থ্যালাসেমিয়া (Thalassaemia) একটি বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উপাদানে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া বেটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।
সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় নয় লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে এর সংখ্যা হচ্ছে আনুমানিক ১০ হাজার। এসব শিশুর অধিকাংশই বেঁচে থাকে রক্ত পরিসঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে। রক্ত না নিয়ে যেমন এরা বেঁচে থাকতে পারে না, তেমনি বারবার রক্ত নেওয়ার ফলে শরীরের বিভিন্ন কোষে আয়রন জমা হয়েও এরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
এ রোগের কিন্তু চিকিৎসা সম্ভব। এর চেয়েও বড় কথা, এ রোগের প্রতিরোধও সম্ভব। বিশ্বের কয়েকটি দেশ, যেখানে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ বাংলাদেশ থেকে মোটেও কম ছিল না, সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচির মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয় শূন্য, নতুবা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে তারা। উদাহরণস্বরূপ সাইপ্রাসের কথা ধরা যাক। ১৯৭০ সালে সেখানে প্রতি ১৫৮ জন শিশুর মধ্যে একটি শিশু জন্ম নিত থ্যালাসেমিয়া নিয়ে, আজ সেখানে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেওয়ার সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। গ্রিস, ইতালিসহ অনেক দেশই থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছে।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনার আগে রোগটা কী এবং কীভাবে বিস্তার লাভ করে, এ নিয়ে কিছু ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। লোহিত কণিকা অস্থিমজ্জায় অনবরত তৈরি হচ্ছে এবং তিন মাস শেষ হলেই প্লীহা এ লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে হৃদপিণ্ড, প্যানক্রিয়াস, যকৃত, অণ্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়।
এ রোগ বংশানুক্রমিক, মানে রোগটা আসে মা ও বাবার জিন থেকে। মা ও বাবা উভয়কেই থ্যালাসেমিয়া বাহক হতে হবে, শুধু একজন বাহক হলে হবে না। বাহককে বলা হয় থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইট। যদিও নাম হচ্ছে থ্যালাসেমিয়া মাইনর, আসলে এটা সত্যিকার অর্থে কোনো অসুস্থতাই নয়। টেনিসের কিংবদন্তি পিট সাম্প্রাস, ফুটবলের জাদুকর জিনেদিন জিদান আর চলচ্চিত্রের মহানায়ক অমিতাভ বচ্চন—তাঁরা সবাই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। কিন্তু যেহেতু তাঁদের সহধর্মিণীদের কেউই বাহক (থ্যালাসেমিয়া মাইনর)
নন, তাঁদের সন্তানেরা সবাই সম্পূর্ণ সুস্থ, থ্যালাসেমিয়া মুক্ত।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, থ্যালাসেমিয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন বা অস্থিমজ্জা সংযোজনের মাধ্যমে এ রোগকে নিরাময় করা হচ্ছে এবং রোগী ব্লাড ট্রান্সফিউশন (পরিসঞ্চালন) নির্ভরশীল থাকছে না।
চিকিৎসার অপর পদ্ধতি হচ্ছে প্রতি তিন অথবা চার সপ্তাহ পর নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন চালিয়ে যাওয়া এবং প্রতিদিন আয়রন নিষ্কাশনের ওষুধ ব্যবহার করা। চিকিৎসার উপরিউক্ত উভয় পদ্ধতিই হচ্ছে ব্যয়বহুল এবং যথেষ্ট ঝামেলাপূর্ণ। বিশেষ করে, সব সময় পরিশুদ্ধ রক্ত সংগ্রহ করা অধিকাংশ রোগীর পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এসব বিবেচনায় থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার তুলনায় এর প্রতিরোধই হওয়া উচিত আমাদের মূল লক্ষ্য।
থ্যালাসেমিয়ার মহামারি হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রথম প্রয়োজন থ্যালাসেমিয়া বহনকারী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ। দুজন বাহক যদি একে অন্যকে বিয়ে না করে, তাহলে কোনো শিশুরই থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়। যদি কোনো কারণে দুজন বাহকের বিয়ে হয়েও যায়, তাহলে সন্তান গর্ভধারণের অনতিবিলম্বে গর্ভস্থিত সন্তানের পরীক্ষা করা সম্ভব এবং পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় যে ভ্রূণটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, তাহলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী। থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক শনাক্তকরণের জন্য যে রক্ত পরীক্ষা সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য, তাকে বলা হয় হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস। এ পরীক্ষার সুযোগ সব ল্যাবরেটরিতে নেই, তবে এর বিকল্প কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই ধারণা করা সম্ভব কারও থ্যালাসেমিয়া মাইনর হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না।
বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধ, উভয় দিকের চিত্রই অত্যন্ত করুণ। থ্যালাসেমিয়া রোগের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাপদ্ধতি বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন অথবা নিয়মিত পরিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালন, কোনোটাই এখানে সহজলভ্য নয়। রোগটি প্রতিরোধের কোনো সুষ্ঠু কার্যক্রমও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ প্রতিবেশী প্রতিটি দেশই এ ব্যাপারে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর এ চেষ্টার সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সহযোগিতা করছে।
আমরা যদি আমাদের দেশ থেকে থ্যালাসেমিয়া উচ্ছেদে দৃঢ়সংকল্প হই, তাহলে যে কাজগুলো আমাদের হাতে নিতে হবে, তা হচ্ছে-
- · থ্যালাসেমিয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি।
- · থ্যালাসেমিয়া বাহক শনাক্তকরণের পদ্ধতি সহজলভ্য করা।
- · স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক থ্যালাসেমিয়াকে একটা প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিতকরণ।
- · বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক এনজিওগুলোকে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধকরণ।
- · চিকিত্সক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে এ অসুস্থতার ব্যাপারে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- · সর্বোপরি থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়নে জাতীয় পর্যায়ে কনসালটেটিভ বৈঠকের আয়োজন করা এবং জাতীয় থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি প্রণয়ন করা।
সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সভা-সমিতি আয়োজনের পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি স্বল্পব্যয়ে থ্যালাসেমিয়া রক্ত পরীক্ষা দেশের বিভিন্ন মেডিকেল ল্যাবরেটরিতে করানোর সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার ও এনজিওগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলামে থ্যালাসেমিয়াকে এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে প্রত্যেক চিকিত্সকই থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই এ ব্যাপারে নেতৃত্ব বা দিকনির্দেশনা দিতে হবে। সমাজের সুশীল সমাজ যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে উপরিউক্ত কাজগুলো সম্পন্ন হবে না।
No comments:
Post a Comment