স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। এদেশের ১৬ কোটি মানুষের শতকরা ৬০
জনের বয়স এখন ২৫ বছরের কম । এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
এরাই এখন বর্তমান সমাজের পরিবর্তনের অগ্রণীসেনা । ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা
বাস্তবায়নের মূল শক্তিও এই তরুণ জনগোষ্ঠী ।
এই স্বপ্ন বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। মূলত ডিজিটাল সেক্টর হবে বাংলাদেশের
পরবর্তী প্রধান ব্যবসা । জুলাই ২০১২ থেকে মে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ
সফটওয়্যার রপ্তানী করে আয় করছে ১০ কোটি ডলার। অর্থনীতির জন্য আই সি টি বা তথ্য
প্রযুক্তি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি কি আমাদের দারিদ্র কমাতে পারবে?
ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারি।
এক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সে
ক্ষেত্রে আমাদের প্রচণ্ড দৈন্য রয়েছে । সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করার
স্বপ্নের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের অনেক বেলা গড়িয়েছে। আমরা সর্বস্তরে বাংলা
প্রচলন করতে পারিনি; কিন্তু মাঝখান দিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে ইংরেজী ভাষার দক্ষতা
হারিয়েছি । ফলে ইংরেজী আর ডিজিটাল প্রযুক্তি দুটোই এখন তরুন সমাজের জন্য সোনার
হরিণে পরিণত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
যাহোক তারপরও বাংলাদেশের যুবসমাজ স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে
নিম্নমানের ইংরেজী জ্ঞান নিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির তুমুল প্রতিযোগিতায় এরা কতদূর
যেতে পারবে? এর সাফল্য নির্ভর করবে বাংলাদেশের যুব সমাজ কত দ্রুত এবং দক্ষতার
সঙ্গে ইংরেজী রপ্ত করতে পারে। এ জন্যও ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্য লাগবে। কারণ
আমাদের স্কুল-কলেজে মানসম্পন্ন ইংরেজী শেখানোর জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং শিক্ষক
নেই। শহরে কিছু ব্যবস্থা থাকলেও, গ্রামের অবস্থা বড়ই করুণ।
এক্ষেত্রে যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে তা মেটানোর মতো বিকল্প ব্যবস্থা কি হতে
পারে? বিগত দশকে বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মোবাইল প্রযুক্তিকে ধারণ করেছে।
দেশে এখন ১০ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আছে। বলা যায় শতকরা ৮০ জন মানুষ এখন
অন্তত একটি মোবাইল ফোনের মালিক এবং এটা সুদূর গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত । সুতরাং
দ্রুত ইংরেজী শেখার জন্য মোবাইল ফোন হতে পারে একটি চমৎকার মাধ্যম ।
পক্ষান্তরে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
পারফরমেন্স খুবই খারাপ। গত ২০১০ সাল পর্যন্ত মাত্র শতকরা ৪ জন কম্পিউটারের
সাহায্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত কম্পিউটারের
মালিক হতে পেরেছে মাত্র শতকরা ৩ জন। তবে সাইবার ক্যাফের সংখ্যা বেড়েছে এবং বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের সংখ্যা বেড়েছে। আইএসপি-র সংখ্যা এখন ৮০-র বেশী। কিন্তু এগুলি কতটুকু শিক্ষা এবং প্রযুক্তির
উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে তা বলা মুশকিল।
ডিজিটাল প্রযুক্তির যা প্রসার হয়েছে সে কথা না বললেও; দুঃখজনক হচ্ছে এখানেও
জেন্ডার বৈষম্য অতি প্রকট। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশী মহিলা হলেও,
ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেয়েরা কিন্তু বিপজ্জনকভাবে
পিছিয়ে আছে।
এখন বাংলাদেশের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ৪৬ জন বিবাহিত। এখনও ৪১ শতাংশ
বালিকা বধূ মনে করে স্বামীরা প্রয়োজন হলে যেকোনো সময় তাদের শারীরিক নির্যাতন করতে
পারে এবং এটা যুক্তিসঙ্গত। অপুষ্টি, মানসম্পন্ন শিক্ষার নিম্নহার এবং কিশোরী
মায়েদের দুর্বল স্বাস্থ্য – বাংলাদেশে মহিলাদের অগ্রগতির পথে বিশাল বাধা। এরকম পরিস্থিতিতে তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ
এবং অগ্রায়নের ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক
নয়।
সামাজিক পরিস্থিতির কারণে মহিলাদের পক্ষে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ
গ্রহণ করাও কষ্টসাধ্য । মেয়েরা এক্ষেত্রে দিনে দিনে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে এবং ডিজিটাল
প্রযুক্তি ব্যবহার সক্ষমতায় জেন্ডার বৈষম্যও বেড়ে যাচ্ছে।
এ সমস্যা অতিক্রম করার জন্য এখন বাংলাদেশে মহিলাদের ইংরেজী ও কম্পিউটার
প্রযুক্তি শেখানোর জন্য ব্যাপকসংখ্যক নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান দরকার।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দু-একটি এনজিও সংস্থা চেষ্টা করলেও সমন্বিত প্রয়াসের অভাবে
তা তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সম্প্রতি ব্র্যাক এবং ব্রিটিশ
কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগে কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সময়ে বলা যাবে এ উদ্যোগ কতখানি
কার্যকর হয়েছে। তবে হাজার রকম সমস্যা এবং রাজনৈতিক চরম অস্থিরতার মধ্যেও ডিজিটাল
স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলাদেশের যুবশক্তি প্রতিযোগিতামুখর দুনিয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত
করার চেষ্টা করছে। সে স্বপ্ন সত্য বাস্তবে রূপ লাভ করুক। এটাই আমাদের একান্ত
কামনা।
তথ্যসূত্রঃ ব্রিটিশ কাউন্সিল ভয়েস
No comments:
Post a Comment