকৃতি নির্ভরশীল। প্রশ্ন হচ্ছে জন্মের পরে কিভাবে উপযুক্ত ব্যাকটেরিয়াকে অন্ত্রে আবাস তৈরি করতে দেওয়া যায়? এর খুব সহজ সমাধান হচ্ছে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো। মায়ের বুকের দুধ আমাদের শরীরের জন্য দরকারী আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার যোগান দিতে পারে। আর এজন্য মায়ের বুকের দুধ পান করালে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকে। বোতলের দুধ পান করালে উপকারী আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা পাওয়া সম্ভব হয় না।

আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তন আনতে পারি। অতিরিক্ত চিনি, চর্বি এবং কম আঁশযুক্ত ফাস্টফুডজাতীয় খাবার আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু আঁশ সমৃদ্ধ সবজি, ফলমূল এবং আকর শস্যদানাযুক্ত খাবার উপযুক্ত আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবেশ সৃষ্টি করে। এখন আমরা কোন ধরণের খাবার বেছে নেব, সেটা আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পেটে খেলে পিঠে সয়-এটা যেমন সত্য; এখন পেটে খেলে মন ও মগজে সয় সেটাও সত্য।