চকোলেট খেতে পছন্দ করেন না কিংবা চকোলেট উপহার পেয়ে খুশি হন না, এমন মানুষ বিরল। আবাল- বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই চকোলেটের ভক্ত। চিকিৎসকের নিকটে গেলে যারা খাবার মেনে চলার লম্বা ফিরিস্তি নিয়ে বিরস বদনে বের হয়ে আসেন, তাদের জন্যও এখন অন্তত একটি সুখবর দেওয়া যায়- প্রাণ ভরে চকোলেট খেতে পারেন। কারণ সম্প্রতি গবেষকগণ বলেছেন চকোলেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
অষ্টাদশ শতকে সুইডিস প্রকৃতি বিজ্ঞানী ক্যারলাস লিনিয়াস চকোলেটের গাছের নাম দেন ক্যাকাও থিওব্রোমা (Cacao
theobroma)। ক্যাকাও শব্দের অর্থ ‘ঈশ্বরের খাদ্য’| তারপর শতশত বছর যাবৎ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ চকোলেট প্রেমে আপ্লুত হয়েছে। অতএব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে কি যাদু আছে এই চকোলেটর ভিতরে?
চকোলেটের ইতিহাস অনেক পুরোনো| ষষ্ঠ শতকের দক্ষিণ আমেরিকার সভ্যতার অধিবাসীরা উত্তরাঞ্চলের ইউকাটান এলাকায় কোকো গাছ লাগানো শুরু করে। মনে করা হয় মায়া সভ্যতার অধিবাসীরা কয়েক শত বছর ধরে কোকোর সঙ্গে পরিচিত ছিল। এটাকে তারা অত্যন্ত মূল্যবান পণ্য হিসেবে গণ্য করতো। কেনা-বেচার জন্য তারা কোকো -কে মুদ্রা হিসাবে বিনিময় করতো এবং গণণার জন্য ব্যবহার করা হতো।
মায়া এবং অ্যাজটেকরা ক্যাকাও গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে একধরণের পাbxয় তৈরি করতো যার নাম ছিল ‘জোকোলেটেল’ (Xoco latl)। অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতো ক্যাকাও বীজ স্বর্গ থেকে এসেছে এবং এটা খাওয়ার মাধ্যমে প্রজ্ঞা ও শক্তি অর্জিত হয়।
জোকো (Xoco) শব্দের অর্থ ফেনা। আর অ্যটল (atl) অর্থ পানি। মায়া শব্দ ‘জোকোলেটেল’ থেকেই এসেছে বর্তমান ‘চকোলেট’ শব্দটি। তখন চকোলেট সবসময় পানীয় হিসেবেই পান করা হতো।
মনে করা হয় কলম্বাস নতুন দুনিয়া থেকে ঘুরে আসার সময় ক্যাকাও বীজ এনেছিলেন। কিন্তু রাজা ফার্দিনান্দের দরবারে অন্যান্য মূল্যবান রত্ন রাজির ভিড়ে তখন কেউ কোকো বীজের দিকে গুরুত্ব দেয়নি।
সেপনের ফার্নান্দো কর্টেজ ১৫১৯ সালে মেক্সিকোর সম্রাট মন্টেজুমার দরবারে গেলে চকোলেট প্রথম ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায় মন্টেজুমা ভোজনের পর রত্নখচিত পাত্রে চকোলেট পান করতেন। পাত্রে চকোলেট ফেনার পরিমাণই বেশি থাকতো। ভোজনের পরে এরকম চকোলেট পানীয় পান করাকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হতো। মন্টেজুমা চকোলেট পান করার পর আবার অম্বর যুক্ত তামাকও সেবন করতেন।
ষোড়শ শতকে পেরু এবং মেক্সিকোতে চকোলেট পানীয় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কেউ ঠান্ডা, কেউ গরম চকোলেট পান করতো। অনেকে এর সঙ্গে ঝাল মিশিয়েও চকোলেট পান করতো। এটাকে তারা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী মনে কর‡তb।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইউরোপে প্রথম চকোলেট আমদানী করা হয় ১৮৮৫ সালে। ভেরাক্রুজ থেকে জাহাজে করে সেভিল-এ চকোলেট আনা হয়। ইউরোপীয়রা চকোলেটের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খেতে শুরু করে। অনেকে এর সঙ্গে দারুচিনি এবং অন্যান্য মশলা যোগ করে খেত।
মন্টেজুমার দরবারে দৈনিক ২০০০ কাপ চকোলেট পান করা হতো। এর ভেতর মন্টেজুমা একাই ৫০ কাপ পান করতো।
স্প্যানিশরা অ্যাজটেক জয় করে নেওয়ার পর ইউরোপে ব্যাপকভাবে চকোলেট আমদানী হতে থাকে। স্পেনে খুব দ্রুত চকোলেট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। স্পেন এবং ইউরোপের চকোলেটের ব্যাপক চাহিদা মেটানোর জন্য স্প্যানিশ সেনাবাহিনী মেক্সিকো, পেরু প্রভৃতি দেশে জোর-জবরদস্তি করে কোকো চাষ করাতে থাকে। কোকো চাষ একটি লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়। তার পরেও চকোলেট একটি দামী পণ্য হিসাবেই রয়ে যায় এবং কেবলমাত্র ধনীরাB চকোলেট পান করার সামর্থ রাখতো।
লন্ডনে প্রথম চকোলেটর দোকান খোলা হয় ১৬৫৭ সালে। ১৬৮৯ সালে হ্যান্স স্লোন নামে একজন চিকিৎসক চকোলেটের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে খাওয়ার প্রচলন করেন এবং এটা ম~লত চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী ১৮৯৭ সালে মিল্ক- চকোলেটের স্বত্ব ক্যাডবারি এবং তার ভাইয়েরা কিনে নেন।
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে কঠিন চকোলেট বানানো শুরু হয়। ডোরেট নামে এক ভদ্রলোক ইতালীর তুরিন শহরে এটা প্রথম বানাতে সক্ষম হন।
এর পর চকোলেটের সঙ্গে নানা রকম উপাদান যোগকরে বিভিন্ন ধরণের চকলেট বানানো ïরু করা হয়। ধীরে ধীরে নানা স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধের চকোলেট বানানো হতে থাকে।
স্বাস্থ্যের ওপর চকোলেটের নানামুখী প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কতগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
· চকোলেটের মধ্যে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা অ্যান্টি –অক্সিড্যান্ট হিসেবে কাজ করে।
· চকোলেটের মধ্যে অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট থাকার কারণে অনেকে মনে করেন চকোলেট বার্ধ্যক্য বিলম্বিত করে।
· চকোলেট খেলে জীবনীশক্তি বাড়ে, কাজে-কর্মে উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বাড়ে।
· মহিলাদের মাসিক রজস্রাবের আগে চকোলেটের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ দেখা যায়।
· চকোলেটে বেদনানাশক ক্ষমতা রয়েছে; চকোলেট খেলে মনে আনন্দ-ফূর্তির মনোভাব জাগে।
· চকোলেটে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম থাকে। চকোলেট সেবন শরীরের ম্যাগনেশিয়ামামের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে।
চকোলেট সম্পর্কে এরকম আরো অনেক তথ্য রয়েছে। তবে এসকল তথ্যের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন।
চকোলেটের স্বাস্থ্যকর গুনাগুন সম্পর্কে প্রথম জvনা যায় পানামার কুনা দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্য পর্যালোচনা করে। ওই দ্বীপের অধিবাসীদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ বাড়েনা। এমন কি তাদের মধ্যে হৃদরোগের হারও অনেক কম। বিজ্ঞানীরা এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলেন কুনা দ্বীপের অধিবাসীরা প্রচুর চকোলেট যুক্ত খাবার গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে কুনা দ্বীপের অধিবাসীরাই যখন শহরে বসবাস করে এবং চকোলেট কম খায়, তখন তাদের মধ্যে উচ্চরক্ত চাপ এবং হৃদরোগের হার বেড়ে যায়।
সম্প্রতি ব্রিটেনের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক পুনরায় গবেষণা করে জানাচ্ছেন চকোলেট বেশি খেলে বিভিন্ন ধরণের হৃদ-বিপাকীয় ব্যাধি যেমন-হৃদরোগ,স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদ বিকলতা ইত্যাদির হার এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়।
অতএব এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত জ্ঞান এবং তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি চকোলেটের লোভ সম্বরণ করা দরকার নেই। আবাল-বৃদ্ধ,বণিতা আনন্দ চিত্তে উপভোগ করুক অন্তত চকোলেটের অমিয় স্বাদ।
No comments:
Post a Comment