শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday 11 February 2014

ক্লান্ত চিকিৎসক

মানুষকে সুস্থ করে তোলার ইচ্ছে এবং সাহায্য করার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তারা আসে। অর্থ বিত্তের পাশাপাশি একজন অসুস্থ অসহায় ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলার মধ্যে যে স্বর্গীয় আনন্দ আছে, তার মধুর তৃপ্তিই তার পেশার প্রতি তাকে আকৃষ্ট করে তোলে। অবশ্যই কাজটি সহজ নয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবিরাম গুরুতর অসুস্থ রোগীদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টার কমতি না থাকলেও আসলে অনেককেই সন্তুষ্ট করা যায় না। অনেকের সুস্থ হওয়ার ইচ্ছেও থাকে না।   
সময়ের পরিক্রমায় একটু একটু করে হতাশা জেঁকে বসতে শুরু করে। তৃপ্তির মাঝেও এক সময় উঁকি দিতে শুরু করে তিরিক্ষে মেজাজ। এটা ঠিক নয় - বোঝা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। বিশেষজ্ঞগণ এটাকে এখন বলছেন “ডাক্তারের ক্লান্তি” বা “সহানুভূতির ক্লান্তি” (compassion fatigue)এটা এক ধরণের মানসিক চাপজনিত সমস্যা। দীর্ঘদিন অসুস্থ মানুষকে সেবাদানের মধ্যে থাকলে সেবাদানকারীর ভিতরে এক গভীর শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক অবসাদ তৈরি হয়। তাকেই বলা হচ্ছে সহানুভূতির ক্লান্তি। এই শব্দ ১৯৯২ সালে প্রথম ব্যবহার করা হয়। জরুরী বিভাগে অনেকদিন কাজ করার ফলে একজন নার্স সহসা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়লে তাকে এই সমস্যায় আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসকসহ সেবাদানকারী অনেকের মধ্যেই এ সমস্যা শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে বলা হচ্ছে অতি ব্যস্ত চিকিৎসকদের মধ্যে এ ধরণের অবসাদ বা ক্লান্তির প্রকোপ সবচেয়ে বেশী।  
গতবছর ২৪,০০০ চিকিৎসকের জীবনাচরণের উপর একটি সমীক্ষা(2013 Physician Lifestyle Report) করা হয়েছে। এতে অনেক চিকিৎসকই তাদের জীবনের সমস্ত উৎসাহ-আনন্দ নিভে যাওয়ার পিছনে মূলত সহানুভূতির অবসাদকে দায়ী করেছেন। একজন চিকিৎসক লিখেছেন, “এত গুরুতর রোগীর বেদনাদায়ক ইতিহাস, এত চাপ আর এত লেখালেখি করে আমি আর তাদের জন্য সহানুভূতির জানালা খুলে রাখতে পারিনা”।
“রোগীই প্রথম, রোগীর জন্যই সবকিছু” – এ রকম মহৎ শিক্ষা শুনতে ভালো মনে হলেও, একসময় সেটাই হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। বলা হচ্ছে প্রতিটি মানুষেরই শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক সামর্থের একটি সীমা আছে। এ সামর্থের ওপর নির্ভর করে একজন চিকিৎসক কতক্ষণ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে তার রোগীকে সাহায্য করতে পারবেন। তার নিজের জীবনী  শক্তির ভাণ্ডার যদি শূন্য হয় তিনি রোগীর জন্য ইতিবাচক কিছু করতে পারেন না।
এই অবস্থা সহসা হয় না।
দিনের পর দিন বৈরি কর্ম পরিবেশে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থেকে কাজ করলে সাধারণত সহানুভূতির ক্লান্তি সৃষ্টি হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চিকিৎসকগণ নিজের শরীর নিয়ে তেমন ভাবেন না। বলা হয়, “একজন চিকিৎসক সবচেয়ে খারাপ রোগী।” কারণ তিনি নিজের যত্ন নেনও না, আবার অন্য চিকিৎসকের পরামর্শও মেনে চলতে চান না। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা শিক্ষা তাকে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে নিরাসক্তভাবে কাজ করার জন্যই উৎসাহিত করেছে। সেখানে একজন চিকিৎসক নিজের মনের আবেগ-দুঃখ নিয়ে চিন্তা করা লজ্জাজনক মনে করেন
তবে গ্রামের হাসিখুশি সহজ-সরল সদালাপী চিকিৎসককে নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তার পাশে আসলে যে অভয় এবং সাহস মেলে, তা অতুলনীয়; মনে হয় যেন তিনি সহানুভূতির এক মহা খনি। কিন্তু আধুনিক জটিল চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের সে অবস্থা অনেকটা পালটে দিয়েছে। এখন চিকিৎসকের নিকটে মানুষের চাওয়া অনেক বেশী; যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ রোগে-শোকে এখন মানবিক হৃদয়ের ছোঁয়া, সহানুভূতির সুধা চিকিৎসকের নিকটে আশা করে। সেখানে চিকিৎসকের নিজের মনের বাগানে যদি সুস্থতা না থাকে, তাহলে রোগীদের আশা পূরণ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সিনক্লেয়ার লিউইস ১৯২৫ সালে  Arrowsmith নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে চিকিৎসকদের মনোজগতের সংকটের একটি সুন্দর বর্ণনার সঙ্গে আজকের অবস্থার অনেক প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু আধুনিক মেডিসিন চিকিৎসকদের জন্য অনেক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। সংকট এসেছে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক সবক্ষেত্র থেকেই। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে মানুষের কল্পনার চিকিৎসক আর বাস্তব চিকিৎসকের মধ্যে ফারাক দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠছে।  সেখানে ব্যক্তি চিকিৎসক নিজেই অসহায়, কিন্তু সমাজ ভস্ম হয়ে যাওয়া চিকিৎসককে সাহায্যের ছায়া দিতে পারছে না, অনেক সময় সে প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতে পারছে না।
আজকের সমাজ চিকিৎসকের জবাবদিহিতার জন্য, দায়বদ্ধতার জন্য যতটা আগ্রহী এবং চিকিৎসকের প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, তা তাদেরকে আরও অধিকতর চাপের মুখে কাজ করতে বাধ্য করছে। পরিবর্তিত হাসপাতাল কাঠামো, রাজনীতি, পদে পদে ম্যালপ্রাকটিসের হুমকি আর হাজার রকমের পুনর্গঠন আজ একজন চিকিৎসককে ক্ষমতাবিহীন অসহায় জীবে পরিণত করেছে। সেখানে একজন আধুনিক চিকিৎসকের বুক ভরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়াটাও স্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একজন বলেছেন, “পরিস্থিতি এমনই শ্বাসরুদ্ধকর যে আপনি প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কিত থাকবেন না জানি এই কখন আপনার এত বছরের অর্জিত মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়”।
অসহায় অসুস্থ রোগীদের সেবা করার জন্য চিকিৎসকের যে মানসিক শান্তি, স্থিরতা এবং উদ্যম দরকার, নানারকম নিয়ম-কানুনের গ্যাঁড়াকলে আজ তা আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপালনে পর্যবসিত হয়েছে মাত্র। এরফলে অনেকেই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত, মনে হচ্ছে যেন তাদের সমস্ত উদ্যম-উৎসাহ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। গবেষকগণ বলছেন এ অবস্থার শিকার চিকিৎসকগণ বিশ্রামের জন্য যে সীমিত সময় পান, তা তাদেরকে পুনরায় কাজের জন্য যথেষ্ট উজ্জীবিত করছে না।   
এখন সকলেরই প্রশ্ন এ অবস্থার সমাধান কি?
এক কথায় এর কোন সহজ সমাধান নেই। অনেকে চিকিৎসকদের আচরণ পরিবর্তন কিংবা সহানুভুতি শিক্ষার কোর্সে অংশগ্রহণ করার উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু এটাতো এমন কোন বিষয় না যা কোর্সের মাধ্যমে শেখানো যাবেএটা চিকিৎসকের অস্তিত্বের অংশ। দুর্ভাগ্যবশত যখন সহানুভূতি রপ্ত করার জন্য নানাজন উপদেশ বিতরন করেন, তখন তা আরেকটি মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাতে আরও হিতে বিপরীত হয়।
এই নেতিবাচক দুষ্ট চক্র থেকে চিকিৎসকদের মুক্ত হওয়ার জন্য গবেষকগণ যা বলছেন তার সারমর্ম হোল চিকিৎসকদের নিজের প্রতি খেয়াল দিতে হবে। এজন্য তাদের পরামর্শঃ  
  • ·         কাজের ব্যস্ততা কমাতে হবে
  • ·         বিশ্রাম, বিনোদন এবং চিত্তাকর্ষক কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে
  • ·         স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং ব্যায়াম করতে হবে
  • ·         পরিবার এবং নিকট বন্ধুদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটাতে হবে
  • ·         আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য সময় দিতে হবে
  • ·         যোগ সাধনা, ধ্যান এবং মানসিক স্থিরতা অর্জনের জন্য সময় দিতে হবে। 

বলা হচ্ছে চিকিৎসক নিজেও একজন মানুষ। তারও সীমাবদ্ধতা আছে। এটা তাকে মেনে নিয়ে কাজ এবং বিশ্রামের মধ্যে একটি সমন্বয় আনতে হবে। প্রয়োজনে সহকর্মীদের সাহায্য এবং পরামর্শ নিতে হবে।
সবশেষে দালাই লামার কথা দিয়ে শেষ করি। তার ভাষায় “সহানুভূতি আমাদের সময়ের কাংখিত মৌলবাদ”। ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে ওঠা স্বাস্থ্যসেবা দান ব্যবস্থার ভিতরে অসহায় রোগীর জন্য সহানুভূতির ছিটেফোঁটা শান্তির পরশ ধরে রাখতে হলে আমাদের এখনই মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে চিকিৎসক নিজেও বলতে পারবেন, “ক্লান্তি মোরে ক্ষমা করো প্রভু”।





No comments:

Post a Comment