সেই আদিকাল
থেকে লবণের কত গুণগান। কথায় বলে,নুন খাই যার গুণ গাই তার। রোমান সৈনিকদের বেতন
দেওয়া হতো লবণ কেনার জন্য। এজন্য বেতন বলতে ইংরেজিতে ‘SALARY’
শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব লবণের মূল্য অসাধারণ।
লবণ ছাড়া খাবার সুস্বাদু হয় না সত্য; কিন্তু কতটুকু লবণ খাওয়া উচিৎ এ নিয়ে অনেক
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। কারণ অতিরিক্ত লবণ খেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি খাবারে লবণ এবং পটাসিয়ামের নতুন নির্দেশনা প্রকাশ
করেছে। একজন মানুষের দিনে ৫ গ্রাম অর্থাৎ প্রায় ১ চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিৎ। আর
দৈনিক পটাসিয়াম বরাদ্দ ৩.৫ গ্রাম । ১০টি কলাতে এই পরিমান পটাসিয়াম পাওয়া যায়।
অবশ্য আরও অনেক ফলেও প্রচুর পটাসিয়াম থাকে।
খাবারে অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। লবণ বেশী খেলে রক্তরসের পরিমাণ
বেড়ে যায় যার ফলে রক্তচাপও বেড়ে যায় বলে মনে করা হয়। এজন্য খাবারে লবণের পরিমাণ
সীমিত রাখা দরকার। কিন্তু আসলে খাবারে কতটুকু লবণ থাকা দরকার তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের
মধ্যে মতভেদ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেখানে একটি প্রমাণ ভিত্তিক মতৈক্য
স্থাপন করলো।
রূপকথার গল্পে রাজা তার তিন কন্যাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাকে কে কেমন
ভালবাসে? ছোট রাজকন্যা তাকে লবণের মতো ভালবাসে শুনে রাজা খুব রেগে গিয়েছিলেন। তিনি
রেগে গেলেও পরবর্তীতে ছোট রাজকন্যা অবশ্য প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে লবণের মতো
ভালবাসাই সবচেয়ে উত্তম। আমরা অবশ্য জানিনা গল্পের রাজার উচ্চরক্তচাপ ছিল কিনা? তবে
এখন এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় বর্তমান সময়ের কন্যাগণ তাদের পিতৃদেবকে আর যাহোক
ভালবাসায় পাতে লবণ আধিক্যের মাধ্যমে রক্তচাপ বাড়ার সুযোগ দেবে না। বরং উচ্চরক্তচাপ
আক্রান্ত পিতাদের খেতে বসে একটু বাড়তি পাতের লবণের জন্য জায়া-কন্যাদের
শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে খেতে হবে।
খাবারের
লবণের বৈজ্ঞানিক নাম সোডিয়াম ক্লোরাইড। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দৈনিক আড়াই গ্রামের
বেশী সোডিয়াম গ্রহন করি। এ পরিমাণ সোডিয়াম
৬ গ্রাম বা ১ চা চামচ খাবার লবণের সমতুল্য। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
সুপারিশে এখন পরিস্কার জানানো হয়েছে একজন
মানুষের দিনে ৫ গ্রাম অর্থাৎ প্রায় ১ চা চামচের কম লবণ খাওয়া উচিৎ। এটা
ভাত-তরকারি এবং পাতের লবণসহ হিসেব করা
হয়েছে। অনেকে মনে করেন পাতে লবণ না খেয়ে তরকারিতে বেশী পরিমাণে লবণ ব্যবহার করলে
কোন ভয় নাই। আবার কেউ কেউ বলেন পাতে কাঁচা লবণ না খেয়ে তরকারিতে ভাজা লবণ খেলে
ভালো। কিন্তু এ সকল কথা সত্য নয়। লবণ যে ভাবেই ব্যবহার করা হোক না কেন একজন সুস্থ
মানুষের সার্বিকভাবে এক চা চামচের বেশী লবণ খাওয়া উচিৎ নয়।
আজকাল
আধুনিক সুপার মল কিংবা চেইন শপগুলিতে
হিমায়িত খাবার কিংবা কৌটাজাত ফলমূল এবং শব্জি বিক্রি হয়। মাছ-মাংস, রান্না করা
ভাত, রুটি, পাস্তা, নান রুটি ইত্যাদি হরেক রকম খাবার এভাবে সংরক্ষিত অবস্থায়
ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়। যারা হোস্টেল, মেস কিংবা ডরমিটরিতে বাস করেন অথবা
কর্মব্যস্ততার কারণে রান্না করার সময় পান না তাদের নিকট এ সকল রেডিমেড খাবার
অত্যন্ত জনপ্রিয়। গৃহবধূর হাতে রান্না করা সুস্বাদু গরম তরকারি আর ভাত যাদের
নিয়তিতে নাই তাদের জন্য মোড়ক জাত নানাবিধ প্রস্তুত খাবার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর
মতোই। কম লবণযুক্ত ঘোল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
কিন্তু মোড়কজাত সংরক্ষিত খাবারের ব্যপারে সাবধান।
প্রাকৃতিক ভাবেই বিভিন্ন খাবারে লবণ
থাকে। যেমন- দুধে প্রতি ১০০ গ্রামে ৫০ মিঃ গ্রাম এবং ১০০ গ্রাম ডিমে ৮০ মিঃগ্রাম
লবণ থাকে। খাবার সংরক্ষণের জন্য নানাবিধ রাসায়নিক উপাদানের কথা
বাদ দিলেও, এসকল খাবারে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এজন্য মোড়ক জাত খাবার কেনার আগে মোড়কের গায়ে
উল্লিখিত লবণের পরিমাণ দেখে নেওয়া উচিৎ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আধ কাপ পরিমাণ
হিমায়িত মটরশুঁটিতে ১২৫ মিঃ গ্রাম লবণ থাকে। সমপরিমান কৌটাজাত মটরশুঁটিতে ৩৮০ মিঃ
গ্রাম লবণ থাকে। অর্থাৎ কৌটাজাত মটরশুঁটিতে সাধারণ হিমায়িত মটরশুঁটির চেয়ে তিনগুণ বেশী লবণ থাকে। অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত
খাবার যেমন- পাউরুটিতে ২৫০ গ্রামে ১০০ মিঃ গ্রাম আর বেকনে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৫০০
মিঃগ্রাম লবণ থাকে। পপ কর্ণে ১০০ গ্রামে
১৫০০মিঃগ্রাম, সয়া সসে ১০০ গ্রামে ৭০০০ মিঃগ্রাম লবণ থাকে। এভাবে সব সংরক্ষিত
খাবারের প্যাকেটে লবণের পরিমাণ দেখে নিলে বোঝা যায় আমরা কি পরিমাণ লবণ গ্রহণ
করছি।
লবণ ছাড়া
যাদের নিকট খাবার বিস্বাদ মনে হয় তারা বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মশলা যেমন-
আদা, মরিচ, রসুন, লবঙ্গ, গোল মরিচ, ব্যাসিল, পার্স লি , পেস্তা ইত্যাদি ব্যবহার
করতে পারেন।
পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যের মধ্যে রয়েছে-
শিম এবং মটরশুঁটি ( প্রতি ১০০ গ্রামে ১৩০০ মিঃগ্রাম), বাদাম ( প্রতি ১০০ গ্রামে
৬০০ মিঃগ্রাম), সব্জি যেমন- পালং , বাঁধাকপি, পার্সলি(১০০গ্রামে ৬০০ মিঃগ্রাম)
এবং বিভিন্ন ফল যেমন-কলা, পেঁপে, খেজুর (১০০ গ্রামে ৩০০ মিঃগ্রাম)।
আমাদের বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে লবণ
বেশী খাওয়া আর পটাসিয়াম কম খাওয়া। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন এটা উচ্চ রক্তচাপ
সৃষ্টির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ থাকা মানেই হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত
হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া । আর হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত এখন পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু
এবং শারীরিক অক্ষমতার প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান নির্দেশনায় ২
বছরের ওপরের শিশুদের জন্যও করনীয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
। কারণ আজকের যে শিশুটির রক্তচাপ বেশী, বড় হলেও তার উচ্চ রক্তচাপ থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা
বিভিন্ন দেশের জন স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কারণ বিভিন্ন অ-সংক্রামক
ব্যাধি যেমন হৃদরোগ, পক্ষাঘাত, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, ক্রনিক হাঁপানি ইত্যাদি
নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিক নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
থাকে। এই নির্দেশনার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং পক্ষাঘাত প্রতিরোধ করার জন্য
জনগণ কে কম লবণ খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সুবিধা হবে। এ ছাড়া খাদ্য প্রস্তুতকারক
প্রতিষ্ঠান সমূহকে লবণের ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে সজাগ করা সম্ভব হবে।
No comments:
Post a Comment