শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Sunday, 10 February 2013

পুরুষদের কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যা



আজকাল স্বাস্থ্য সেবার একটি বড় অংশ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে । সহস্রাব্দ লক্ষ্যের প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে মায়েদের স্বাস্থ্য এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন। এতসব প্রচেষ্টা এবং প্রচার-প্রচারণার ভীড়ে বাবাদের স্বাস্থ্য বা পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি আমরা অবহেলা করছি কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে । কারণ মহিলা ও শিশুদের বিষয়ে সকলে যতটা সহানুভূতি এবং আগ্রহ সহকারে স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করেন , বাড়ীর কর্তাটির কথা সেখানে আজকাল অনেক সময় কারও মনে থাকে না। আর নারীদের অধিকার আন্দোলনের প্রবল স্রোতের তোড়ে বেচারা পুরুষরা তাদের স্বাস্থ্যের কথা ভুলতে বসেছে কিনা সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা কি? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Center for disease control and prevention)  পুরুষদের স্বাস্থ্য  সমস্যার একটি তালিকা করেছে। পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাটি কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ছোট। সেখানে পুরুষদের শত্রু হিসাবে প্রধান সাতটি রোগ-ব্যাধিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সাত রকমের রোগ-ব্যাধির প্রতি নজর দিলে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করলে পুরুষ প্রজাতির সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যায়।
১। হৃদরোগ
পুরুষের প্রধান শত্রু হৃদরোগ। অতএব সকল পুরুষকে হৃদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এজন্য-
  • ধূমপান পরিহার করতে হবে। হৃদপিণ্ডের অন্যতম প্রধান শত্রু ধূমপান। অতএব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সব ধরণের ধূমপান পরিত্যাগ করতে হবে।
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ। শাক-সবজী, ফলমূল, আকাঁড়া শস্য দানা, অতিরিক্ত আঁশযুক্ত খাদ্য ইত্যাদি বেশী বেশী খেতে হবে। কিন্তু সম্পৃক্ত চর্বি এবং লবণযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
  • ক্রনিক রোগ পরিহার করতে হবে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস হলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে । নিয়মিত যে কোন ধরণের শরীরচর্চা কিংবা খেলাধুলা করতে হবে।
  • শরীরের ওজন সীমিত রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন মানেই হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত বোঝা।
  • মদ্যপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল রক্ত চাপ বাড়িয়ে দেয় এবং তা হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।
  • মানসিক চাপ এবং উদ্বেগমুক্ত হতে হবে। সবসময় দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কাজেই মানসিক চাপ মুক্ত হাসিখুশি প্রাণবন্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে।

২।ক্যান্সার
হৃদরোগের পরে পুরুষের দ্বিতীয় প্রধান শত্রু ক্যান্সার। ফুসফুস, প্রোস্টেট, অন্ত্র, ত্বক ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সার বহু পুরুষের অকাল মৃত্যুর কারণ। ক্যান্সার ঝুঁকি কমানোর জন্য নীচের পদক্ষেপগুলি বেশ কার্যকরী ।
·         ধূমপান পরিহার করতে হবে। ধূমপান পরিহার করলে যেমন হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে, তেমন ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে। এমন কি পরোক্ষ ধূমপান থেকে দূরে থাকলেও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
·         ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারলে নানা ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
·         ব্যায়াম করতে হবে। নিয়মিত শরীর চর্চা ওজন কমাতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং একই ভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমায়।
·         প্রচুর শাক-সবজী এবং ফলমূল খেতে হবে। শাক-সবজী এবং ফলমূল ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী।
·         সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। অতিরিক্ত সৌরালোক ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। সূর্যের আলোতে অতিরিক্ত ঘোরাঘুরি করলে অবশ্যই সানস্ক্রিন (Sunscreen) বা সূর্যালোক সুরক্ষাকারী ক্রিম ব্যাবহার করতে হবে কিংবা ছাতা ব্যবহার করা উচিত।
·         মদ্যপান সীমিত করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে অন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি, যকৃত ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অতএব মদ্যপান পরিহার করলে এটা প্রতিরোধ করা যায়।
·         ক্যান্সার শনাক্তকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা । কিছু-কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সুপ্তাবস্থায় বা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে তার চিকিৎসা করা যায়।  এজন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।  
৩। দুর্ঘটনা
মোটর যানবাহন দুর্ঘটনা পুরুষদের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। পথঘাটে চলাফেরার সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। যানবাহন ব্যবহারের সময়  মাথায় হেলমেট পরা এবং সিট বেল্ট বাঁধা গুরুত্বপূর্ণ। মদ্য পান কিংবা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যানবাহন চালনা কর উচিত নয়।
৪। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী অবরোধাত্মক ব্যাধি
ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগে অনেক পুরুষের স্বাস্থ্যহানি হয়ে থাকে।  বিশেষত ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস এবং পালমোনারি এমফিসিমায় অনেক পুরুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে থাকে। এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিতঃ
·         ধূমপান পরিহার করতে হবে। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগের প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপান পরিহার করলে এর থেকে মুক্ত থাকা সহজ হয়।
·         বায়ূ দূষণ পরিহার করতে হবে। ধুলাবালি ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ এড়িয়ে চলতে  হবে।
·         শ্বাসনালীর সংক্রমন প্রতিরোধ করতে হবে। ঘন ঘন শ্বাসনালীর সংক্রমন ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। অতএব শ্বাসনালীর সংক্রমন থেকে মুক্ত থাকার জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
 ৫। মস্তিস্কের পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক
মস্তিস্কের পক্ষাঘাতের অনেক ঝুঁকি উপাদান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন- বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জাতি ইত্যাদি। কিন্তু কতগুলি উপাদান আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেমন-
  • ক্রনিক রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ইত্যাদি পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পক্ষাঘাত প্রতিরোধের জন্য জরুরী।
  • ধূমপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ধূমপান পক্ষাঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।  কিন্তু ধূমপান পরিহার করে পক্ষাঘাতের সংখ্যা কমানো সম্ভব।
  • মদ্যপান পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত মদ্যপানেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। সুতরাং মদপান পরিহার করলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।  
৬। ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস বিশেষত টাইপ-২ ডায়াবেটিস  থাকলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে হৃদরোগ, স্নায়ু রোগ, কিডনির সমস্যা, চোখের রেটিনার সমস্যা এবং আরও অনেক জটিলতা হয়।এজন্য ডায়াবেটিস  নিয়ন্ত্রণে রাখা সুস্থ থাকার জন্য জরুরী। এজন্য-
·         নিয়মিত জীবনাচরণ মেনে চলতে হবে
·         স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে
·         নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে
·         অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
৭। আত্মহত্যা
পুরুষের স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আত্মহত্যার প্রবণতা। সাধারণত বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। কারও বিষন্নতার লক্ষণ-উপসর্গ দেখা গেলে অবশ্যই তার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে বিষণ্ণতা দূর করার মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সবশেষে বলতে হয় স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা সহজ; কিন্তু প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সহজ নয়। তবে সবক্ষেত্রে পুরুষদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল সূত্রটি একই; আর তা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করা, ধূমপান পরিহার করা, মদ্যপান না করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো।এর সুফল আমরা যা মনে করি, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী।

No comments:

Post a Comment