‘ক্যান্সার’
শব্দটি শুনলে কার না ভয় হয়? কারণ ক্যান্সার ঘাতক ব্যাধি। একবার হলে আর রক্ষা নাই। আগে আমাদের
দেশে কলেরা, বসন্ত, পোলিও, হাম, হুপিং কাশি, যক্ষ্মা ইত্যাদি সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ
খুব বেশি ছিল। এখন আমরা এসব সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ অনেকাংশে কমাতে পেরেছি। গুটি বসন্তকে
তো পৃথিবী থেকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে; পোলিও রোগও
বিদায়ের পথে। নানা রকম টীকা আবিষ্কারের ফলে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির হারও কমেছে।
কিন্তু বেড়ে গেছে অসংক্রামক ব্যাধির পরিমাণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ আর ক্যান্সার এমনভাবে বিস্তার লাভ
করেছে যে তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। এসব অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে ক্যান্সার
একটি প্রধান স্থান দখল করে আছে। কিন্তু এ সম্পর্কে আমরা এখনো তেমন সচেতন নই। আরো সচেতন
থাকলেও প্রতিরোধের তেমন কোনো উদ্যোগ বা জোগাড়-যন্তর নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে
২০০৭ সালে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল ক্যান্সার। প্রথম স্থান দখল করে ছিল হৃদরোগ।
ওই সময় ক্যান্সারে মৃত্যুর হার ২৩% ছিল। অর্থাৎ প্রায় প্রতি চারটি মৃত্যুর একটি ঘটেছে
ক্যান্সারের জন্য। ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান
কারণ ক্যান্সার। হৃদরোগ এবং সংক্রামক ব্যাধির কারণে মৃত্যু যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয়
স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশে ক্যান্সারের জন্য প্রায় ১১% লোক মারা যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে
প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে অন্তত ১টি ঘটে ক্যান্সারের জন্য। হিসাবটিকে কোনোভাবেই অবহেলা
করা যায় না।
দেশে দেশে ক্যান্সারের
রকমফের দেখা যায়। আবার নারী-পুরুষভেদে ক্যান্সারের প্রকোপ বিভিন্ন হয়ে থাকে। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে যেসব ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়, তা হলো পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুস, প্রোস্টেট
এবং অন্ত্রের ক্যান্সার; আর মেয়েদের ক্ষেত্রে
ফুসফুস, স্তন এবং অন্ত্রের ক্যান্সার। ক্যান্সারের
কারণে যত মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় এগুলোর জন্য।
বাংলাদেশে ক্যান্সারের
কারণে তালিকায় পুরুষদের ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে ফুসফুস, খাদ্যনালি, ঠোঁট, গলা ও পাকস্থলীর ক্যান্সার; আর মহিলাদের ক্ষেত্রে
জরায়ুমুখ, স্তন, ফুসফুস এবং খাদ্যনালির ক্যান্সার। খাদ্যাভাস, বিড়ি-সিগারেট, পান, তামাক, জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি ব্যবহারের কারণে আমাদের দেশে
ঠোঁট, গলা ও খাদ্যনালির ক্যান্সার বেশি হওয়ার সম্পর্ক
রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পাকস্থলীর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এসব উপাদানের পাশাপাশি হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামে পরিচিত এক রকম ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
ক্যান্সারের
প্রকোপ বিগত বছরগুলোতে বাড়লেও এ সম্পর্কে সচেতনতা তেমন বাড়েনি। কিন্তু সচেতনতা বাড়ানোর
মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে অনেক অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করার আজকাল অনেক পদ্ধতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করা হয়, ক্যান্সার স্ক্রিনিং করার জন্যও তেমন পরীক্ষা রয়েছে। অবশ্য এ ধরনের পরীক্ষার খরচ
কম হতে হবে, সহজে সম্পন্ন করতে পারতে হবে এবং স্বল্প সময়ে
অনেক লোকের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত করার জন্য গ্রামে-গঞ্জে
বিভিন্ন স্বাস্থ্য ক্যাম্পে শত শত মানুষের প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে মূত্রে
চিনি নির্গত হচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়।
আজকাল ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ক্যান্সার স্ক্রিনিং। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে
ক্যান্সার শনাক্ত করা হলে রোগীর মৃত্যু রোধ করা যায় এবং চিকিৎসার ব্যয় সাশ্রয় করতে
সাহায্য করে। ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য যেসব স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয় তাদের কতগুলো
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছেঃ
- এ পরীক্ষার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্যান্সার সুপ্তাবস্থায় কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয়।
- পরীক্ষাটি উপযুক্ত এবং রোগীর কাছে গ্রহণযোগ্য।
- শনাক্ত করার পর ক্যান্সারটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- শনাক্তকরণ পরীক্ষাটির খরচ কম হতে হবে।
ওপরের সব শর্ত
পূরণ করে সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা সব দেশে চালানো সম্ভব হয় না।
কারণ ক্যান্সারের প্রকোপ সব দেশে এক রকম নয়। আর শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার ব্যয় সঙ্কুলান
করাও সব দেশের পক্ষে সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি
ক্যান্সার শনাক্তকরণ পরীক্ষার সুপারিশমালা দেয়। অন্যান্য মেডিকেল সোসাইটি এবং সরকারি
সংস্থাগুলোরও সেখানে ভূমিকা রয়েছে। প্রতি বছর বসন্তকালে এ সম্পর্কিত একটি বিবরণী প্রকাশ
করা হয় এবং বিভিন্ন সময় সুপারিশ নবায়ন কিংবা সংশোধন করা হয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে
স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ সক্রিয়। সাধারণত যে কোনো
মহিলার বয়স ৪০ বছর অতিক্রম করলে প্রতি বছর তাকে ম্যামোগ্রাম করার সুপারিশ করা হয়। ম্যামোগ্রাম
স্তনের এক ধরনের এক্সরে যার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। যেসব
মহিলার বয়স ২০ বছর অতিক্রম করেছে তাদের অন্তত প্রতি ৩ বছরে একবার স্তন ক্লিনিক্যাল
পরীক্ষা করানো উচিত। ৪০ বছর বয়সের পর প্রতি বছরই এটা করতে হয়। আগে ২০ বছর বয়সের বেশী হলে মহিলাদেরও স্তন নিজে হাত দিয়ে পর্যবেক্ষণ
করার সুপারিশ করা হতো। ম্যামোগ্রাম আসার পর এটার ওপর আর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কিন্তু
প্রতি মাসে একবার স্তন নিজ হাতে পরখ করে দেখাটাই সবচেয়ে এবং সুলভ স্ক্রিনিং পরীক্ষা।
এটা করলে অনেক স্তন ক্যান্সার একেবারে অঙ্কুরেই শনাক্ত করা যায়। বাংলাদেশে মহিলাদের
স্তন ক্যান্সার মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়ানোর পরও দেখা যায় তারা নির্বিকার
থাকেন এবং যখন এটা শনাক্ত করা হয়, তখন আর তেমন কিছুই
করার সুযোগ থাকে না। কারো স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তাদের শনাক্তকরণ পরীক্ষার ব্যাপারে
আরো নিবিড় যত্নশীল হতে হবে। বর্তমানে অনেকে ৫০ বছর বয়স হওয়ার পরে ম্যামোগ্রাম করার
সুপারিশ করছেন। কারণ ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে তেমন বেশি স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে
না। কিন্তু আমেরিকার বীমা কোম্পানিগুলো এখনো ৪০ বছর বয়সের সীমারেখাই মেনে চলছে।
অন্ত্রের ক্যান্সার
শনাক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে মলে রক্ত আছে কি না তা পরীক্ষা করা যায়। মলে রক্ত পরীক্ষা
পজিটিভ হলে কলোনোস্কপি করানোর প্রয়োজন হয়। এছাড়া ডাবল কনট্রাস্ট বেরিয়াম ইনিমা এবং
বিশেষ ধরনের সিটিস্ক্যান করা যায়।
আজকাল অন্ত্রের
ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য মলে ক্যান্সারের ডিএনএ টেস্ট করাকে বেশি উপযুক্ত মনে করা
হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের পরীক্ষা বেশ ব্যয়বহুল এবং এখনো সর্বত্র পাওয়া যায় না। অন্ত্রের
ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সবসময় সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অন্ত্রের ক্যান্সার
সম্পর্কে চিকিৎসকের সন্দেহ এবং পরীক্ষা করানোর রোগীর আগ্রহ উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে
চিকিৎসক এবং রোগীর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
জরায়ুমুখের
ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য প্যাপটেস্ট এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়। আমেরিকান ক্যান্সার
সোসাইটি যে কোনো মহিলার যৌনমিলন শুরুর তিন বছরের মাথায় প্যাপটেস্ট এবং ডিএনএ টেস্ট
করানোর সুপারিশ করে থাকে। অন্যান্য সংস্থা বয়স ২১ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর কিংবা প্রতি
তিন বছরে ১ বার শনাক্তকারী পরীক্ষা করানোর সুপারিশ করে থাকে। জরায়ু গ্রীবায় অ্যাসিটিক
অ্যাসিড কিংবা লুগলস্ আয়োডিন লাগিয়ে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা আরেকটি সহজ শনাক্তকারী পরীক্ষা।
এটা ‘ভায়া টেস্ট’ নামে পরিচিত। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে এর তেমন প্রচলন নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এটি বহুল ব্যয়হৃত এবং সুলভ পরীক্ষা।
জরায়ু গ্রীবা
কিংবা যোনিরসে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ডিএনএ পরীক্ষা করানো খুবই সহজ প্রক্রিয়া
কিন্তু ব্যয়বহুল। এর নমুনা সংগ্রহের জন্য কোনো চিকিৎসকেরও প্রয়োজন হয় না। রোগী নিজেও
এটা করাতে পারেন। আজকাল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে টীকা ও পাওয়া যায়। এ
টীকা ব্যবহারের ফলে জরায়ু গ্রীবার ক্যান্সারের প্রকোপ অনেক কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অবশ্য এ টীকা সর্বত্র পাওয়া যায় না এবং যথেষ্ট ব্যয়বহুল।
অন্যান্য ক্যান্সারের
মধ্যে প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং করা সম্ভব। পুরুষের মূত্রথলির গ্রীবায় প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড অবস্থিত।
সাধারণত পুরুষদের বয়স ৫০ বছর অতিক্রম করলে প্রাথমিক শনাক্তকরণ পরীক্ষা করার সুপারিশ করা হয়। তবে প্রোস্টেটের
ক্যান্সার পরীক্ষার সুপারিশ নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশে পুরুষদের
ক্যান্সারের মৃত্যুর কারণের শীর্ষে রয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য বুকের
এক্স-রে, সিটিস্ক্যান এবং থুথু পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু
ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মধ্যে স্ক্রিনিং করার জন্য পরীক্ষাগুলো উপযুক্ত নয়। এজন্য অধিকাংশ
ফুসফুসের ক্যান্সার খুব বিলম্বে শনাক্ত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূলে
হাতিয়ার ধূমপান পরিহার করা।
ফুসফুসের সবচেয়ে
শত্রু তামাক। একমাত্র ধূমপানবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সারের
প্রকোপ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশে খাদ্যনালি, মুখগহ্বর এবং
পাকস্থলীর ক্যান্সারের প্রকোপও খুব বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এসব ক্যান্সারের
জন্যও কোনো সহজ এবং সুলভ প্রাথমিক শনাক্তকারী পরীক্ষা নেই। ঠোঁট এবং মুখগহ্বরের ক্যান্সারের
সঙ্গে তামাকের সম্পর্ক রয়েছে। অতএব এখানেও আমাদের তামাক সেবন প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ক্যান্সার ঘাতক
ব্যাধি। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে অনেক অকাল মৃত্যু রোধ করা
সম্ভব। এজন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার করার ওপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের পক্ষে ক্যান্সারের চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার বহন করা সহজ
নয়। অতএব ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্পর্কে ব্যাপক
সচেতনতা সৃষ্টি করায় আমাদের ক্যান্সার বিজয়ের কৌশল।
No comments:
Post a Comment