শৈশবে টাক নিয়ে একটি ছড়া মনে হয় সকলেরই পড়া আছে। সেই টাকের মালিক ছিলেন সফদার ডাক্তার। অনেকদিন পরে আবার সেটা বেশ মনোযোগ দিয়ে
পড়লাম। সফদার ডাক্তার, মাথা ভরা টাক তার-এটা নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেভুলানো ছড়াটিতে একজন ডাক্তারের যে চিত্র অংকন করা হয়েছে
তা রীতিমতো ভয়ংকর। সাহিত্যশিল্পে এমন চিত্রণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে একটি কোমলমতি শিশুর মনে টাকওয়ালা ডাক্তার সম্পর্কে এমন
আজগুবি ধারণা সৃষ্টি করা কতটুকু শোভনীয় তা নিয়ে হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে
পারে। সেটা নিয়ে আপাতত বলার কিছু নেই। আজ টাকের কথা কেন এলো সেটা বলি।
সত্যি কথা বলতে টাক কারও পছন্দের বিষয় নয়।
টাকধারী ব্যক্তিও এটা পছন্দ করেন না, তার স্ত্রী-পরিজনও এটা কামনা করেন না। কিন্তু
পুরুষের মাথায় টাক পড়ে এবং টাকমাথা ঢাকার জন্য চেষ্টা-তদবিরেরও কমতি নেই। আজকের
আলোচনা তা নিয়েও নয়।
বেশ কিছুদিন যাবত টাকের সঙ্গে বিভিন্ন
রোগব্যাধির সম্পর্ক নিয়ে নানারকম গবেষণার ফলাফল আসছে। সেই তালিকায় নতুন যোগ হয়েছে
প্রোস্টেট ক্যানসার প্রসঙ্গ। অবশ্য গত দু’দশক ধরেই বিভিন্ন গবেষণায়
প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে টাকের একটি সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে।আর এ সম্পর্ক একেবারে
সূত্রবিহীন নয়। কারণ প্রোস্টেট ক্যানসার এবং টাক – এ দুটোর পেছনেই অ্যানড্রোজেনের
ভূমিকা রয়েছে; আর দুটোর পেছনেই রয়েছে
বংশগতির প্রভাব। অর্থাৎ বাপ-দাদার থাকলে পুত্রদেরও হওয়ার সম্ভাবনা অনেক
বেশী। যাহোক এতদিন পর্যন্ত প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি হিসেবে গণনা করা হতো-বেশী বয়স, গায়ের রঙ কাল হওয়া মানে যারা কৃষ্ণাঙ্গ, পরিবারে প্রোস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকা আর জিনের মিউটেশন(যেমন- BRCA mutations)।
কিন্তু গবেষণার নতুন ফলাফলের জন্য এখন প্রশ্ন
জেগেছে তাহলে টাক হওয়াটাকেও কি একটি ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হবে? কারণ এই প্রথম
প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে টাকের সম্পর্কটি জোরালোভাবে ধরা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে
কেশবানদের চেয়ে টাকওয়ালাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% বেশী। আমেরিকার National Health and Nutrition
Examination Survey Epidemiologic Follow-up Study (NHEFS)-র দীর্ঘ ২১ বছরের পর্যবেক্ষণের পর এ ফলাফল
জানা সম্ভব হয়েছে। আমেরিকার NHEFS একটি অনন্য
পর্যবেক্ষণ। এটা ২১ বছর ধরে চলছে সেটাই প্রধান বিষয় নয়; একেবারে গবেষণার শুরুতেই
এতে অংশগ্রহণকারীদের টাকের বিষয়টি চর্ম বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া
হয়েছিল। ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী চার হাজারের বেশী
(৪৩১৫ জন) মানুষকে এই পর্যবেক্ষণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৩২৮৪ জন
মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের মধ্যে ১০৭ জনের মৃত্যুর কারণ প্রোস্টেট ক্যানসার।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে কেশবানদের চেয়ে যাদের মাথায় টাক আছে তাদের প্রোস্টেট
ক্যানসারের কারণে মৃত্যুর হার ৫৬ শতাংশ বেশী। প্রশ্ন হচ্ছে টাক থাকলেই যেকোনো রকম
টাক থাকলেই এরকম হয় নাকি কোন বিশেষ ধরণের টাকের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে? সেটা এখনও
পরিস্কার নয়। তবে ইউরোলজিস্টদের নিকট প্রোস্টেট ক্যানসারের জন্য টাক থাকা না থাকা
তেমন মুখ্য বিষয় নয়।কারণ টাকতো আর সিগারেটের মতো বিষয় নয়। ধূমপান করলে ফুসফুসের
ক্যানসার হয়; অতএব ধূমপান নিবারণের চেষ্টা করলে অন্তত ফুসফুসের ক্যানসার হওয়া
ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু টাকের তো এখনও কোন সন্তোষজনক চিকিৎসা নেই। অতএব টাক
থাকলেই কি আর না থাকলেই কি? প্রোস্টেট ক্যানসার যদি দরজাই কড়া নাড়ে তাহলে তাকে
যথাযথ সমাদরের ব্যবস্থাই করতে হবে। কিন্তু তারপরও অনেকে নাছোড় বান্দা। তারা টাকের
সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেকদূর যেতে চান। অনেকে বলছেন টাক
থাকার কারণে যাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হচ্ছে তাদের শরীরের অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা
কেমন তা দেখা দরকার। টাক এবং প্রোস্টেট ক্যানসার রোগী উভয়ের অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রার মধ্যে সম্পর্কটি জানতে
পারলে ভবিষ্যতে এই ক্যানসার প্রতিরোধের একটি উপায় বের করা সম্ভব হবে। আর কোন ধরণের
টাকের সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক বেশী সেটিও একটি বিবেচনার বিষয়। নানা রকম টাক দেখা যায়। কিন্তু আমরা এখন টাকের সেই জটিল শ্রেণী বিন্যাসের কথা
বলতে চাই না। সহজ কথায় সাধারনত কপালের দুপাশে(bitemporal), কপালের পেছনে (frontal) এবং মাথার ওপরে (vertex) টাক পড়তে দেখা যায়। ভার্টেক্সের টাক যাদের হয়
তাদের মধ্যেই প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রকোপ বেশী। অন্যান্য ধরণের টাকের সঙ্গে
প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্পর্ক তেমন প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে গবেষকগণ এ বিষয়ে এখনও শেষ কথা কিছু বলছেন না।
তবে এখন পর্যন্ত মোদ্দা কথা হচ্ছে প্রোস্টেট
ক্যানসার হওয়ার জন্য মাথার টাক একটি ঝুঁকির বিষয়।
তথ্য সূত্রঃ Zhou CK, Levine PH, Cleary
SD, Hoffman HJ, Graubard BI, Cook MB. Male Pattern Baldness in Relation to
Prostate Cancer–Specific Mortality: A Prospective Analysis in the NHANES I
Epidemiologic Follow-up Study. American Journal of Epidemiology. 2016;
183(3):210-7.
No comments:
Post a Comment