বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরে
হরমোনের মাত্রা পরিবর্তিত হতে থাকে। মেয়েদের নিয়মিত রজঃস্রাবের জন্য দায়ী যে সকল
হরমোন, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে তা সহসা কমে যায় এবং রজঃনিবৃত্তি ঘটে।
ইংরেজীতে একে মেনোপজ (Menopause) বলা হয়। পুরুষদের বেলায় পুরুষত্বের
জন্য দায়ী হরমোনের মাত্রা এমন সহসা কমে যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে এর মাত্রা কমতে
থাকে এবং এই পরিবর্তন কয়েক বছর ধরে চলে। এক পর্যায়ে পুরুষত্বের অনেক বৈশিষ্ট্য
হারিয়ে যায়। এক কোথায় একে পুরুষদের মেনোপজ বলা যায়। অধিকাংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী
পুরুষত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ লোপ পাওয়াকে অ্যান্ড্রোপজ (Andropause) বলে থাকেন।
পুরুষত্বের জন্য দায়ী মূল হরমোন
টেস্টোস্টেরন।টেস্টোস্টেরন শরীরে কমে যাওয়ার কারণে আন্ড্রোপজ হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে
মেনোপজ বা রজঃস্রাব নিবৃত্তি হলে ডিম্বস্ফোটন(Ovulation) বন্ধ হয়ে যায়। আর নিয়মিত মাসিক
রজঃস্রাব হয় না। এ পরিবর্তনগুলি খুবই দৃশ্যমান । পাশাপাশি রজঃনিবৃত্তির জন্য
মহিলাদের নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। অনেক মহিলা রজঃনিবৃত্তির
শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন তীব্রভাবে অনুভব করেন; এমন কি এজন্য তারা চিকিৎসকের
পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। আবার অনেকে এ সকল পরিবর্তন তেমন আমলে নেন না এবং
স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। পক্ষান্তরে পুরুষদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে
ধীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমতে থাকে। ফলে টেস্টোস্টেরনের ঘাটতি সহসা তেমনভাবে
দৃশ্যমান হয় না। এজন্য অ্যান্ড্রোপজ কখন ঘটে যায় তা অনেক পুরুষই উপলব্ধি করতে পারেন না। কিন্তু টেস্টোস্টেরন হরমোনের
অভাবে পুরুষের যৌন চাহিদা, মানসিক শক্তি ইত্যাদি ক্রমশ পরিবর্তিত হতে থাকে। এ সকল
পরিবর্তন সকলের অগোচরে ঘটে বিধায় তা সরাসরি দৃশ্যমান হয় না।
ব্যক্তিবিশেষে
পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রার ব্যাপক ভিন্নতা দেখা যায়। কম বয়সী যুবকদের
চেয়ে স্বাভাবিকভাবে বয়স্ক পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কম থাকে। বয়ঃপ্রাপ্ত
হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমতে শুরু করে। গড় পড়তা ৩০ বছর বয়স
হওয়ার পরে এর মাত্রা প্রতিবছর ১% করে কমে; সাধারণত ৭০ বছর বয়স্ক পুরুষের শরীরে এর
মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক কমে যায়। কারও কারও এ মাত্রা আরও কমে যেতে পারে।
স্বভাবত একজন পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বয়স বাড়ার জন্য কমেছে, নাকি
অন্য কোন রোগ-ব্যাধির
জন্য কমেছে তা মুল্যায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে অনেক কারণেই টেস্টোস্টেরনের
মাত্রা কমে যায়; যেমনঃ নিদ্রাকালীন শ্বাস আবদ্ধতা (Obstructive
sleep apnoea)।
একটা প্রশ্ন সকলের মনেই জাগতে পারে-কেমন করে
বুঝব শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমেছে কিনা? সাধারণত অনেক পুরুষের শরীরে
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে গেলেও তেমন কোন লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পায় না। আবার
অনেকের নানা রকম লক্ষন-উপসর্গ দেখা যায়। যেমনঃ
- পুরুষের স্বাভাবিক যৌনাচরণের পরিবর্তন। টেস্টোস্টেরনের
মাত্রা কমে গেলে পুরুষের যৌন চাহিদা হ্রাস পায়; এমনকি নপুংশতা দেখা দিতে
পারে।অনেকের অণ্ডকোষ দুটি আকারে-আকৃতিতে ছোট হয়ে যায় এবং যৌন দুর্বলতা দেখা
দেয়।
- ঘুমের পরিবর্তনঃ টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার ফলে অনেক পুরুষের
ঘুমের ধরণ বদলে যায়। আবার অনেকে নিদ্রাহীনতায় ভুগতে পারেন।
- শারীরিক পরিবর্তনঃ টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমার ফলে পুরুষের
শরীরে নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন- শরীরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়, পেশীর
পরিমাণ কমে যায় এবং ভারী শারীরিক কসরত করার ক্ষমতা কমে যায়। এ ছাড়া হাড়ের
ঘনত্ব কমে যায়। অনেক পুরুষের স্তন বৃদ্ধি ঘটে এবং তা ব্যথাযুক্ত হতে পারে। অনেকের
মাথার চুল পড়ে যায় এবং টাক দেখা যায় এবং কেউ কেউ হঠাৎ হঠাৎ শরীরে উত্তাপের
ঝলক সৃষ্টি হয় বলে অনুভব করে থাকেন।
- মানসিক পরিবর্তনঃ টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ কমার সঙ্গে
সঙ্গে পুরুষের কর্মস্পৃহা অনেক কমে যায়। কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে
ফেলার পাশাপাশি অনেকে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। যৌবনের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা,
মনের জোর, সব জয় করার এক উদগ্র বাসনা; টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ কমার ফলে তা
কোথায় যেন উবে যায়। অনেকে কোন কাজে একভাবে মনঃসংযোগ করতে পারেন না,
স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে; এমনকি অনেকে বিভিন্ন মাত্রার বিষণ্ণতায় ভুগতে
পারেন।
আমাদের ভুলে
গেলে চলবে না যে, বয়স বাড়ার ফলে এ সকল শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই
ঘটতে পারে। তবে অনেক সময় অন্যান্য শারীরিক অসুখ-বিসুখ যেমনঃ থাইরয়েড গ্রন্থির
সমস্যা, বিষণ্ণতা রোগ, অতিরিক্ত মদ্যপান ইত্যাদি কিংবা ওষুধ সেবনের
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসাবেও এ রকম হতে পারে। সুতরাং একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে
পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত।
মহিলাদের
রজঃনিবৃত্তি কোন রোগ নয়; এটা জীবনের একটি স্বাভাবিক অমোঘ পরিবর্তন। একদিন কিশোরী
যেমন রজঃস্রাব শুরুর মাধ্যমে নারীতে পরিণত হন, তেমনি রজঃনিবৃত্তির মাধ্যমে তিনি
জীবনে প্রৌঢ়ত্বের অন্য এক স্তরে উপনীত হন। নারী জীবনে রজঃস্রাব শুরু হওয়া যেমন
কোন অসুখ নয়, রজঃস্রাবের নিবৃত্তিও তেমন কোন ব্যাধি নয়। একই ধারাবাহিকতায় পুরুষের
পরিণত বয়সে টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার ফলে পুরুষত্বের ইতি বা অ্যান্ড্রোপজও কোন অসুখ
নয়। এটি জীবনের একটি পরিবর্তিত ধাপ বা পর্যায় মাত্র। এটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে জীবনের এই নতুন পর্যায়টিকে
উপভোগ করা এবং আনন্দমুখর করে তোলা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে এ পরিবর্তন
সম্পর্কে কোন সংশয় থাকলে কিংবা টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়া নিয়ে কোন সন্দেহ থাকলে,
অবশ্যই চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হতে হবে। শেষ বয়সে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুনরায়
টেস্টোস্টেরন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে কতগুলি বিষয় খেয়াল রাখা উপকারীঃ
·
চিকিৎসকের
সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলা উত্তম। সমস্যাগুলি যদি বয়স বাড়ার কারণে না হয়ে অন্য
কোন অসুখ-বিসুখ কিংবা ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়, তাহলে তার সমাধান করা
যেতে পারে।
·
জীবনাচরণ
সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যেমন- স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত
ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করা ইত্যাদি। সুস্থ জীবনাচরণ শারীরিক শক্তি ও মানসিক উদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
·
বিষণ্ণতার
জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আগেই বলা হয়েছে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে
গেলে পুরুষের কর্মস্পৃহা, মানসিক উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক হ্রাস পায়। এছাড়া বিষণ্ণতার
কারণে অনেকের মেজাজ খিট খিটে হয়ে যায়, নিঃসঙ্গ থাকতে পছন্দ করেন এবং সামাজিক কর্ম
থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা, অতিরিক্ত নেশা
করা কিংবা বিপজ্জনক কাজকর্ম করাও বিষণ্ণতার কারণে হতে পারে।
·
বনজ
ওষুধ সেবনের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এটা খুবই পরিস্কার যে বয়স বাড়ার ফলে
টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে গেলে তা গাছগাছড়ার কিংবা পাতার রস খেয়ে বাড়ানো যায় না।
অনেকক্ষেত্রেই এসকল বনজ ওষুধের কার্যকারীতার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং এগুলি
সেবন করে যকৃত কিংবা কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
·
অনেকে
ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন প্রতিস্থাপন
চিকিৎসায় অনেকে উপকৃত হয়ে থাকেন। তবে এর কার্যকারীতা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অতএব
একজন উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এরকম ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।
No comments:
Post a Comment