অবশেষে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ
এবং কোলেস্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে দারুচিনির উপকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। অনেকদিন ধরেই
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় দারুচিনি কাজে লাগবে। কিন্তু ২০১২
সাল পর্যন্ত এই দাবীর পক্ষে তেমন জোরালো প্রমাণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি একটি
নতুন সমীক্ষনে দেখা যাচ্ছে সত্যিকার অর্থেই ডায়াবেটিস রোগীদের গ্লুকোজ এবং
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে দারুচিনির উল্লেখ করার মতো ক্ষমতা রয়েছে। দেখা যাচ্ছে দৈনিক
১ থেকে ৬ গ্রাম দারুচিনি নিয়মিত সেবন করলে ৪ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস
রোগীদের রক্তে গ্লুকোজ এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় কমে যায়।
রান্নায় যেসব মসলা বহুল ব্যবহার করা হয় তার
মধ্যে দারুচিনি অন্যতম। দারুচিনি একটি মসলা বৃক্ষের নাম। এর ইংরেজি নাম Cinnamon এবং বৈজ্ঞানিক নাম Cinnamomus
zeylanicum। দারুচিনি গাছের আদি নিবাস
শ্রীলংকায়। আজকাল ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ ও চীন প্রভৃতি দেশেও উৎপাদিত হচ্ছে। দেখতে কিছুটা
তেজপাতা বৃক্ষের মতো এই বৃক্ষের বাকল মসলা হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। দারুচিনি থেকে সুগন্ধযুক্ত তেলও পাওয়া যায়।
দারুচিনির ইতিহাস
অনেক অনেক আগে থেকেই মানুষ দারুচিনির সঙ্গে
পরিচিত। খ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর আগেও মিসরে দারুচিনি আমদানী করা হতো। হিব্রু
বাইবেলে মশলার উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। সেখানে হযরত মুসা (আঃ)-কে মিষ্টি
দারুচিনি ব্যবহার করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন প্রবাদে প্রেমিক-প্রেমিকার শয্যা সুগন্ধিময় করার জন্য দারুচিনি
ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সোলেমান বাদশাহের গানে প্রিয়ার সৌন্দর্য বর্ণনার
পাশাপাশি তার পরিধেয় বস্ত্রে দারুচিনির সুবাস থাকার কথা বলা হয়েছে।
প্রাচীনকালে দারুচিনি এতই মূল্যবান সামগ্রী
ছিল যে রাজা-বাদশাহরা এটাকে উপহার হিসেবে প্রদান করতেন। অ্যাপোলোর
মন্দিরে উপহার হিসেবে দারুচিনি দেওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এর
উচ্চ মূল্য বজায় রাখার জন্য দারুচিনির সওদাগরেরা সে সময় রাজরাজড়াদের কাছে এর উৎপত্তি স্থানের কথা গোপন রাখতেন । আসলে দারুচিনি সবচেয়ে বেশী জন্মায় শ্রীলংকায়। তবে পরবর্তীতে ভারত, বাংলাদেশ, বার্মা, মালাবার উপকূলেও দারুচিনির চাষ শুরু হয়। এছাড়া চীনে
প্রচুর দারুচিনি উৎপন্ন হয়; তবে এটা একটু
ভিন্ন জাতের।
গ্রীক সাহিত্যে দারুচিনির প্রথম উল্লেখ দেখা
যায় সপ্তম শতকে। হেরাডোটাসের বর্ণনামতে দারুচিনি উৎপন্ন হতো আরব দেশে এবং অন্যান্য
মূল্যবান মশলাসহ দারুচিনির রক্ষায় নিয়োজিত থাকতো পাখাযুক্ত প্রকাণ্ড সর্পকূল।
গ্রীক রূপকথার অমর ফিনিক্স পাখী বাসা বানাতো দারুচিনি পাতা দিয়ে। গ্রীকরা মদের
সুগন্ধের জন্য আরও অনেক মশলাসহ দারুচিনি ব্যবহার করতো । রোমানদের নিকটও দারুচিনি
খুব মূল্যবান ছিল। এক পাউন্ড দারুচিনির দাম ছিল ৩০০ রোমান দীনার। এটা একজন রোমান
শ্রমিকের দশ মাসের পারিশ্রমিকের সমতুল্য।
তখন দারুচিনির দাম এত বেশী ছিল যে সমাজের
খুব ধনী ব্যক্তিরাই তাদের শবদাহ করার জন্য দারুচিনি ব্যবহার করতো। কথিত আছে ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট নীরো তার রানী
পপি সাবিনার মৃত্যুর পর যে পরিমাণ দারুচিনি জ্বালিয়েছিল তা রোমের সারা বছরের
সরবরাহের সমান ছিল। কায়রো শহর স্থাপিত হওয়ার
আগে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল ভূমধ্যসাগরে দারুচিনি বাণিজ্যের প্রধান বন্দর। ক্রুসেডের
সময়ও ইউরোপীয়রা মনে করতো নীল নদের মোহনায় পৃথিবীর শেষপ্রান্তে দারুচিনি উৎপন্ন হয়।
পুরো মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের নিকট দারুচিনির উৎস ছিল রহস্যঘেরা। ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে যাকারিয়া আল কাযিনি প্রথম
উল্লেখ করেন যে দারুচিনি উৎপন্ন হয় শ্রীলংকায়। শ্রীলংকা থেকে এক ধরণের ভেলায়
দারুচিনি নিয়ে যাওয়া হতো পূর্ব আফ্রিকায়। তারপর সেখান থেকে স্থানীয় সওদাগরেরা এটা
রোমান বাজারে নিয়ে যেতো। আরব ব্যবসায়ীরা স্থলপথে সব রকম মশলা মিসরের
আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে যেতো। সেখান থেকে ইতালির ভেনিসের ব্যবসায়ীরা দারুচিনি কিনে
নিয়ে ইউরোপে পাঠাতো। কিন্তু মামলুক সুলতান
এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সময় এই ব্যবসাপথ বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য ইউরোপীয় বণিকেরা এশিয়ায়
আসার জন্য বিকল্প সামুদ্রিক পথের অনুসন্ধানে নামে। ষোড়শ শতকে প্রথমে পর্তুগীজ
নাবিকেরা সিলনে(শ্রীলংকা) আসে। তারা ১৫১৮ সালে দ্বীপটিতে এক দুর্গ বানিয়ে পরবর্তী
একশো বছর শ্রীলংকার দারুচিনির একচেটিয়া ব্যবসা করে। ডাচ বণিকেরা এরপর ১৬৪০ সালে
ক্যান্ডির রাজার সঙ্গে চক্রান্ত করে তাদের বিতাড়িত করে দারুচিনি দ্বীপের দখল নেয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৭ সালে কেরালায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় দারুচিনি রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করে। তারা ১৭৯৬ সালে শ্রীলংকা থেকে ডাচদের সরিয়ে দারুচিনির ব্যবসা
পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কিন্তু ইতোমধ্যে দারুচিনি আরও অনেক দেশে
চাষ করা শুরু হয়ে যায়। এছাড়া কফি, চা, চিনি এবং চকোলেটের ব্যবসার বিস্তার ঘটার ফলে দারুচিনি
তার পুরনো ঐতিহ্য এবং গুরুত্ব অনেকাংশে হারিয়ে ফেলে।
দারুচিনি চাষ
এখন বাংলাদেশসহ অনেক দেশে বাণিজ্যিকভাবে
দারুচিনি গাছ চাষ করা হয়। দারুচিনির চারা
সাধারণতঃ বীজ থেকে হয়ে থাকে,তবে কাটিং বা
গুটিকলম করেও চারা করা যায়। দারুচিনি গাছে জানুয়ারী মাসে ফুল আসে এবং জুলাই-আগস্ট
মাসে ফল পাকতে শুরু করে। দারুচিনি গাছ ১০-১৫ মিটার লম্বা হতে পারে,তবে ডাল ছাটাই করে এটার আকার নিয়ন্ত্রেণে রাখা যায়। পাঁচ বছর বয়সী গাছ হতে
নিয়মিত ছাল ছাড়াবার ডাল( Peeling branch) পাওয়া সম্ভব। একাধিকবার ডাল কাটা যায়, তবে সবচেয়ে ভাল একবার ডাল কাটা এবং সেটা কাটতে হয় এপ্রিল মে মাসে।
সাধারনতঃ ১-৩ সেমি ব্যাসের এবং এক হতে দেড় মিটার লম্বা ডাল কাটা ভাল। এ ধরনের ডাল
হতে ভাল মানের ছাল পাওয়া সম্ভব। বছরে প্রতি হেক্টর জমির পরিণত গাছ থেকে ২০০-৩০০ কেজি
শুকনা ছাল পাওয়া সম্ভব। শুকনা পাতা ও ছাল হতে তেল নিষ্কাশন করা যায়।
দারুচিনি গাছের বাকল প্রক্রিয়াকরণ
কেটে নিয়ে আসা ডালগুলোর পাতা ও ডগা ছেঁটে ফেলার
পরে গোছা বেধে রাখা হয়। এরপরের কাজ হলো বাকল উঠানো। বিশেষ ধরনের ছুরি
দিয়ে অমসৃণ অংশ চেঁচে দেয়া এবং বাকল উঠানো হয়। ঐ ছুরির ধারালো ফলার সামনের দিকটা
গোল ও অল্প বাঁকানো এবং সামান্য খাঁজযুক্ত। ছুরি দিয়ে ডাল থেকে গোল করে কেটে বাকল
তুলে আনার সুবিধা হয়। প্রথমে বাইরের অমসৃণ ছাল ঘসে বা ছাড়িয়ে তুলে দেয়া হয়,তারপর পিতলের দণ্ড দিয়ে ঘষে ঘষে মসৃণ করা হয়। এরপর ডালটির
একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে চিরে দেয়া হয়। এরপর ঐ বিশেষ
ধরনের ছুরির সাহায্যে কাষ্ঠল অংশ থেকে বাকল আলাদা করা হয়। ডাল যেদিন কাটতে হবে
বাকল সেদিনই উঠাতে হবে। উঠানো বাকলগুলো ছায়াযুক্ত জায়গায় সারারাত গাদা করে রাখতে হয়। এগুলোকে একদিন ছায়ায় শুকানোর পরে ৪/৫ দিন রৌদ্রে শুকিয়ে
নিতে হয়। শুকানোর সময় বাকলগুলো সংকুচিত হয়ে নলের মত হয়ে যায়। ছোট নলগুলো বড় নলের মধ্যে
ঢুকিয়ে দিয়ে যৌথ নল বানানো হয় তাতে ওগুলো ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে। এই
নলগুলোকে( শুকনো বাকল) “০০০০” থেকে “০” মান পর্যন্ত শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। “০০০০” গ্রেডের দারুচিনি
হলো সবচে ভালমানের দারুচিনি আর “০”গ্রেডের দারুচিনি হলো সবচে নিম্নমানের
দারুচিনি । মোটা ডাল থেকে অনেক সময় ডাল চেঁচে নিয়ে দারুচিনি বানানো হয়,যাকে বলে “চাঁচা” দারুচিনি। এছাড়া
বিভিন্ন শ্রেণীর দারুচিনি গুঁড়ো করে যে দারুচিনি বানানো হয় তাকে বলে “গুঁড়ো দারুচিনি”।
দারুচিনি সাধারণতঃ দু’ধরনের হয়ে থাকেঃ সিলোন বা মিষ্টিকাঠ দারুচিনি এবং চাইনিজ বা ঝুটা দারুচিনি। সিলোন বা
মিষ্টিকাঠ দারুচিনি সুগন্ধি, মিষ্টিযুক্ত,
কম তীব্র গন্ধ, ছাল কালচে খয়েরী রঙের, পাতলা এবং মসৃণ। অন্যদিকে চাইনিজ বা ঝুটা দারুচিনি কম
সুগন্ধি, মিষ্টিযুক্ত বেশী তীব্র
গন্ধ, ছাল লালচে বাদামী রঙের,
পুরু এবং খসখসে।
দারুচিনির ব্যবহার
খাবারের সুগন্ধ ও স্বাদ বাড়াতে দারুচিনি
ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর আরও অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। দারুচিনি রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। দারুচিনি খাবারে
ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ব্যাহত করে পচন রোধ করে। তাই একে 'ন্যাচারাল প্রিজারভেটিভ' বা 'প্রাকৃতিক খাদ্য
সংরক্ষণকারক' বলা হয়। ১ চা চামচ অর্থাৎ ২.২৬
গ্রাম দারুচিনি থেকে ৫.৯২ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায় এছাড়া ২৭.৮৪ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম, ১ মিলিগ্রাম আয়রন,
প্রায় ১.২৪ গ্রাম ফাইবার বা আঁশ, ০.৩৮ মিলিগ্রাম ম্যাংগানিজ, ১.২৬ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ১১.৩২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ০.৬৬ মাইক্রোগ্রাম ফলেট পাওয়া যায়।
রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয় বলে গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত মাত্রায় দারুচিনি গ্রহণে সতর্কতা
অবলম্বন করা উচিত।
দারুচিনি সম্পর্কে এত ইতিহাস এবং বিস্তারিত
বর্ণনার কারণ হচ্ছে এখন ডায়াবেটিসের ওষুধ হিসেবে দারুচিনি যদি শক্ত আসন তৈরি করতে
পারে তাহলে সেটা হবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য একটি বড় রকমের পরিবর্তন। আর আমরা
তখন হয়তো আবার দারুচিনির পুরনো চাহিদা এবং গুরুত্ব নতুন করে দেখতে পাবো। তবে
এরজন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
তথ্য
সুত্রঃ Ann Fam Med. 2013;11(5):452-459.
No comments:
Post a Comment