শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Saturday 27 February 2016

একবিংশ শতকে শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধ

কিছুদিন আগে সিডনিতে এক টিভি চ্যানেলের অফিসের সামনে মায়েরা এক অভিনব প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রতিবাদ হিসেবে তারা প্রকাশ্যে নিজ শিশুদের বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন কারণ ওই টিভি চ্যানেলের এক জনপ্রিয় উপস্থাপক কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন যে, উন্মুক্ত স্থানে শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময় মায়েদের একটু সতর্ক থাকা উচিত কিংবা আড়ালে যাওয়া উচিত। মায়েরা তার কথায় খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য তারা বাড়তি আড়ালে কেন যাবেন? যারা স্তন পান করানোকে লজ্জার বিষয় মনে করে তাদের নিশ্চয় মানসিক সমস্যা আছে। বলাবাহুল্য ওই উপস্থাপক ভদ্রলোক পরে মায়েদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে কোন রকমে তাদের ক্ষোভ থেকে রক্ষা পান।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে এটা উল্লেখ করলাম কারণ সম্প্রতি “ল্যানসেট” পত্রিকায় মায়ের বুকের দুধের উপকারিতা নিয়ে একটি বিশেষ সিরিজ প্রকাশ করেছে। 
  
শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ পান করবে-এটা এতই সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনা যে বুকের দুধ পান করানো নিয়ে কেন এত শোরগোল সেটাই অনেকসময় বোধগম্য হয় না। কিন্তু ঘটনাচক্রে পরিস্থিতি এমন   দাঁড়িয়েছে যে, বুকের দুধ পান অভ্যাস করানো একটি বিশাল প্রচারণা অভিযানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আধুনিক হতে গিয়ে এক পর্যায়ে মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর প্রয়োজনীয়তাই ভুলতে বসেছিলেন। গত তিন দশকে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তারপরেও দেখা যাচ্ছে সব মা যদি তাদের শিশুকে বুকের দুধ পান করাতেন তাহলে আরও ৮২৩,০০০ শিশু এবং ২০,০০০ মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। শুধু তাই নয় এরফলে ৩০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সাশ্রয় হতো।কারণ এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, বুকের দুধ পান করালে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকার ফলে রোগ সংক্রমণ কম হয় এবং শিশুর মেধাশক্তি বেশী হয়; অন্যদিকে বুকের দুধ পান করালে মায়েরা নিজেরাও উপকৃত হন তাদের অতিরিক্ত মেদভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ অন্যান্য ক্রনিক রোগব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। কম আয়ের এবং মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ শিশু এক বছর বুকের দুধ পায় না; উন্নত দেশে মাত্র ২০% শিশু মায়ের দুধ পায়। প্রশ্ন হচ্ছে বুকের দুধ পান করানোর এত উপকারিতা জানার পরেও কেন পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না?

মায়েরা কেন শিশুকে বুকের দুধ পান করান না তার অনেক কারণ রয়েছে এর পেছনে যেমন আছে স্বাস্থ্যগত কিংবা মানসিক কারণ, তেমন আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আর এসব কারণ যে একেবারে অযৌক্তিক, ঠিক তাও বলা যাবে না এছাড়া রয়েছে গুঁড়ো দুধ বানানোর বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মনোহারী বিজ্ঞাপনের আগ্রাসন ফলে একে একে মায়েরা শিশুদের মুখে তুলে দিয়েছেন বোতলের দুধ কিন্তু এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যে খারাপ পরিণতি বয়ে আনছে আমরা বুঝেও তা না বোঝার ভান করছি      

উন্নত দেশসমূহেও এখন মায়েদের বুকের দুধ পান করানোর জন্য নানারকম সুবিধা দেওয়া হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃত্ব ছুটি ছাড়াও বুকের দুধ পান করানোর জন্য মায়েদের অফিসকালে বিরতি দেওয়া হচ্ছে, ব্রেস্ট পাম্পের জন্য ইনস্যুরেন্স সুবিধা দেওয়া হচ্ছে অফিস আদালতের পরিবেশকে মায়েদের বুকের দুধ পান করানোর অনুকূল করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রচারণা চলছে। আশা করা হচ্ছে এর ফলে বুকের দুধ পান করানোর হার অন্তত ২৫% বাড়বে।

অনেকে বলে থাকেন বুকের দুধ পান করাতে কোন অর্থ ব্যয় হয়না। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা আসলে তেমন নয়। দেশে দেশে বুকের দুধ পান করানোর পথে যে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে তা অতিক্রম করার জন্য ব্যাপক আর্থসামাজিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। নিঃসন্দেহ বুকের দুধ এর যে কোন বিকল্পের চেয়ে পুষ্টির দিক দিয়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিবেচনায়, স্নায়ুতন্ত্র কিংবা এন্ডোক্রিন গ্রন্থির বিকাশের জন্য, অর্থ এবং পরিবেশের জন্য বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। এর প্রস্তুতি, পরিবহন কিংবা সংরক্ষণের জন্য কোন আলাদা মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের দরকার হয় না।    

শুরু থেকে যদি বুকের দুধ পানের প্রচলন না থাকতো এবং আজ যদি এটা কেউ নতুন করে আবিস্কার করতেন, তাহলে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত দুইবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতেন। তাকে একবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো চিকিৎসা বিজ্ঞানে; আরেকবার দেওয়া হতো অর্থনীতিতে। সুস্বাস্থ্যের জন্য “স্তনই শ্রেষ্ঠ” যেমন সত্য; দেশের অর্থনীতির জন্যও তা কল্যাণকর। জরা, দারিদ্র এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে মায়ের বুকের দুধ শিশুর শুধু প্রথম টীকাই নয়; এটা তার শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সক্ষমতার জন্য টেকসই বিনিয়োগ।

বুকের দুধ পান করানোর এত উপকারিতার কথা জানার পরেও বুকের দুধ পান করানোর প্রতি আধুনিক মায়েদের অনীহা লক্ষণীয়। মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু শিশুদের জন্য বিকল্প দুধ বাজারজাত করে বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ প্রতি বছর তাদের পকেট ভারী করছে। ২০১৪ সালের হিসেবে দেখা যায় শিশুদের গুঁড়ো দুধ বিক্রি করে কোম্পানিগুলো প্রায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। আর শিশুদের মায়ের বুকের দুধ পান না করানোর ফলে সব মিলিয়ে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আগেই বলা হয়েছে তার মুল্য ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশী। অর্থাৎ বলা যায় বুকের দুধ পান করালে শুধু শিশুর উপকার নয়; এর ফলে শিশুর মা, তাদের সমাজ এবং পরিবেশ সামগ্রিকভাবে উপকৃত হয়। আর এটা অর্জনের জন্য আমাদের সামজিক সচেতনতা যেমন দরকার; তেমন দরকার সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং দৃঢ় সমর্থন।


মূল বক্তব্যঃ 
১) বুকের দুধ পান করলে শিশুদের রোগব্যাধি কম হয় এবং শিশুর অকাল মৃত্যুর সম্ভাবনা কমে যায়। তাদের দাঁতের গঠন এবং সজ্জা ভাল হয়, মেধাশক্তি বেশী হয়।বুকের দুধ পানের এই উপকারিতা পরবর্তী সময়েও দেখতা পাওয়া যায়। কারণ যেসব শিশু দীর্ঘ সময় মায়ের বুকের দুধ পান করে তাদের মেদভুঁড়ি এবং ডায়াবেটিস কম হতে দেখা যায়।
২) বুকের দুধ পান করালে মায়ের নিজেরও উপকার হয়। বুকের দুধ পান করানো একধরণের প্রাকৃতিক জন্ম বিরতিকরণ প্রক্রিয়া। বুকের দুধ পান করালে মায়েরও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়; তাদের ওভারি এবং স্তন ক্যানসার হওয়ার আশংকা কমে যায়।
৩) কম এবং মধ্যম আয়ের দেশসমূহের চেয়ে বেশী আয়ের দেশে বুকের দুধ পান করানোর হার এবং সময়কাল কম। তবে কম এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতেও প্রতি ৩ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ১ জন ছয় মাস পুরোপুরি বুকের দুধ পান করে থাকে।
৪) আরও অধিকসংখ্যক মায়েরা যদি শিশুদের বুকের দুধ পান করাতেন তাহলে প্রতি বছর ৮২৩,০০০ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব এবং প্রতি বছর ২০,০০০ স্তন ক্যানসারে মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়।
৫) আধুনিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য নিখুঁত নিরাপদ ওষুধ।
৬) মানবশিশুকে বুকের দুধ পান করানো একটি অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটা ধনী কিংবা গরীব সকল দেশের জন্যই জরুরী। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে ক্ষেত্রে মায়েদের বুকের দুধ পান করানো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।  
     
তথ্যসূত্রঃ
১)   Victora CG, Bahl R, Barros AJD, França GVA, Horton S, Krasevec J, et al. Breastfeeding in the 21st century: epidemiology, mechanisms, and lifelong effect. The Lancet.387 (10017):475-90.
২)   Rollins NC, Bhandari N, Hajeebhoy N, Horton S, Lutter CK, Martines JC, et al. Why invest, and what it will take to improve breastfeeding practices? The Lancet.387 (10017):491-504.

৩)   Breastfeeding: achieving the new normal. The Lancet.387 (10017):404.

No comments:

Post a Comment