শরীর ও মন নিয়ে লেখালেখি

Tuesday 11 February 2014

আমরা কি চিনি চিনি?

আমাদের সকলেরই মিষ্টি খুব প্রিয়। আমরা মিষ্টি কথা শুনতে চাই, মিষ্টি ব্যবহার পেতে চাই; মিষ্টি মেয়ের সঙ্গ আমাদের আনন্দ দেয়। সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আমরা সকলেই “মিষ্টিমুখ”-এর ভক্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অতিরিক্ত মিষ্টি আমাদের শরীরে সয় না। প্রতিদিন খাবারে আমরা যত রকম মিষ্টি খাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মূল উপাদান চিনি। তাই মিষ্টি সম্পর্কে কিছু বুঝতে হলে আমাদের চিনি চিনতে হবে। কিন্তু চিনিকে আমরা কতটুকু চিনি কিংবা চিনি সম্পর্কে আমরা কি জানি? 
প্রতিদিন কতটুকু চিনি খাওয়া উচিত?
আমরা দিনে সাধারণত গড়ে ২২ চা চামচ চিনি খেয়ে থাকি। অর্থাৎ প্রায় আধা কাপ। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েসন একজন সুস্থ পুরুষ মানুষের জন্য ৯ চা চামচ আর মেয়েদের জন্য ৬ চা চামচ চিনি খাওয়া অনুমোদন করে। কিন্তু মার্কিন নাগরিকেরা বছরে প্রায় তাদের গড় ওজনের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১৪২ পাউন্ড চিনি খায়। এই হিসেবের মধ্যে খাবার মিষ্টি করার জন্য ব্যবহৃত সবরকম চিনি এবং সিরাপ গণনা করা হয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে চিনির পুষ্টি মূল্য খুবই সামান্য কিন্তু আমাদের প্রচুর বাড়তি ক্যালরি যোগায় যা শেষ পর্যন্ত চর্বি হিসেবে শরীরে জমে যায়। মিষ্টিপাগল বাংলাদেশের মানুষ যে দিনে কতটুকু চিনি-গুড় খায় তার কোন নির্ভরযোগ্য হিসেব জানা যায়নি।
আসল চিনি, কৃত্রিম চিনি
আজকাল খাবারে অনেক রকম কৃত্রিম  মিষ্টিকারক উপাদান ব্যবহার করা হয়। যেমন-স্টেভিয়া, অ্যাসপারটেম, সুক্রালোজ, নিওটেম, স্যাকারিন ইত্যাদি। এদের মধ্যে স্টেভিয়া গাছ (Stevia rebaudiana) থেকে স্টেভিয়া মিষ্টিকারক তৈরি করা হয়। উদ্ভিদ থেকে প্রস্তুত এই মিষ্টিকারক উপাদানটি সাধারণ চিনির চেয়ে ৩০০ গুণ বেশী মিষ্টি। অবশ্য স্টেভিয়ার স্বাদ কিছুটা তেতো। স্টেভিয়া গাছের পাতা  থেকে প্রক্রিয়াজাত করে এটা তৈরি করা হয় বলে অনেকে স্টেভিয়াকে কৃত্রিম  মিষ্টিকারক হিসেবে গণ্য করতে চান না। কৃত্রিম চিনি শরীরের জন্য ভালো কিনা এটা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, দিনে দিনে চিনির বিকল্প হিসেবে এদের  ব্যবহার বেড়ে চলেছে।
স্যাকারিন এখনও ব্যবহার করা হয়
স্যাকারিন একটি কৃত্রিম মিষ্টিকারক রাসায়নিক উপাদান। এটা আখের চিনির চেয়ে ২০০ থেকে ৭০০ গুণ বেশী মিষ্টি। স্যাকারিন ব্যবহার করলে মূত্রথলিতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য খাবারে স্যাকারিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও অনেক সময় এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
চিনির পরিমাপ
বাজারে খাদ্য দ্রব্যের গায়ে চিনির পরিমাণ গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করা থাকে। এক গ্রাম চিনি আসলে কতটুকু? আমরা যদি এক চা চামচ চিনির কথা চিন্তা করি, তাহলে এক চা চামচে প্রায় ৪ গ্রাম চিনি থাকে। বারো আউন্সের এক বোতল কোককোলায় প্রায় ৩২ গ্রাম চিনি থাকে। তার মানে ৮ চা চামচ চিনি! এই যদি হয় পরিমাপ তাহলে কম চিনি কেমন করে খাওয়া যাবে? চা চিনি ছাড়া খাওয়াই উত্তম। আজকাল ডায়েট কোলা কিংবা মিষ্টি ছাড়া অনেক পানীয় পাওয়া যায়। 
চিনি কেন এত প্রিয়?
মানুষ জন্ম থেকেই মিষ্টি পছন্দ করে। এর পেছনে কারণ রয়েছে।  চিনি মূলত এক ধরণের শর্করা। আমরা যখন শর্করাজাতীয় খাবার খাই  তখন মস্তিস্ক থেকে সেরোটোনিন নামে পরিচিত এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয়। এটা আমাদের মনে এক ধরণের সুখকর অনুভুতি জাগায়। মস্তিষ্কের অধিকাংশ স্নায়ু কোন না কোন ভাবে সেরোটোনিন দিয়ে প্রভাবিত হয়। এরমধ্যে উল্লেখ করা যায় নানারকম আনন্দকর অনুভুতি; যেমন-যৌনতৃপ্তি, ঘুম, স্মৃতি, শিক্ষা, ক্ষুধা ইত্যাদি।সবরকম আনন্দের অনুভুতির সঙ্গেই সেরোটোনিনের সম্পর্ক রয়েছে।  অতএব মিষ্টি খেতে যে ভালো লাগে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এত চিনি কোথায় লুকোনো থাকে?
সোডা, ফলের রস, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন দ্রব্যে চিনি থাকে। এসব খাবার থেকেই আমাদের শরীরে বাড়তি চিনি প্রবেশ করে। সম্প্রতি একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে দিনে দুই-এক বোতল কোমল পানীয় পান করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ২৬% বেড়ে যায়। অবশ্য ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য শুধু চিনিকে দায়ী করা যায় না। উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন চিনি কিংবা চর্বি জাতীয় যে খাবারই হোক না কেন বেশী খেলে আমাদের ওজন বেড়ে যায়। আর ওজন বাড়া মানেই ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া।
এত বেশী খাবারে ফ্রুক্টোজ সিরাপ থাকে কেন?
সাধারণত শস্যদানা থেকে উচ্চ ফ্রুক্টোজ সম্পন্ন কর্ণ সিরাপ সংগ্রহ করা হয়। রাসায়নিকভাবে এবং পুষ্টিমানের দিক দিয়ে এটা আখের চিনির মতোই। উভয়েই ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ দিয়ে তৈরি হয় এবং ক্যালরি মানও সমান। কিন্তু আখের চিনির চেয়ে কর্ণ সিরাপের দাম অনেক কম। এছাড়া প্যাকেটজাত খাবার এবং পানীয়তে কর্ণ সিরাপ ব্যবহার করা সহজ।    
প্রতিনিয়ত খাবার টেবিলে আমরা যে চিনি ব্যবহার করি সেটা আখের রস থেকে তৈরি চিনি। এছাড়া বিটের মূল থেকেও একই চিনি তৈরি করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই চিনির মূল উপাদানের নাম সুক্রোজ। দুধে যে চিনি থাকে তার নাম ল্যাক্টোজ। পৃথিবীতে ব্রাজিল সবচেয়ে বেশী চিনি উৎপন্ন করে। ব্রাজিলে উৎপন্ন চিনি প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি হয়।
বেশী বেশী চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়?
সবশেষে একটি প্রশ্নের জবাব আমাদের দিতেই হবে। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন রয়েছে।  বেশী বেশী চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? সত্যিকার অর্থে এটা ঠিক নয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস মূলত জিনগত সমস্যা থেকে হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস জিনগত সমস্যার পাশাপাশি জীবনাচরণগত সমস্যা থেকে হয়ে থাকে। তাই সরাসরি চিনিকে এজন্য দায়ী করা যায় না। তবে এটাও সত্য  যারা অতি মোটা এবং ওজন বেশী তারা অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করে । এর মধ্যে প্রচুর চিনি থাকে । অতিরিক্ত চিনি খেলে ওজন বাড়ে, ওজন বাড়লে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। অতএব পরোক্ষভাবে চিনিকে দায়ী করা যায়।

অতএব চিনিকে চিনে নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

No comments:

Post a Comment