শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Wednesday, 13 February 2013

খাবারের লবণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা





সেই আদিকাল থেকে লবণের কত গুণগান। কথায় বলে,নুন খাই যার গুণ গাই তার। রোমান সৈনিকদের বেতন দেওয়া হতো লবণ কেনার জন্য। এজন্য বেতন বলতে ইংরেজিতে  SALARY’  শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব লবণের মূল্য অসাধারণ। লবণ ছাড়া খাবার সুস্বাদু হয় না সত্য; কিন্তু কতটুকু লবণ খাওয়া উচিৎ এ নিয়ে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। কারণ অতিরিক্ত লবণ খেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি খাবারে লবণ এবং পটাসিয়ামের নতুন নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। একজন মানুষের দিনে ৫ গ্রাম অর্থাৎ প্রায় ১ চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিৎ। আর দৈনিক পটাসিয়াম বরাদ্দ ৩.৫ গ্রাম । ১০টি কলাতে এই পরিমান পটাসিয়াম পাওয়া যায়। অবশ্য আরও অনেক ফলেও প্রচুর পটাসিয়াম থাকে। 
খাবারে অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। লবণ বেশী খেলে রক্তরসের পরিমাণ বেড়ে যায় যার ফলে রক্তচাপও বেড়ে যায় বলে মনে করা হয়। এজন্য খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত রাখা দরকার। কিন্তু আসলে খাবারে কতটুকু লবণ থাকা দরকার তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেখানে একটি প্রমাণ ভিত্তিক মতৈক্য স্থাপন করলো।
রূপকথার গল্পে রাজা তার তিন কন্যাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাকে কে কেমন ভালবাসে? ছোট রাজকন্যা তাকে লবণের মতো ভালবাসে শুনে রাজা খুব রেগে গিয়েছিলেন। তিনি রেগে গেলেও পরবর্তীতে ছোট রাজকন্যা অবশ্য প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে লবণের মতো ভালবাসাই সবচেয়ে উত্তম। আমরা অবশ্য জানিনা গল্পের রাজার উচ্চরক্তচাপ ছিল কিনা? তবে এখন এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় বর্তমান সময়ের কন্যাগণ তাদের পিতৃদেবকে আর যাহোক ভালবাসায় পাতে লবণ আধিক্যের মাধ্যমে রক্তচাপ বাড়ার সুযোগ দেবে না। বরং উচ্চরক্তচাপ আক্রান্ত পিতাদের খেতে বসে একটু বাড়তি পাতের লবণের জন্য  জায়া-কন্যাদের  শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে খেতে হবে।
খাবারের লবণের বৈজ্ঞানিক নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দৈনিক আড়াই গ্রামের বেশী সোডিয়াম গ্রহন করি। এ পরিমাণ সোডিয়াম  ৬ গ্রাম বা ১ চা চামচ খাবার লবণের সমতুল্য। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে এখন পরিস্কার জানানো  হয়েছে একজন মানুষের দিনে ৫ গ্রাম অর্থাৎ প্রায় ১ চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিৎ। এটা ভাত-তরকারি  এবং পাতের লবণসহ হিসেব করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন পাতে লবণ না খেয়ে তরকারিতে বেশী পরিমাণে লবণ ব্যবহার করলে কোন ভয় নাই। আবার কেউ কেউ বলেন পাতে কাঁচা লবণ না খেয়ে তরকারিতে ভাজা লবণ খেলে ভালো। কিন্তু এ সকল কথা সত্য নয়। লবণ যে ভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন একজন সুস্থ মানুষের সার্বিকভাবে এক চা চামচের বেশী লবণ খাওয়া উচিৎ নয়।
আজকাল আধুনিক  সুপার মল কিংবা চেইন শপগুলিতে হিমায়িত খাবার কিংবা কৌটাজাত ফলমূল এবং শব্জি বিক্রি হয়। মাছ-মাংস, রান্না করা ভাত, রুটি, পাস্তা, নান রুটি ইত্যাদি হরেক রকম খাবার এভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়। যারা হোস্টেল, মেস কিংবা ডরমিটরিতে বাস করেন অথবা কর্মব্যস্ততার কারণে রান্না করার সময় পান না তাদের নিকট এ সকল রেডিমেড খাবার অত্যন্ত জনপ্রিয়। গৃহবধূর হাতে রান্না করা সুস্বাদু গরম তরকারি আর ভাত যাদের নিয়তিতে নাই তাদের জন্য মোড়ক জাত নানাবিধ প্রস্তুত খাবার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই। কম লবণযুক্ত ঘোল স্বাস্থ্যের  জন্য উপকারী।  কিন্তু মোড়কজাত সংরক্ষিত খাবারের ব্যপারে সাবধান।
প্রাকৃতিক ভাবেই বিভিন্ন খাবারে লবণ থাকে। যেমন- দুধে প্রতি ১০০ গ্রামে ৫০ মিঃ গ্রাম এবং ১০০ গ্রাম ডিমে ৮০ মিঃগ্রাম লবণ থাকে। খাবার সংরক্ষণের জন্য নানাবিধ রাসায়নিক উপাদানের কথা বাদ দিলেও, এসকল খাবারে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  এজন্য মোড়ক জাত খাবার কেনার আগে মোড়কের গায়ে উল্লিখিত লবণের পরিমাণ দেখে নেওয়া উচিৎ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আধ কাপ পরিমাণ হিমায়িত মটরশুঁটিতে ১২৫ মিঃ গ্রাম লবণ থাকে। সমপরিমান কৌটাজাত মটরশুঁটিতে ৩৮০ মিঃ গ্রাম লবণ থাকে। অর্থাৎ কৌটাজাত মটরশুঁটিতে সাধারণ হিমায়িত মটরশুঁটির চেয়ে  তিনগুণ বেশী লবণ থাকে। অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন- পাউরুটিতে ২৫০ গ্রামে ১০০ মিঃ গ্রাম আর বেকনে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৫০০ মিঃগ্রাম লবণ থাকে।  পপ কর্ণে ১০০ গ্রামে ১৫০০মিঃগ্রাম, সয়া সসে ১০০ গ্রামে ৭০০০ মিঃগ্রাম লবণ থাকে। এভাবে সব সংরক্ষিত খাবারের প্যাকেটে লবণের পরিমাণ দেখে নিলে বোঝা যায় আমরা কি পরিমাণ লবণ গ্রহণ করছি। 
লবণ ছাড়া যাদের নিকট খাবার বিস্বাদ মনে হয় তারা বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মশলা যেমন- আদা, মরিচ, রসুন, লবঙ্গ, গোল মরিচ, ব্যাসিল, পার্স লি , পেস্তা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যের মধ্যে রয়েছে- শিম এবং মটরশুঁটি ( প্রতি ১০০ গ্রামে ১৩০০ মিঃগ্রাম), বাদাম ( প্রতি ১০০ গ্রামে ৬০০ মিঃগ্রাম), সব্জি যেমন- পালং , বাঁধাকপি, পার্সলি(১০০গ্রামে ৬০০ মিঃগ্রাম) এবং বিভিন্ন ফল যেমন-কলা, পেঁপে, খেজুর (১০০ গ্রামে ৩০০ মিঃগ্রাম)।
আমাদের বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে লবণ বেশী খাওয়া আর পটাসিয়াম কম খাওয়া। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন এটা উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ থাকা মানেই হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া । আর হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত এখন পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু এবং শারীরিক অক্ষমতার প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান নির্দেশনায় ২ বছরের ওপরের শিশুদের জন্যও করনীয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । কারণ আজকের যে শিশুটির রক্তচাপ বেশী, বড় হলেও তার উচ্চ রক্তচাপ থাকে। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা বিভিন্ন দেশের জন স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কারণ বিভিন্ন অ-সংক্রামক ব্যাধি যেমন হৃদরোগ, পক্ষাঘাত, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, ক্রনিক হাঁপানি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিক নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই নির্দেশনার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত প্রতিরোধ করার জন্য জনগণ কে কম লবণ খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সুবিধা হবে। এ ছাড়া খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সমূহকে লবণের ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে সজাগ করা সম্ভব হবে।

Sunday, 10 February 2013

পুরুষদের মেদ ভুঁড়ি






মেদ-ভুড়ি নিয়ে আর হাসি-তামাশা করা যাচ্ছে না। আগে ভুঁড়ি সম্পদ এবং আভিজাত্যের পরিচয় বহন করতো। ভুঁড়িদার ব্যক্তিদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে কিছু রসিকতাও করা হতো। কিন্তু আজকাল ভুঁড়ি একেবারে বেমানান বিষয়।  তারপরেও আমাদের অনেকের ভুঁড়ি বড় হচ্ছে, ভুঁড়িদারদের কাফেলা লম্বা হচ্ছে। এটা মোটেও সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। পেটে প্রতি কেজি অতিরিক্ত চর্বি জমার মানে স্বাস্থ্যের ওপর ক্রমশ হুমকি বেড়ে যাওয়া।  
মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের পেটে চর্বি জমা হওয়ার প্রবণতা বেশী। কারো ওজন যাই হোক না কেন, পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমা নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে; যেমন-
  • হৃদরোগ
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • মস্তিস্কের পক্ষাঘাত
  • বিভিন্ন ধরণের ক্যানসার
  • ডায়াবেটিস মেলিটাস ( টাইপ-২)
  • ইনসুলিন প্রতিরোধ্যতা বেড়ে যাওয়া
  • রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া
  • কম ঘনত্বের ভালো কোলেস্টেরল কমে যাওয়া
  • বিপাকজনিত সমস্যা (Metabolic syndrome)
  • ঘুমের মধ্যে বার বার দম বন্ধ হয়ে যাওয়া (Sleep apnoea)
অনেকে জানতে চান- পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমেছে কিনা তা কেমন করে বোঝা যাবে।  সাধারণত কটিদেশ এবং কোমরের মাপ নিয়ে তার অনুপাত নির্ণয় করলে এটা বোঝা যায়। আরেকটি সহজ উপায় হচ্ছে শরীরের ঘনত্ব সূচক (Body mass index - BMI) নির্নয় করা। তবে যে কারো কটিদেশের মাপ (Waist size) জানলেই আন্দাজ করা যায় তার অবস্থা কি? সাধারণত যাদের কটি ৪০ ইঞ্চির (১০২ সেঃমিঃ) বেশী তারা বিপদের মুখে রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন চলে আসে- বয়সের সঙ্গে কি ভুঁড়ির কোন সম্পর্ক আছে? এর উত্তর হচ্ছে বয়স বাড়ার পাশাপাশি কেউ যদি শরীর চর্চা বা ব্যায়াম না করেন, তাহলে তার পেশী ক্ষয় হতে থাকে এবং এর ফলে শরীরের ক্যালরি খরচের পরিমাণ আরও কমে যায়। এজন্য বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভুঁড়ি বাড়তে থাকে।
স্থূলকায়তা কিংবা অতিরিক্ত ওজনের জন্য অনেকে বংশগতি বা জিনকে দায়ী করে থাকেন। তবে বংশগতি বা জিন যত না ওজন বাড়ার জন্য দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশী দায়ী আমাদের জীবনাচরণ বা লাইফ স্টাইল। সাধারণত যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে এবং বেশী খায়- তারাই মোটা হয়। তাদেরই ভুঁড়ি বাড়ে। অতিরক্ত মদ্যপান বিশেষত বিয়ার সেবন করাকেও ভুঁড়ি হওয়ার জন্য দায়ী করা হয়। অতিরিক্ত বিয়ার সেবন করলে প্রচুর চর্বি জমে যায়। অতএব যারা ভুঁড়ি কমাতে চান তাদের এ বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেমন করে ভুঁড়ি কমাবো?
ভুঁড়ি কমানো আর শরীরের ওজন কমানোর মূল সূত্র একই- ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে আর শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ক্যালরি গ্রহণ কমানোর সহজ কোন বুদ্ধি নেই। তবে কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে-
  • ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে।
    • পাতে খাবারের পরিমাণ কম নিতে হবে
    • তেল-চর্বির পরিবর্তে শাকসবজি-ফলমূল বেশী খেতে হবে
    • ফাস্ট ফুড যত কম খাওয়া যায়, ততই মঙ্গল
    • রেস্টুরেন্টে যত কম খাওয়া যায় ততই মঙ্গল
    • রেস্টুরেন্টে যেয়ে অন্যদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেলে কম খাওয়া হবে।
  • শারীরিক পরিশ্রম বাড়াতে হবে।
    • সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের প্রত্যেকের প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে আড়াইঘণ্টা  (১৫০ মিনিট) মাঝারী মানের শারীরিক ব্যায়াম করা উচিত অথবা ৭৫ মিনিট ভারী ব্যায়াম করা যেতে পারে। যারা ওজন কমাতে চান তাদের এর চেয়ে বেশী ব্যায়াম করতে হবে এবং তা নিয়মিত চর্চা করতে হবে।
    • যাদের পক্ষে একটানা বেশী সময় ব্যায়ামের ফুরসৎ নেই, তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্পসময়ে কিংবা বার বার ব্যায়াম করতে হবে।
    • নৈশ ভোজের পর অবশ্যই কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে।
    • একবার ওজন সঠিক মাত্রায় নিয়ে আসতে পারলে তা বজায় রাখার জন্য যথাযথ খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়াম চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
সবশেষ কথা হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে অতিরিক্ত মেদ-ভুঁড়ি কমানো সম্ভব। প্রয়োজন একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা এবং ধৈর্য। কয়েক কেজি ওজন কমাতে পারলেই তা চিত্তকে প্রফুল্ল করে এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি বহুলাংশে লাঘব করে।   


পুরুষদের কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যা



আজকাল স্বাস্থ্য সেবার একটি বড় অংশ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে । সহস্রাব্দ লক্ষ্যের প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে মায়েদের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন। এতসব প্রচেষ্টা এবং প্রচার-প্রচারণার ভীড়ে বাবাদের স্বাস্থ্য বা পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি আমরা অবহেলা করছি কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে । কারণ মহিলা ও শিশুদের বিষয়ে সকলে যতটা সহানুভূতি এবং আগ্রহ সহকারে স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেন , বাড়ীর কর্তাটির কথা সেখানে আজকাল অনেক সময় কারও মনে থাকে না। আর নারীদের অধিকার আন্দোলনের প্রবল স্রোতের তোড়ে বেচারা পুরুষরা তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভুলতে বসেছে কিনা সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা কি? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Center for disease control and prevention)  পুরুষদের স্বাস্থ্য  সমস্যার একটি তালিকা করেছে। পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাটি কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ছোট। সেখানে পুরুষদের শত্রু হিসাবে প্রধান সাতটি রোগ-ব্যাধিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সাত রকমের রোগ-ব্যাধির প্রতি নজর দিলে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করলে পুরুষ প্রজাতির সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যায়।
১। হৃদরোগ
পুরুষের প্রধান শত্রু হৃদরোগ। অতএব সকল পুরুষকে হৃদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এজন্য-
  • ধূমপান পরিহার করতে হবে। হৃদপিণ্ডের অন্যতম প্রধান শত্রু ধূমপান। অতএব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সব ধরণের ধূমপান পরিত্যাগ করতে হবে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ। শাক-সবজী, ফলমূল, আকাঁড়া শস্য দানা, অতিরিক্ত আঁশযুক্ত খাদ্য ইত্যাদি বেশী বেশী খেতে হবে। কিন্তু সম্পৃক্ত চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
  • ক্রনিক রোগ পরিহার করতে হবে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস হলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে । নিয়মিত যে কোন ধরণের শরীরচর্চা কিংবা খেলাধুলা করতে হবে।
  • শরীরের ওজন সীমিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন মানেই হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত বোঝা।
  • মদ্যপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল রক্ত চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং তা হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
  • মানসিক চাপ এবং উদ্বেগমুক্ত হতে হবে। সবসময় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই মানসিক চাপ মুক্ত হাসিখুশি প্রাণবন্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে।

২।ক্যান্সার
হৃদরোগের পরে পুরুষের দ্বিতীয় প্রধান শত্রু ক্যান্সার। ফুসফুস, প্রোস্টেট, অন্ত্র, ত্বক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সার বহু পুরুষের অকাল মৃত্যুর কারণ। ক্যান্সার ঝুঁকি কমানোর জন্য নীচের পদক্ষেপগুলি বেশ কার্যকরী ।
·         ধূমপান পরিহার করতে হবে। ধূমপান পরিহার করলে যেমন হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে, তেমন ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে। এমন কি পরোক্ষ ধূমপান থেকে দূরে থাকলেও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
·         ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে নানা ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
·         ব্যায়াম করতে হবে। নিয়মিত শরীর চর্চা ওজন কমাতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং একই ভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়।
·         প্রচুর শাক-সবজী এবং ফলমূল খেতে হবে। শাক-সবজী এবং ফলমূল ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী।
·         সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। অতিরিক্ত সৌরালোক ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। সূর্যের আলোতে অতিরিক্ত ঘোরাঘুরি করলে অবশ্যই সানস্ক্রিন (Sunscreen) বা সূর্যালোক সুরক্ষাকারী ক্রিম ব্যাবহার করতে হবে কিংবা ছাতা ব্যবহার করা উচিত।
·         মদ্যপান সীমিত করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে অন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি, যকৃত ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অতএব মদ্যপান পরিহার করলে এটা প্রতিরোধ করা যায়।
·         ক্যান্সার শনাক্তকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা । কিছু-কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সুপ্তাবস্থায় বা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে তার চিকিৎসা করা যায়।  এজন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।  
৩। দুর্ঘটনা
মোটর যানবাহন দুর্ঘটনা পুরুষদের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পথঘাটে চলাফেরার সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। যানবাহন ব্যবহারের সময়  মাথায় হেলমেট পরা এবং সিট বেল্ট বাঁধা গুরুত্বপূর্ণ। মদ্য পান কিংবা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যানবাহন চালনা কর উচিত নয়।
৪। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী অবরোধাত্মক ব্যাধি
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগে অনেক পুরুষের স্বাস্থ্যহানি হয়ে থাকে।  বিশেষত ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস এবং পালমোনারি এমফিসিমায় অনেক পুরুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিতঃ
·         ধূমপান পরিহার করতে হবে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগের প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপান পরিহার করলে এর থেকে মুক্ত থাকা সহজ হয়।
·         বায়ূ দূষণ পরিহার করতে হবে। ধুলাবালি ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ এড়িয়ে চলতে  হবে।
·         শ্বাসনালীর সংক্রমন প্রতিরোধ করতে হবে। ঘন ঘন শ্বাসনালীর সংক্রমন ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। অতএব শ্বাসনালীর সংক্রমন থেকে মুক্ত থাকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
 ৫। মস্তিস্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক
মস্তিস্কের পক্ষাঘাতের অনেক ঝুঁকি উপাদান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন- বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জাতি ইত্যাদি। কিন্তু কতগুলি উপাদান আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেমন-
  • ক্রনিক রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ইত্যাদি পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পক্ষাঘাত প্রতিরোধের জন্য জরুরী।
  • ধূমপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।  কিন্তু ধূমপান পরিহার করে পক্ষাঘাতের সংখ্যা কমানো সম্ভব।
  • মদ্যপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপানেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। সুতরাং মদপান পরিহার করলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।  
৬। ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস বিশেষত টাইপ-২ ডায়াবেটিস  থাকলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে হৃদরোগ, স্নায়ু রোগ, কিডনির সমস্যা, চোখের রেটিনার সমস্যা এবং আরও অনেক জটিলতা হয়।এজন্য ডায়াবেটিস  নিয়ন্ত্রণে রাখা সুস্থ থাকার জন্য জরুরী। এজন্য-
·         নিয়মিত জীবনাচরণ মেনে চলতে হবে
·         স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে
·         নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে
·         অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
৭। আত্মহত্যা
পুরুষের স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আত্মহত্যার প্রবণতা। সাধারণত বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। কারও বিষন্নতার লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে অবশ্যই তার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে বিষণ্ণতা দূর করার মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সবশেষে বলতে হয় স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা সহজ; কিন্তু প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ নয়। তবে সবক্ষেত্রে পুরুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল সূত্রটি একই; আর তা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করা, ধূমপান পরিহার করা, মদ্যপান না করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।এর সুফল আমরা যা মনে করি, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী।

ক্যান্সার সচেতনতা বাড়ানো দরকার




ক্যান্সারশব্দটি শুনলে কার না ভয় হয়? কারণ ক্যান্সার ঘাতক ব্যাধি। একবার হলে আর রক্ষা নাই। আগে আমাদের দেশে কলেরা, বসন্ত, পোলিও, হাম, হুপিং কাশি, যক্ষ্মা ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ খুব বেশি ছিল। এখন আমরা এসব সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ অনেকাংশে কমাতে পেরেছি। গুটি বসন্তকে তো পৃথিবী থেকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে; পোলিও রোগও বিদায়ের পথে। নানা রকম টীকা আবিষ্কারের ফলে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির হারও কমেছে। কিন্তু বেড়ে গেছে অসংক্রামক ব্যাধির পরিমাণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ আর ক্যান্সার এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। এসব অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে ক্যান্সার একটি প্রধান স্থান দখল করে আছে। কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা এখনো তেমন সচেতন নই। আরো সচেতন থাকলেও প্রতিরোধের তেমন কোনো উদ্যোগ বা জোগাড়-যন্তর নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সালে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল ক্যান্সার। প্রথম স্থান দখল করে ছিল হৃদরোগ। ওই সময় ক্যান্সারে মৃত্যুর হার ২৩% ছিল। অর্থাৎ প্রায় প্রতি চারটি মৃত্যুর একটি ঘটেছে ক্যান্সারের জন্য। ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ ক্যান্সার। হৃদরোগ এবং সংক্রামক ব্যাধির কারণে মৃত্যু যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশে ক্যান্সারের জন্য প্রায় ১১% লোক মারা যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে অন্তত ১টি ঘটে ক্যান্সারের জন্য। হিসাবটিকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যায় না।
দেশে দেশে ক্যান্সারের রকমফের দেখা যায়। আবার নারী-পুরুষভেদে ক্যান্সারের প্রকোপ বিভিন্ন হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়, তা হলো পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুস, প্রোস্টেট এবং অন্ত্রের ক্যান্সার; আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ফুসফুস, স্তন এবং অন্ত্রের ক্যান্সার। ক্যান্সারের কারণে যত মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় এগুলোর জন্য।
বাংলাদেশে ক্যান্সারের কারণে তালিকায় পুরুষদের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, খাদ্যনালি, ঠোঁট, গলা ও পাকস্থলীর ক্যান্সার; আর মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ, স্তন, ফুসফুস এবং খাদ্যনালির ক্যান্সার। খাদ্যাভাস, বিড়ি-সিগারেট, পান, তামাক, জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে ঠোঁট, গলা ও খাদ্যনালির ক্যান্সার বেশি হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পাকস্থলীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এসব উপাদানের পাশাপাশি হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামে পরিচিত এক রকম ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
ক্যান্সারের প্রকোপ বিগত বছরগুলোতে বাড়লেও এ সম্পর্কে সচেতনতা তেমন বাড়েনি। কিন্তু সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে অনেক অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করার আজকাল অনেক পদ্ধতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়, ক্যান্সার স্ক্রিনিং করার জন্যও তেমন পরীক্ষা রয়েছে। অবশ্য এ ধরনের পরীক্ষার খরচ কম হতে হবে, সহজে সম্পন্ন করতে পারতে হবে এবং স্বল্প সময়ে অনেক লোকের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ক্যাম্পে শত শত মানুষের প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে মূত্রে চিনি নির্গত হচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়। আজকাল ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ক্যান্সার স্ক্রিনিং। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা হলে রোগীর মৃত্যু রোধ করা যায় এবং চিকিৎসার ব্যয় সাশ্রয় করতে সাহায্য করে। ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য যেসব স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয় তাদের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে
  • এ পরীক্ষার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্যান্সার সুপ্তাবস্থায় কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয়।
  • পরীক্ষাটি উপযুক্ত এবং রোগীর কাছে গ্রহণযোগ্য।
  • শনাক্ত করার পর ক্যান্সারটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • শনাক্তকরণ পরীক্ষাটির খরচ কম হতে হবে।
ওপরের সব শর্ত পূরণ করে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা সব দেশে চালানো সম্ভব হয় না। কারণ ক্যান্সারের প্রকোপ সব দেশে এক রকম নয়। আর শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার ব্যয় সঙ্কুলান করাও সব দেশের পক্ষে সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষার সুপারিশমালা দেয়। অন্যান্য মেডিকেল সোসাইটি এবং সরকারি সংস্থাগুলোরও সেখানে ভূমিকা রয়েছে। প্রতি বছর বসন্তকালে এ সম্পর্কিত একটি বিবরণী প্রকাশ করা হয় এবং বিভিন্ন সময় সুপারিশ নবায়ন কিংবা সংশোধন করা হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ সক্রিয়। সাধারণত যে কোনো মহিলার বয়স ৪০ বছর অতিক্রম করলে প্রতি বছর তাকে ম্যামোগ্রাম করার সুপারিশ করা হয়। ম্যামোগ্রাম স্তনের এক ধরনের এক্সরে যার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। যেসব মহিলার বয়স ২০ বছর অতিক্রম করেছে তাদের অন্তত প্রতি ৩ বছরে একবার স্তন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করানো উচিত। ৪০ বছর বয়সের পর প্রতি বছরই এটা করতে হয়। আগে ২০ বছর বয়সের বেশী হলে মহিলাদেরও স্তন নিজে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করা হতো। ম্যামোগ্রাম আসার পর এটার ওপর আর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু প্রতি মাসে একবার স্তন নিজ হাতে পরখ করে দেখাটাই সবচেয়ে এবং সুলভ স্ক্রিনিং পরীক্ষা। এটা করলে অনেক স্তন ক্যান্সার একেবারে অঙ্কুরেই শনাক্ত করা যায়। বাংলাদেশে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়ানোর পরও দেখা যায় তারা নির্বিকার থাকেন এবং যখন এটা শনাক্ত করা হয়, তখন আর তেমন কিছুই করার সুযোগ থাকে না। কারো স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তাদের শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে আরো নিবিড় যত্নশীল হতে হবে। বর্তমানে অনেকে ৫০ বছর বয়স হওয়ার পরে ম্যামোগ্রাম করার সুপারিশ করছেন। কারণ ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তেমন বেশি স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে না। কিন্তু আমেরিকার বীমা কোম্পানিগুলো এখনো ৪ বছর বয়সের সীমারেখাই মেনে চলছে।
অন্ত্রের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে মলে রক্ত আছে কি না তা পরীক্ষা করা যায়। মলে রক্ত পরীক্ষা পজিটিভ হলে কলোনোস্কপি করানোর প্রয়োজন হয়। এছাড়া ডাবল কনট্রাস্ট বেরিয়াম ইনিমা এবং বিশেষ ধরনের সিটিস্ক্যান করা যায়।
আজকাল অন্ত্রের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য মলে ক্যান্সারের ডিএনএ টেস্ট করাকে বেশি উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের পরীক্ষা বেশ ব্যয়বহুল এবং এখনো সর্বত্র পাওয়া যায় না। অন্ত্রের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সবসময় সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অন্ত্রের ক্যান্সার সম্পর্কে চিকিৎসকের সন্দেহ এবং পরীক্ষা করানোর রোগীর আগ্রহ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং রোগীর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্যাপটেস্ট এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি যে কোনো মহিলার যৌনমিলন শুরুর তিন বছরের মাথায় প্যাপটেস্ট এবং ডিএনএ টেস্ট করানোর সুপারিশ করে থাকে। অন্যান্য সংস্থা বয়স ২১ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর কিংবা প্রতি তিন বছরে ১ বার শনাক্তকারী পরীক্ষা করানোর সুপারিশ করে থাকে। জরায়ু গ্রীবায় অ্যাসিটিক অ্যাসিড কিংবা লুগলস্ আয়োডিন লাগিয়ে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা আরেকটি সহজ শনাক্তকারী পরীক্ষা। এটা ভায়া টেস্টনামে পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর তেমন প্রচলন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যয়হৃত এবং সুলভ পরীক্ষা।
জরায়ু গ্রীবা কিংবা যোনিরসে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ডিএনএ পরীক্ষা করানো খুবই সহজ প্রক্রিয়া কিন্তু ব্যয়বহুল। এর নমুনা সংগ্রহের জন্য কোনো চিকিৎসকেরও প্রয়োজন হয় না। রোগী নিজেও এটা করাতে পারেন। আজকাল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টীকা ও পাওয়া যায়। এ টীকা ব্যবহারের ফলে জরায়ু গ্রীবার ক্যান্সারের প্রকোপ অনেক কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য এ টীকা সর্বত্র পাওয়া যায় না এবং যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
অন্যান্য ক্যান্সারের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করা সম্ভব। পুরুষের মূত্রথলির গ্রীবায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড অবস্থিত। সাধারণত পুরুষদের বয়স ৫০ বছর অতিক্র করলে প্রাথমিক শনাক্তকরণ পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়। তবে প্রোস্টেটের ক্যান্সার পরীক্ষার সুপারিশ নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে পুরুষদের ক্যান্সারের মৃত্যুর কারণের শীর্ষে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য বুকের এক্স-রে, সিটিস্ক্যান এবং থুথু পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মধ্যে স্ক্রিনিং করার জন্য পরীক্ষাগুলো উপযুক্ত নয়। এজন্য অধিকাংশ ফুসফুসের ক্যান্সার খুব বিলম্বে শনাক্ত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূলে হাতিয়ার ধূমপান পরিহার করা।
ফুসফুসের সবচেয়ে শত্রু তামাক। একমাত্র ধূমপানবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে খাদ্যনালি, মুখগহ্বর এবং পাকস্থলীর ক্যান্সারের প্রকোপও খুব বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এসব ক্যান্সারের জন্যও কোনো সহজ এবং সুলভ প্রাথমিক শনাক্তকারী পরীক্ষা নেই। ঠোঁট এবং মুখগহ্বরের ক্যান্সারের সঙ্গে তামাকের সম্পর্ক রয়েছে। অতএব এখানেও আমাদের তামাক সেবন প্রতিরোধের পর গুরুত্ব দিতে হবে।
ক্যান্সার ঘাতক ব্যাধি। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে অনেক অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। এজন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার করার ওপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের পক্ষে ক্যান্সারের চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার বহন করা সহজ নয়। অতএব ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করায় আমাদের ক্যান্সার বিজয়ের কৌশল।  

রাগের আগুন বশে রাখুন



অন্যান্য আবেগের মতো রাগ একটি স্বাভাবিক মানবিক আবেগ। অবশ্য পৌরাণিক কাহিনিগুলোয় দেবতাদের ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে অ্যারিস রাগ বা ক্রোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যারিস কখন কীভাবে কার ওপর রেগে যান, এই ভয়ে তাঁর জন্য কোনো উপাসনালয় তৈরি হয়নি। হিন্দুদের দুর্বাশা মুনিও রাগের জন্য যথেষ্ট পরিচিত।
আমাদের আজকের প্রশ্ন, মানুষ কেন রাগে? অবশ্য এককথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। আনন্দ-বেদনা-হতাশার মতো নিত্যনৈমিত্তিক আবেগের কথা যদি বলি, তাহলে ক্রোধ বা রাগও তেমন একটি আবেগ। কোনো ঘটনায় আমরা যেমন খুশি কিংবা মনঃক্ষুণ্ন হই, তেমনি কোনো কোনো ঘটনায় রাগান্বিত হই।
একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রাগ মেনে নেওয়া গেলেও, মাত্রাবিহীন রাগারাগি কারও কাম্য নয়। অতিরিক্ত ক্রোধ স্বাস্থ্যহানিকর। এখন কীভাবে বুঝব, রাগের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন কিংবা তা অস্বাস্থ্যকর?
এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। ক্রোধের কারণে বন্ধু-বান্ধব যদি আপনাকে এড়িয়ে চলে, চাকরিবাকরি বিপন্ন হয় কিংবা আশপাশের মানুষ যদি আপনাকে রাগী হিসেবে ভয় পেতে শুরু করে, তাহলে বুঝতে হবে, আপনার ক্রোধের আগুন বশে আনা দরকার। কারণ, অতি ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
রাগারাগি করা কি শুধুই স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া? নাকি এর পেছনে বংশগত কোনো কারণ রয়েছে? বিজ্ঞানীরা এখনো ক্রোধের জন্য দায়ী কোনো জিন শনাক্ত কিংবা চিহ্নিত করেননি। তবে অনেকের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। এটিকে অনেকে অকস্মাৎ ক্রোধ বিস্ফোরণনামে উল্লেখ করে থাকেন। এ ধরনের প্রচণ্ড রাগের প্রকাশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আশপাশের মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন; এমনকি অন্যদের ওপর শারীরিক আক্রমণও করতে পারেন। এটিকে রোগ হিসেবে গণ্য করলেও এর কোনো কারণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি দুজন ব্যক্তির মধ্যে একজন রেগে যান; অথচ অপরজন কেন ক্রোধান্বিত হন না? অন্যান্য সাধারণ অনুভূতির মতো এখানে একই ঘটনা ঘটে। একটি ঘটনা কার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেটাই রেগে যাওয়া কিংবা না যাওয়ার নিয়ামক। ক্রোধান্বিত ব্যক্তি কি অন্যদের জন্য বিপজ্জনক? কিংবা এটা কি পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করে? অবশ্যই ক্রোধান্বিত ব্যক্তি অপরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারেন এবং ক্রোধান্বিত ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।
আজকাল যত নারী কিংবা শিশু নির্যাতনের ঘটনা আমরা দেখতে পাই, এর অধিকাংশের মূলেই রয়েছে ক্রোধ কিংবা রাগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ক্রোধ কিংবা আক্রোশ পুরুষের। অবশ্য কখনো কখনো মহিলাদের চণ্ডমূর্তি দেখা যায়। সব সময় ক্রোধে ফুঁসতে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কারণ রাগী ব্যক্তির সামনে কেউ মুখ খোলে না, কিংবা যুক্তিতর্কে লিপ্ত হতে চায় না। এটা পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক নয়। রাগ ও ক্রোধ মাত্রাভেদে অনেকের শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। অল্প অল্প রাগারাগিতে হয়তো কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অতিরিক্ত রেগে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
যাঁদের হৃদযন্ত্র দুর্বল, তাঁদের হার্ট অ্যাটাক কিংবা অনেক সময় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়ে পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক হয়ে যায়। এর ফলে মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেগে গেলে কীভাবে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? এর কোনো সহজ সমাধান নেই। আপনাকে রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত কিছু না করে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। রাগের যথার্থ কারণ আছে কি না তা ভাবতে হবে এবং বিষয়টির ঠিক-বেঠিক দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। ক্রোধান্বিত মস্তিষ্কে এত কিছু ভাবা যায় না। অতএব সমাধান হচ্ছে - সময় নেওয়া। মনে রাখতে হবে, আজকে আপনি রাগ করছেন, আগামীকাল আপনার রাগ থাকবে না। কিন্তু রাগের মাথায় যে মানসিক কিংবা শারীরিক আঘাত অপরকে করা হয়, সেটি কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। এ জন্য রাগের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করার পরিবর্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে নিরিবিলি কোথাও ঘটনার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সর্বোত্তম।
যদি এমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে রাগের প্রতিক্রিয়া কোনো ভঙ্গুর বস্তুর ওপরে প্রক্ষেপ করা যায়। যেমন - রাগ কমানোর জন্য অনেককে দেয়ালে মুষ্টাঘাত করতে দেখা যায়, কেউ কেউ থালা-বাসন কিংবা ফুলদানি ভাঙেন। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়াও অনেক সময় আশপাশের মানুষের জন্য ভীতি সৃষ্টি করে। এ জন্য বলা হয়, রেগে গেলে খেলতে চলে যান, দৌড়াতে পারেন কিংবা টিভি দেখতে পারেন। এ ধরনের ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে রাগ কমানো যায়।
মনে রাখতে হবে, আমাদের রেগে যাওয়া স্বাভাবিক আবেগ। রাগার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু রাগের বশে কাউকে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। অনেক সময় না রাগার জন্য হরেক রকম কসরত করেও আমরা ক্রোধ সংবরণ করতে পারি না। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে আমরা রেগে যেতে বাধ্য হই এবং হতাশ হয়ে পড়ি। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ। রাগের কারণে হতাশা এলে ক্রোধ আরও বেড়ে যায়।
অতএব হতাশা গ্রাস করার আগেই রাগের কারণ বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকের রেগে যাওয়া একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, বলা যায় রেগে যাওয়া একটি নেশা হয়ে যায়। রাগলে তাদের মস্তিষ্কে স্বস্তিদায়ক ন্ডোর্ফিন নিঃসরিত হয়। এ জন্য তারা রেগে যাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেন না। কিন্তু আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, রাগের মাথায় কিছু করলে তার ফল কখনোই ভালো হয় না। অতএব রাগের আগুন বশে রাখুন।

রহস্যেঘেরা হার্ট অ্যাটাক





হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা সম্পর্কে সচেতনতা এখন অনেক বেড়েছে। ভগ্নহৃদয় নিয়ে লাখ লাখ কবিতা, গান কিংবা উপন্যাস রচিত হয়েছে। কিন্তু হৃদরোগ বা হার্টঅ্যাটাক সম্পর্কে তেমন আনন্দদায়ক কিংবা হৃদয়গ্রাহী কিছু বলা যাবে না। ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দোকানপাটে কত লাল, নীল কাগজ কিংবা কাপড়ে তৈরি হৃৎপিণ্ডের প্রতীক ঝুলতে দেখা যায়; কিন্তু ত্রিমাত্রিক এই বিস্ময়কর অঙ্গটির প্রকৃত কার্যকলাপ কিংবা ভালোমন্দ নিয়ে হয়তো অনেক সময় ভাবার সময় পাই না।


হৃদরোগ হলে সহজেই বোঝা যায়



শুনতে অবাক হলেও হৃদরোগে আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ থেকে ৬ জন বুঝতে পারেন না যে তাদের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। তাদের বুকে ব্যথা হয়, দম আটকে আসে, শরীর ঘামে-এর পরও তারা সন্দেহ করেন না। অনেকেই জানেন বুকের বাম দিকে হার্টঅ্যাটাকের ব্যথা হয় এবং তা বাম হাতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এমন আদর্শ প্রকৃতির হার্টঅ্যাটাক কমই দেখা যায়। আসলে হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা বুকের মাঝখানে হয়। অনেকেই হার্টঅ্যাটাকে ভুগছেন । কিন্তু বলেন কিংবা মনে করেন তাদের বুকে জ্বালাপোড়া হয়েছে কিংবা তারা অতিরিক্ত দুর্বলতায় ভুগছেন। মেয়েদের হার্টঅ্যাটাকের প্রকৃতি আরো ভিন্নতর। ঈশ্বরের পক্ষে যেমন মেয়েদের মন বোঝা ভার; তেমনি তাদের হৃদরোগও বৈচিত্র্যময়। হার্টঅ্যাটাক হলেও অনেক মহিলা বুকে ব্যথার কথা বলেন না বরং তারা পেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, চোয়াল কিংবা ঘাড়ে ব্যথার অভিযোগ করেন। অতএব প্রশ্নটা যদি হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত হয় তাহলে লক্ষণ-উপসর্গ যত বিচিত্রই মনে হোক না কেন হৃদরোগের ঝুঁকির কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।


ট্রান্সফ্যাটমুক্ত খাবার হৃৎপিণ্ডের জন্য নিরাপদ



অনেক খাবারের বোতল কিংবা মোড়কের গায়ে লেখা দেখা যায়-এটা ট্রান্সফ্যাটমুক্ত। ট্রান্সফ্যাট আসলেই হৃদয়বান্ধব নয়। কিন্তু ট্রান্সফ্যাটমুক্ত খাবার খুঁজে পাওয়াও কঠিন। কাজেই যেকোনো তেল, চর্বিজাত কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। আর খাবার ট্রান্সফ্যাটমুক্ত হলেই যে ভালো তা কিন্তু নয়। ওর ভেতরে সম্পৃক্ত চর্বি থাকতে পারে। সম্পৃক্ত চর্বি হৃৎপিণ্ডের চিরশত্রু। কাজেই আপনি মোড়কজাত যে খাবার কিনেছেন তার গায়ে ট্রান্সফ্যাট এবং তেল ও চর্বির পরিমাণ সম্পর্কে পুরো বৃত্তান্ত পড়ে নেয়া ভালো। অবশ্য আমাদের দেশে কয়টা খাবারের মোড়কেই বা এমন তথ্য দেয়া থাকে?


হৃদরোগ নাকি দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ



হৃদরোগের অনেক লক্ষণ-উপসর্গ দুশ্চিন্তা-উদ্বেগের ছদ্মবেশে আসে। আপনি কাজ করছেন, হঠাৎ হার্টবিট বা হৃদঘাত বেড়ে গেল। আপনার হয়তো মনে হতে পারে এটা উদ্বেগ কিংবা দুশ্চিন্তার কারণে হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অনেক সময় এটা হৃদরোগের জন্যও হতে পারে। অনেকের মাঝেমধ্যে হৃদঘাতে ছন্দ ব্যাহত হতে দেখা যায়। কারো কারো এটা গুরুতর এবং ওষুধ সেবনের প্রয়োজনও হতে পারে।
আজকের প্রতিযোগিতামূলক ব্যস্ত জীবনে উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা আমাদের প্রাত্যহিক সঙ্গী। এসব মেনে নিয়েই আমাদের বসবাস। কিন্তু তারপরও কথা রয়ে যায়। আপনার হৃৎপিণ্ডের গতি যদি সব সময় বেশি কিংবা ছন্দহীন থাকে, তাকে হালকাভাবে নেয়া যাবে না। এটা যদি উদ্বেগ কিংবা দুশ্চিন্তার জন্যও হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু হৃৎপিণ্ডের জন্য দারুণ ক্ষতিকারক। হৃদঘাত দীর্ঘদিন ধরে থাকলে অবশ্যই তা হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেবে। উদ্বেগ কমানোর জন্য যোগ ব্যায়াম, ধ্যান কিংবা শিথিলায়ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে এবং নিয়মিত শরীর চর্চা করতে হবে।


বয়স বেশি না হলে হৃৎপিণ্ড নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই



অনেকের কিন্তু ২০ বছর বয়সেও হার্টঅ্যাটাক হচ্ছে। বয়স বাড়লে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু অনেকের কৈশোরেও হৃদরোগ হয়। আজকাল ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সে হৃদরোগ হওয়ার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো শৈশব থেকেই গড়ে তোলা উচিত। শিশুদের হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি তাদের খেলাধুলা করতে উৎসাহ দিতে হবে, টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের সামনে যত কম সময় থাকা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু আমাদের শিশুরা কি তা করছে?
বিনা মেঘে বজ্রপাত হওয়াটা যেমন সত্য, তেমনি কোনো ঝুঁকির উপাদান না থাকা সত্ত্বেও হার্টঅ্যাটাক হয়। অতএব সচেতন থাকুন, সন্দেহ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।