শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Wednesday 6 February 2013

হৃদ-বান্ধব খাওয়া-দাওয়া


আমরা প্রতিদিন এমন অনেক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করি যা মোটেও হৃদ-বান্ধব নয়; অর্থাৎ হৃদপিণ্ডকে সুস্থ সতেজ রাখার জন্য উপযোগী নয় আবার যে সকল খাবার হৃদপিণ্ডকে সুস্থ সবল রাখতে সাহায্য করে সে গুলি আমরা খাই না এজন্য আমাদের সকলেরই জানা উচিৎ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখার জন্য আমরা কি খাবো আর কি খাবো না

·         সম্পৃক্ত চর্বি এবং কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার পরিহার করতে হবে
হৃদপিণ্ডের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সকল খাবারে সম্পৃক্ত চর্বি , ট্রান্স ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল বেশী, সেগুলো অবশ্যই আমাদের খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে  জাতীয় তেল-চর্বিযুক্ত খাদ্য বেশী খেলে চর্বির পুরু আস্তর জমে রক্তনালীর ফুটো সহজেই বুজে যায় ফলে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমে যায় কিংবা অংশবিশেষে একেবারে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এর ফলে হৃদরোগ এবং মস্তিস্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
প্রতিদিন হৃদ-বান্ধব খাবারের তালিকায় কতটুকু চর্বি থাকতে পারে তার তালিকা নীচে দেওয়া হলঃ
চর্বির ধরণ
সুপারিশ
Ø      সম্পৃক্ত চর্বি
Ø     দৈনিক গৃহীত সর্বমোট ক্যালরির  শতাংশের কম হওয়া উচিৎ
Ø      ট্রান্স ফ্যাট
Ø     দৈনিক গৃহীত সর্বমোট ক্যালরির  শতাংশের কম হওয়া উচিৎ 
Ø      কোলেস্টেরল
Ø  একজন সুস্থ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ দৈনিক ৩০০ মিঃ গ্রামের কম কোলেস্টেরল গ্রহণ করা উচিৎ
Ø     যারা কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ সেবন করেন কিংবা যাদের রক্তে কম ঘনত্বের কোলেস্টেরল  (LDL) বেশী তাদের ২০০ মিঃ গ্রামের বেশী কোলেস্টেরল গ্রহণ করা উচিৎ নয়  

খাবারে সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্স ফ্যাট কমাতে হলে আমাদের মাখন, ঘি, মার্জারিন,ইত্যাদির ব্যবহার কমাতে হবে  ছাড়া গরু কিংবা খাসির চর্বিযুক্ত মাংস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে  খাবারে চর্বির পরিবর্তে বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে যেমনঃ মাখনের পরিবর্তে ফলের সস, জ্যাম, জেলি কিংবা দই ব্যবহার করা যেতে পারে যে কোন কুকি, ক্র্যাকার, চিপস খাওয়ার আগে গায়ের মোড়কে কি লেখা আছে তা দেখা উচিৎ আজকাল অধিকাংশ কোম্পানি কম চর্বিযুক্ত উপাদান ব্যবহার করছে  সকল খাবারে ট্রান্স ফ্যাট বেশী থাকে ট্রান্স ফ্যাট বলতে আংশিক বিজারিত বা ÓPartially hydrogenated fatÓ কে বোঝান হয় হোটেল কিংবা বাড়ীতে ভাজি করার জন্য যে তেল ব্যবহার করা হয়, অনেক সময় কড়াইয়ের অতিরিক্ত তেল রেখে দিয়ে পরের দিন আবার অন্য তরকারী রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়  ধরণের একবার ব্যবহার করা তেল রেখে দিলে ওটাতে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে এজন্য প্রতিবার রান্নার সময় টাটকা তেল ব্যবহার করা উত্তম আগের দিনের ভাজাভুজির পর কড়াইয়ে রয়ে যাওয়া তেল ব্যবহার করা ক্ষতিকর আর অবশ্যই রান্নার জন্য অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত তেল যেমনঃ সয়াবিন, জলপাইয়ের তেল কিংবা ক্যানোলা তেল ব্যবহার করা উচিৎ বাদাম এবং শসা বীজের তেলেও অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশী থাকে সম্পৃক্ত চর্বির পরিবর্তে অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত তেল ব্যবহার করলে রক্তে কোলেস্টেরল কম থাকে  
উপকারী তেল-চর্বি
ক্ষতিকর তেল-চর্বি©
Ø      জলপাইয়ের তেল
Ø      ক্যানোলা তেল
Ø      ট্রান্স ফ্যাট বিহীন মার্জারিন
Ø      মাখন
Ø      খাসী-গরু-শুকুরের চর্বি
Ø      ক্রিম সস  
Ø      নন-ডেয়ারী ক্রিম
Ø      হাইড্রোজেনেটেড মার্জারিন
Ø      কোকো মাখন
Ø  নারকেল তেল, পাম ওয়েল, তুলা বীজের তেল ইত্যাদি  

·         কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে 

       আমাদের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে হবে কিন্তু এজন্য এমন প্রোটিন করতে হবে যেখানে চর্বি নেই কিংবা চর্বির পরিমাণ খুব কম যেমন- চর্বিমুক্ত খাসী কিংবা গরুর মাংস,মুরগীর মাংস, মাছ, ডিমের সাদা অংশ ইত্যাদি ক্রীম মুক্ত বা সর ছাড়া দুধ খেলেও প্রচুর প্রোটিন পাওয়া যায় তবে চর্বি যুক্ত মাংস খাওয়ার চেয়ে মাছ ভালো কতগুলি মাছ আবার হৃদপিণ্ডের জন্য ভালো কারণ এতে হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে এরা রক্তের অতিরিক্ত ট্রাই গ্লিসারাইডের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে শীত প্রধান দেশের নদী- সাগরের মাছে সবচেয়ে বেশী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে যেমন- স্যামন, ম্যাকারেল, হেরিং মাছ ইত্যাদি কাঠ বাদাম, সয়াবিন এবং ক্যানোলা তেলেও প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে  

       ডাল, মটর শুঁটি , সীমের বীজ এগুলি প্রোটিনের উৎস হিসেবে খুবই ভালো বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এসবে চর্বি এবং কোন কোলেস্টেরল নেই কাজেই যারা চর্বি মুক্ত প্রোটিন খুঁজছেন তারা ডাল, মটর শুঁটি, সীমের বীচি খেতে পারেন প্রানীজ প্রোটিনের পরিবর্তে সয়া প্রোটিন ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর বীফ বার্গার কিংবা হ্যাম বার্গারের পরিবর্তে সয়া বার্গার খাওয়া যেতে পারে এতে বার্গার খাওয়ার শখও মিটবে; আবার অতিরিক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে
ভালো প্রোটিন
মন্দ প্রোটিন
·         কম ননী যুক্ত/ ননী মুক্ত দুধ
·         পনির, দই
·         ডিমের সাদা অংশ
·         মাছ
·         চামড়া মুক্ত মুরগীর মাংস
·         সীমের বীচি
·         সয়াবীন
·         কিমা মাংস
·         পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ
·         গরু-খাসীর মাংস, যকৃত
·         ডিমের কুসুম
·         হট ডগ, সসেজ
·         বেকন
·         ফ্রাইড মিট কাবাব


·         শাক সবজী ও ফল-মূল বেশী খেতে হবে
শাক-সবজী ও ফল-মূলে প্রচুর লবণ এবং ভিটামিন থাকে এসবে ক্যালরি কম কিন্তু প্রচুর আঁশ থাকে এ ছাড়া শাক-সবজী ও ফল-মূলে আরও কিছু বাড়তি উপাদান থাকে যা হৃদরোগ প্রতি রোধে সাহায্য করে; আর বেশী বেশী সবজী-ফল খেলে অতিরিক্ত চর্বি, মাংস, মাখন-স্ন্যাকসের হাত থেকেও মুক্ত থাকা যায় এ জন্য প্রতিবার খাবারের সময় কিছু সবজী ও ফল গ্রহণ করা উচিৎ  

যে সকল শাক সবজী ও ফল বেশী খাওয়া উচিৎ
যে সকল শাক সবজী ও ফল কম  খাওয়া উচিৎ
  • তাজা সবজী ও ফল
  • কম নোনা সবজী
  • কৌটায় সংরক্ষিত চিনি-মুক্ত ফল
  • নারকেল
  • ক্রীম সসযুক্ত সবজী
  • ভাজা সবজী
  • চিনির সিরাপে সংরক্ষিত ফল
  • চিনিযুক্ত হিমায়িত ফল

  • আকাঁড়া শস্য দানা গ্রহণ করা উপকারী
        আকর শস্য দানাতে প্রচুর পুষ্টি এবং আঁশ থাকে এ গুলি হৃদপিণ্ডের জন্য তথা সার্বিক ¯^v‡¯’¨i জন্য  উপকারী  অতি পরিশোধিত খাদ্যের চেয়ে আকর শস্য দানা বেশী পরিমাণে গ্রহণ করা ভালো
যে সকল শস্য দানা বেশী খাওয়া উচিৎ
যে সকল শস্য দানা কম খাওয়া উচিৎ
  • আকর গমের আটা
  • তুষযুক্ত আটার রুটি, পাউরুটি
  • আঁশ যুক্ত শস্য( প্রতিবার ৫ গ্রাম বা তার বেশী)
  • পরিশোধিত সাদা ময়দা
  • সাদ রুটি
  • মাফিনস
  • হিমায়িত ওয়াফেল
  • আকাঁড়া চাল, বার্লি, গম
  • ওট মিল
  • ডো নাট
  • বিস্কুট
  • কেক
  • পাই

  • এগ নুডুলস
  • মাখনযুক্ত পপকর্ণ
  • অতি চর্বিযুক্ত স্ন্যাক ক্র্যাকারস


  • খাবারে লবণের পরিমাণ কমাতে হবে   
        অতিরিক্ত লবণ খেলে রক্তচাপ বেড়ে যায় আর উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের একটি প্রধান কারণ এ জন্য খাবারে লবণের পরিমাণ কম রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদিন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের খাদ্যে সব মিলে আড়াই গ্রাম অর্থাৎ এক চা চামচের কম লবণ থাকা উচিৎ যাদের বয়স ৫১-এর বেশী এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা কিডনির সমস্যা আছে তাদের কখনই প্রতিদিন দেড় গ্রামের বেশী সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিৎ নয় পাতে আলাদা লবণ না খেলে কিংবা রান্নার সময় তরকারীতে অতিরিক্ত লবণ যোগ না করা অবশ্যই খাবারে লবণ কমানোর জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে হবে আমাদের দৈনন্দিন আহারের  একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লবণ আসে কৌটা জাত খাদ্য , প্রক্রিয়াজাত করা খাবার, সুপ, হিমায়িত খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদি উৎস থেকে অতএব লবণ গ্রহণের মাত্রা কমানোর জন্য এ ধরণের খাদ্য দ্রব্যের ব্যাপারেও আমাদের নজর রাখতে হবে
কম নোনা খাদ্য দ্রব্য
অতিরিক্ত নোনা খাদ্য দ্রব্য
  • মশলা এবং হার্বস
  • লবণের বিকল্প উপাদান
  • কম নোনা কৌটাজাত সুপ ইত্যাদি
  • কম নোনা সয়া সস, কেচাপ ইত্যাদি
  • পাতের আলগা লবণ
  • কৌটাজাত সুপ
  • টমেটু সস
  • সয়া সস


  • পাতে কম খাবার গ্রহণ 

    কি কি খেতে হবে, কোন কোন খাদ্য দ্রব্য ¯^v‡¯’¨i  জন্য ভালো, এটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ , কতটুকু খেতে হবে সেটা নির্ধারণ করাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ এজন্য খেতে বসে প্রথমে প্লেটে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ না করা উত্তম এবং সবসময় পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ

·         খাবারের তালিকা আগে-ভাগে ঠিক করা  

     খাবারের তালিকা আগে ভাগে ঠিক করা থাকলে তা  ¯^v‡¯’¨i জন্য উপকারী আমরা এতক্ষন যে সকল বিষয়ে উল্লেখ করেছি, সেভাবে কেউ যদি তার প্রতিদিনের খাবারের মেনু ঠিক করে নেন এবং তা নিয়মিত অনুসরণ করেন, তাহলে অবশ্যই উপকার হবে খাবারের দৈনিক মেনু ঠিক করার সময় আমাদের নীচের বিষয়গুলির প্রতি খেয়াল রাখতে হবেঃ
o       সবজী এবং ফলমূলের পরিমাণ বেশী রাখতে হবে
o       চর্বি মুক্ত প্রোটিনকে প্রাধান্য দিতে হবে
o       অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার রাখতে হবে
o       খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত রাখতে হবে
o       খাবারের পরিমাণ এবং বৈচিত্র্যের বিষয়টিকে ভুলে গেলে চলবে না

·         মাঝে মধ্যে বৈচিত্র্য দরকারী 

           হৃদ-বান্ধব  বিস্বাদ কিংবা আকর্ষণবিহীন হলে তো চলবে না এজন্য অবশ্যই খাবারে বৈচিত্র্য থাকতে হবে এজন্য মাঝে মধ্যে একটি ক্যান্ডি বার কিংবা একমুঠ আলুর চিপস খাওয়া দোষের নয় তবে এটা যেন মাত্রাতিরিক্ত কিংবা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে  
পরিশেষে বলা যায় আমরা হৃদ বান্ধব খাওয়া দাওয়া সম্পর্কে যে দিক নির্দেশনা দিয়েছি তা অনুসরণ করলে যে কেউ উপকৃত হবেন এটা বাস্তবসম্মত এবং আনন্দদায়কও বটে 

No comments:

Post a Comment