কথায় বলে, “দাঁতের সঙ্গে আঁতের সম্পর্ক”। দেখা যাচ্ছে আঁতের সঙ্গে অর্থাৎ
অন্ত্রের সঙ্গে শুধু দাঁত নয়, আরও অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের অন্ত্রে আক্ষরিক অর্থেই হাজার
রকমের কোটি কোটি ক্ষুদে জীবাণু বাস করে। এসব
ব্যাকটেরিয়াকে সাধারনত “আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা” বলা হয়। ব্যাকটেরিয়া হলেও এরা
কিন্তু আমাদের শরীরের ক্ষতি করে না; বরং এরা আমাদের বন্ধু-প্রতিম। এরা বাইরের
ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে; খাদ্য হজম এবং পুষ্টি
পরিশোষণে সাহায্য করে; ভিটামিন (ভিটামিন-কে এবং নানাধরণের ভিটামিন-বি) তৈরি করে
এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
কিন্তু অবাক করা কাণ্ড
হচ্ছে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া আমাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি এবং আচরণের ওপরেও গভীর
প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এর অর্থ আঁতের সঙ্গে মগজেরও সম্পর্ক আছে। অন্ত্রের
ব্যাকটেরিয়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাসায়নিক অণুর সাহায্যে মস্তিস্কে বার্তা পাঠায় এবং
এভাবেই মস্তিষ্কের কাজ-কর্ম প্রভাবিত করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেকের অন্ত্রের
মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস একেবারেই অনন্য। অর্থাৎ একজনের আন্ত্রিক
মাইক্রোবায়োটার সঙ্গে আরেকজনের মাইক্রোবায়োটার কোন মিল নেই; ঠিক যেমন একজনের
আঙুলের ছাপের সঙ্গে অন্যজনেরটি মেলে না। তবে নানাভাবে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস
পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন-খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, রোগ-ব্যাধি, বয়স ইত্যাদি। জন্মের
পরে আমাদের অন্ত্রে কোন জীবাণু থাকে না। কিন্তু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের
অন্ত্রে নানারকম ব্যাকটেরিয়া আবাস তৈরি করে। কিন্তু এই আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার
বিন্যাস বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হতে পারে; যেমন- মায়ের আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার
বিন্যাস, শিশুর জন্ম প্রক্রিয়া অর্থাৎ স্বাভাবিক সন্তান প্রসব কিংবা সিজারিয়ান
অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম, শিশুর প্রথম খাবার অর্থাৎ শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো
হল নাকি বোতলের দুধ খাওয়ান হল, শিশুর জন্মের পরে অসুখ-বিসুখ, অ্যান্টিবায়োটিকের
ব্যবহার, সার্বিক পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশের প্রভাব। সাধারনত শিশুর ৩ বছর বয়সে
আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা স্থিতিলাভ করে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন হতে
পারে।
আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার স্বাভাবিক ভারসাম্য মাঝে
মাঝে বিঘ্নিত হতে পারে। দেখা যায় আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার এরকম ভারসাম্যহীনতার
সঙ্গে স্নায়বিক, আন্ত্রিক এবং মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন শৈশবের উদ্বেগ
(শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন হয়রানি যে কারণেই হোক না কেন) পরবর্তীতে আন্ত্রিক রোগ
সৃষ্টি করতে পারে। কেন এমন হচ্ছে তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার
পরিবর্তন এখানে একটি বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাণীর ওপর
পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মাত্র দুই ঘণ্টার উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতিও আন্ত্রিক
মাইক্রোবায়োটার বিন্যাস বদলে দিতে পারে। এরকম উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতি দুসপ্তাহ টানা
চললে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিস্থিতিরও পরিবর্তন
ঘটে। এর পুরো ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি; তবে আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা, অন্ত্র এবং
মস্তিষ্কের মধ্যে যে একটি গভীর সংযোগ আছে এবিষয়ে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এজন্য আজকাল
“প্রোবায়োটিক”-এর ব্যবহার বেড়েছে। প্রোবায়োটিক হচ্ছে আমাদের বন্ধু ক্ষুদে জীবাণু।
হাজার হাজার বছর ধরে এরা মানুষের শরীরের উপকার করছে। প্রোবায়োটিক সাধারনত অন্ত্রে
উপকারী জীবাণুর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস (Lactobacillus) এবং বাইফিডোব্যাক্টেরিয়াম (Bifidobacterium) এধরণের অতি ব্যবহৃত
পরিচিত প্রোবায়োটিক। প্রোবায়োটিক
উপকারী কিন্তু সবক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায় না। কখনও সুফল
পাওয়া যায়, কখনও পাওয়া যায় না। কেন এমন হয় এরও কোন
ব্যাখ্যা মেলে না। হয়ত সব প্রোবায়োটিক একরকম নয়; কিংবা বিভিন্নজনের ওপর
প্রোবায়োটিকের বিভিন্ন ভূমিকা রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে অনেক আন্ত্রিক এবং মানসিক রোগের
চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে মানসিক রোগের চিকিৎসায় কিছু প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গিয়েছে। এই বিশেষ
ধরণের প্রোবায়োটিকের নাম দেওয়া হয়েছে “সাইকোবায়োটিক”(psychobiotics)। এরা মানুষের বিষণ্ণতা লাঘব করতে পারে, উদ্বেগ প্রশমন করতে
পারে। এজন্য অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে সকলের আগ্রহের
শেষ নেই।
জন্মের পরে আমাদের অন্ত্রে সঠিক ব্যাকটেরিয়া যেন আবাস তৈরি
করতে পারে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ওপরে পরবর্তী জীবনের অনেক রোগব্যাধির
প্রকৃতি নির্ভরশীল। প্রশ্ন হচ্ছে জন্মের পরে কিভাবে উপযুক্ত ব্যাকটেরিয়াকে অন্ত্রে
আবাস তৈরি করতে দেওয়া যায়? এর খুব সহজ সমাধান হচ্ছে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো।
মায়ের বুকের দুধ আমাদের শরীরের জন্য দরকারী আন্ত্রিক
মাইক্রোবায়োটার যোগান দিতে পারে। আর এজন্য মায়ের বুকের দুধ পান করালে শিশুর রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকে। বোতলের দুধ পান করালে উপকারী আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটা
পাওয়া সম্ভব হয় না।
আমাদের
খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার পরিবর্তন আনতে পারি।
অতিরিক্ত চিনি, চর্বি এবং কম আঁশযুক্ত ফাস্টফুডজাতীয় খাবার আন্ত্রিক
মাইক্রোবায়োটার ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু আঁশ
সমৃদ্ধ সবজি, ফলমূল এবং আকর শস্যদানাযুক্ত খাবার উপযুক্ত আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োটার
পরিবেশ সৃষ্টি করে। এখন আমরা কোন ধরণের খাবার বেছে নেব, সেটা আমাদেরই সিদ্ধান্ত
নিতে হবে। পেটে খেলে পিঠে সয়-এটা যেমন সত্য; এখন পেটে খেলে মন ও মগজে সয় সেটাও
সত্য।
No comments:
Post a Comment